অস্থির সময়ের মানুষ

প্রতীকী ছবি

মুক্তমত

অস্থির সময়ের মানুষ

  • সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
  • প্রকাশিত ২ জানুয়ারি, ২০২০

একটি বছর শেষ হলো। অবশ্যই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। বিগত বছরে কত কিছুই তো ঘটল। কে তার কতখানি হিসাব রাখে? কিন্তু আমাদের বড় বড় নেতানেত্রীর সুবচন আমাদের স্মরণ করতেই হয় মাঝেমধ্যে। সদ্য শেষ হওয়া বছরটিতে ডেঙ্গু কাঁপিয়ে দিয়েছিল দেশের মানুষকে। আর একটি ঘটনা নিয়মিতই আলোচনা ছিল তা হচ্ছে ধর্ষণ। বিশেষত নুসরাত হত্যা বিষয়টিতে গণমানুষের মনে ধিক্কারের জন্ম দিয়েছে।

এখন সবচেয়ে মারাত্মক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে ওই ধর্ষণ। মেয়েদের জন্য নিরাপত্তা ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। ধর্ষণের ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগ, প্রেমের অভিনয়, চাকরির প্রতিশ্রুতি, বিয়ের প্রলোভন, মাদক খাওয়ানো, সবকিছু ব্যবহূত হচ্ছে। ওয়ারী এলাকার আট বছরের ওই মেয়েটির কথা ভাবলে আতঙ্কের অবধি থাকে না। ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকে। জায়গা নেই খেলবার। তারই বয়সের একটি শিশুর সঙ্গে খেলতে গেছিল ও-বাড়িরই আরেক ফ্ল্যাটে। সঙ্গীটিকে সে পায়নি, কিন্তু চাচা বলে কথিত একজনকে পেয়েছে। সেই চাচা এই শিশুটিকে খেলার প্রলোভন দেখিয়ে ছাদে নিয়ে গেছে, তারপর উদ্যত হয়েছে ধর্ষণে। শিশুটি চিৎকার করে উঠলে ধর্ষণ কর্ম শেষে তাকে গলাটিপে হত্যা করে ফেলে দিয়ে পালিয়ে গেছে। এরকম ঘটনা কিন্তু হামেশাই ঘটছে। এবং এটাই  হচ্ছে বাস্তবতা।

ধর্ষণের এসব ঘটনা এবং আরো যেসব অপরাধের কথা আমরা জানি, এখানে কিছু কিছু উল্লেখও করলাম, অন্যত্রও আমরা আলোচনা করে থাকি, সেগুলো মনে হবে বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু আসলে তা নয়, সেগুলো সবই একটি ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। সেটি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক। ব্যবস্থাটি অন্যকিছু নয়, পুঁজিবাদ ভিন্ন। পুঁজিবাদ অনিবার্য ও অসংশোধনীয় রূপে পিতৃতান্ত্রিক। বাংলাদেশও ওই পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনেই রয়েছে। ক’দিন আগে অনেক ক’টি কাগজে এই মর্মে খবর বের হয়েছে যে পাবনা অঞ্চলের একটি কলেজের শহীদ মিনারটি ভেঙে স্থানীয় এমপি সাহেব তাঁর পিতার ম্যুরাল বানিয়েছেন। পিতৃভক্তি-প্রসূত এরকমের কাজ মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়।

মাতা? জননী? তিনি যতই যা হোন পিতার পত্নী বৈ নন। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে পিতৃতান্ত্রিক পুরুষের হাতে নারী নির্যাতন। বাংলাদেশের মেয়েরা আজ আর আগের অবস্থানে নেই। তারা দৃঢ় পদে পোশাক কারখানায় যায়, পথেঘাটে হাঁটে। সাইকেল চালায়, মোটরসাইকেলও চালায়। উড়োজাহাজও চালাচ্ছে। রাইড শেয়ারে যাতায়াত করে। কিন্তু তারা মোটেই নিরাপদে নেই। তাদের বোরকা ও হিজাব বিজয়ের পতাকা নয়, আত্মসমর্পণের ঘোষণা বটে। আত্মসমর্পণ করে যে রক্ষা পাবে তাও হচ্ছে না।

ভরসার ব্যাপার এটা যে তারা দমে যায়নি। বিগত বছরে একই দিনে (১ সেপ্টেম্বর) দুটি ছবি ছাপা হয়েছে দুটি দৈনিকে। একটি ছবির পরিচয় : ‘নারায়ণগঞ্জের উত্তর চাষাঢ়া এলাকায় রাবেয়া ইসমাইল হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের রাস্তায় ছাত্রীরা দেয়াল ধরে রাস্তা পার হচ্ছে।’ যেন মরণপণ। তিন বছর ধরে নাকি ওই রাস্তায় পানি জমে আছে। সরেনি। তাই বলে মেয়েরা যে হাল ছেড়েছে তা নয়। ওই তিন বছর ধরেই তারা ওইভাবে দেয়াল ধরে ঝুলতে ঝুলতে স্কুলে যাতায়াত করছে। আরেকটি ছবি মেয়েদের একটি মানববন্ধনের। তারা যে ব্যানারটি ধরে দাঁড়িয়ে আছে তাতে লেখা পড়তে পারছি : ‘ভাণ্ডারিয়া সরকারি বন্দর গার্লস স্কুলের ১০ম শ্রেণির মেধাবী ছাত্রী আমার বন্ধু আমার বোন বিনয়ী, সদালাপী রুবাইয়া রূপার উত্ত্যক্তকারী সন্ত্রাসী তামিম খান গংদের দ্রুত বিচার ও ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন।’ নিচে আরো আছে, ‘আমার বন্ধু আমার বোন মরল কেন প্রশাসন জবাব চাই।’ একই দিনে প্রায় সব পত্রিকাতেই অন্য একটি খবর বের হয়েছে, সেটিও আশা জাগায়। উত্ত্যক্তকারী এক মাতাল পুলিশকে একটি মেয়ে পায়ের স্যান্ডেল খুলে পিটিয়েছে। তার পরে অন্য মেয়েরা একত্র হয়ে পুলিশটিকে গণধোলাই দিয়েছে। শেষে পুলিশ বাহিনী এসে নিজেদের এই সহকর্মীকে উদ্ধার করে নিয়ে গেছে।

অনেকেই আছেন যারা ব্যবস্থাটাকে জানতে-বুঝতে চান না। বলেন হ্যাঁ সবই দেখি, সবকিছুই শুনি, কিন্তু কেন যে ঘটছে বুঝি না। বলেন জানি না এসবের কারণ কি। এই বুঝতে না পারাটা কিন্তু মোটেই গৌরবের কোনো ব্যাপার নয়। গত শতাব্দীতে দেখেছি, উদারনীতিক বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ বলেছেন, না, আমি বুঝি না কেন এসব ঘটছে। এখনো অমন কথা শুনতে হয়। ধরা যাক ঔপন্যাসিক ও বুদ্ধিজীবী ই. এম. ফরস্টারের কথা। এর উপন্যাস ‘এ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া’র বিষয়ে আমরা অনেকেই জানি। সেটি তিনি লিখেছেন ১৯২৪ সালে, তারপরে বেঁচেছিলেন আরো ৪৬ বছর, মারা যান ১৯৭০-এ। কিন্তু আর কোনো উপন্যাস তিনি লিখতে পারলেন না। প্রবন্ধ লিখলেন, বক্তৃতা করলেন, ‘স্যার’ উপাধি প্রদানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন, কিন্তু উপন্যাস লেখা ১৯২৪-এ শেষ। কারণ কী? কারণ হলো পরিবর্তিত পুঁজিবাদী বিশ্বকে উপন্যাসের ভেতরে নিয়ে আসার অক্ষমতা। তিনি বুঝেছেন পৃথিবীটা বদলে গেছে, এবং তিনি বদলে-যাওয়া পৃথিবীর মোকাবিলা করতে পারছেন না। করবার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তার নিজেরই উদারনীতি। তিনি বলেছেন যে ভিক্টোরীয় যুগের শেষ প্রান্তে না জন্মে যদি জন্ম নিতেন কিছু পরে তাহলে নির্ঘাত কমিউনিস্ট হয়ে যেতেন, কিন্তু সময়ের বেষ্টনীর কারণে ওই সাহসটা তার হয়নি। সে জন্য তাকে বারবার বলতে হয়েছে, আমি তো বুঝতে পারছি না কি ঘটছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হয়ে গেছে দেশপ্রেমিকরা তখন বিকট আওয়াজ তুলেছিলেন, ‘ন্যায়-অন্যায় বুঝি না, আমার দেশ সে আমারই দেশ’; তারই মধ্যে ফরস্টারের বুকে এমন সাহস ছিল যে লিখেছিলেন কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে তুমি তোমার দেশের নাকি তোমার বন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে, তাহলে আমি বলব আমি বরং দেশ ছাড়ব কিন্তু আমার বন্ধুকে ছাড়ব না। তার উদারনীতি তাকে বলত ব্যক্তিগত সম্পর্কই হচ্ছে মানুষের শেষ ভরসা। এবং যে কটি উপন্যাস তিনি লিখেছেন সবকটিই ওই ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করেই লেখা। ব্যক্তিগত সম্পর্কের, বিশেষ করে বন্ধুত্বের মানবিকতায় তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তো মনে করে না যে ব্যক্তিগত সম্পর্কেই মানুষের মনুষ্যত্বের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও মহত্তম প্রকাশ, মানতে চায় না যে মানুষ মানবিক সম্পর্কের কারণেই মানুষ থাকে। আর সেটা মানে না বলেই তো বন্ধু বন্ধুকে বাঁচাতে পারে না; উল্টো দেখা যায় বন্ধু শত্রু হয়ে পড়েছে, ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো ভেঙে ভেঙে পড়ছে; আসছে ঈর্ষা, প্রতিযোগিতা, স্বার্থপরায়ণতা। আর রয়েছে অর্থনৈতিক নিষ্পেষণ। ফরস্টার যে ভারতবর্ষকে নিয়ে তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাসটি লিখেছেন সেখানে ওই সমাজে গরিব মানুষের হালটা যে কী ছিল সে বিষয়ে প্রায় কোনো উল্লেখই নেই। গরিব যে মানুষ আছে তার একটু আভাস আছে মাত্র। সুন্দরভাবে তিনি স্বীকার করেছেন যে অতিদরিদ্রদের নিয়ে তিনি লিখতে পারেননি। সীমাটা, আবারো বলি, উদারনীতিরই। উদারনীতি পুঁজিবাদের সমালোচনা করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে মেনে নেয়।

ফরস্টারের সেই ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষ এখন আর নেই। উপমহাদেশ স্বাধীন হয়েছে, অনেকে অনেক উন্নতি করেছে। কিন্তু গরিব মানুষ কেমন আছে? আমাদের এই বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক না কেন। যারা এর উন্নতির জয়গান একটানা গাইতে থাকেন তারা মনে হয় ভিক্ষুক, প্রায় ভিক্ষুক, বেকার, অর্ধ-বেকার, সম্বলহীন বৃদ্ধ মানুষদের বিশেষ করে বৃদ্ধাদের দেখেন না; দেখলেও দেখতে চান না। চোখ ফিরিয়ে নেন।

কেবল হতদরিদ্ররা নয়, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষেরাও মস্ত মস্ত ঝুঁকির মধ্যে আছেন। বাঁচার পথ সবার জন্য সংকীর্ণ হয়ে এসেছে, নইলে আত্মহত্যার ঘটনা এভাবে বাড়বে কেন? গেল বছর নাকি প্রতিদিন গড়ে ৩২ জন মানুষ আত্মহনন করেছেন। সবাই আত্মহত্যা করেন না, অনেকেই প্রান্তে পৌঁছে ঝুলে থাকেন। বাড়ে হতাশা, বাড়তে থাকে কথিত অপরাধপ্রবণতা, এবং নানারকমের মাদকে আসক্তি। এরকমের ঘটনা তো প্রায়ই ঘটছে, যার কথা কিছুদিন আগে কাগজেই পড়েছি। তিনজনের এক পরিবার; মা, মেয়ে ও ছেলে; ঢাকা শহরে তিনজন মিলে একটি ভাড়া-করা বাসাতে বসবাসরত অবস্থায় আত্মহত্যা করেছেন। ছেলে মুহিত হাসান (২৮) একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ শেষ করেছে, বিসিএস প্রিলিমিনারি দিয়েছে সে, ফল প্রকাশের অপেক্ষায় ছিল। তার বোনটি শারীরিক প্রতিবন্ধী। বাবা সরকারি চাকরি করতেন। তিন বছর হলো তিনি মারা গেছেন। কিছু সম্পত্তি রেখে গেছেন, কিন্তু তার সবটাই চলে গেছে আত্মীয়দের দখলে। আত্মহননকারী ওই তিনজনের ঘরে একটি চিরকুট পাওয়া গেছে; তাতে লেখা, ‘আত্মীয়স্বজনের অবহেলায় আত্মহত্যা করলাম। সম্পত্তি গরিবদের বিলি করে দেবেন।’ (প্রথম আলো, ১৩ মে, ২০১৯) নিশ্চয়ই তারা অত্যন্ত হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। ভরসা পাননি। কোনো দিকে কোনো উপায় দেখেননি বাঁচার। তাই ঠিক করেছেন মরে গিয়ে বেঁচে যাবেন। নিজেদের হত্যা করার আগে নিজেদের মধ্যে তারা কী আলাপ করেছেন আমরা জানি না, কল্পনা করতেও পারি না, আমাদের কল্পনাশক্তি এতটা ক্ষমতা রাখে না, সাহসও রাখে না; রাখলে আমরা অস্থির হয়ে পড়তাম। বেদনায়, সহানুভূতিতে। আমরাও কী বেঁচে আছি, নাকি টিকেই আছি শুধু? 

 

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads