মাহাবুবুর রহমান, কক্সবাজার
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র ছয় বছর আগে (১৯৬৫) স্বাধীন হয় সিঙ্গাপুর। এ দেশটি এখন বিশ্বের ভ্রমণপিপাসুদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান। একটি ছোট্ট দ্বীপের চারপাশে পর্যটকদের নৌকা ভ্রমণের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয় দেশটির পর্যটন ব্যবসা। এরপর সিঙ্গাপুরের বদলে যাওয়ার গল্প সবারই জানা। বছরে কয়েক মিলিয়ন পর্যটক ভ্রমণ করেন দেশটিতে। তাতে আয় হয় কয়েক বিলিয়ন ডলার। অথচ সিঙ্গাপুরে কক্সবাজারের মতো দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত নেই, নেই গোধূলির রঙ ভেঙে নীলজলে তপ্ত সূর্যের নিভে যাওয়ার দৃশ্য, নেই সবুজ পাহাড় আর তার বুক চিড়ে বয়ে যাওয়া ঝরনা। শুধু সিঙ্গাপুর নয়, কোনো দেশেই নেই সেন্ট মার্টিন আর মহেশখালীর মতো অপরূপ বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে বাংলাদেশের মতো কোনো সুনির্দিষ্ট পর্যটন স্থান না থাকলেও তাদের কর্মকৌশল আর প্রচারের কারণে ভারতের রাজস্বে ২২ শতাংশ জোগান দেয় পর্যটন খাত। এ ধরনের আরো বহু দেশের পর্যটন সফলতার গল্প আমরা সবাই জানি।
বাংলাদেশে পর্যটন খাতে সবচেয়ে বেশি আয় হয় কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প থেকে। অথচ সম্ভাবনাময় এ খাতটি এখনো অবহেলিত। কক্সবাজারে সৌন্দর্যের নানা উপাদান থাকলেও তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। উল্টো সেখানকার সৌন্দর্য ধীরে ধীরে নষ্ট করা হচ্ছে। তাই কক্সবাজারের পর্যটন সম্ভাবনা কাজে লাগানোর দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাদের মতে, দেশি পর্যটকদের মাধ্যমে কক্সবাজার থেকে প্রতি বছর হাজার কোটি টাকা আয় হলেও সেখান থেকে কাঙ্ক্ষিত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে না। এর জন্য পর্যাপ্ত বিনোদন আর প্রচারের অভাবসহ নানা অব্যবস্থাপনা দায়ী। সম্ভাবনাময় এই শহর যদি বিদেশিদের ভ্রমণ উপযোগী করে গড়ে তোলা যায়, তাহলে দেশের অর্থনীতি আরো সচল হবে।
কক্সবাজারের তারকা হোটেল কক্সটুডের প্রধান নির্বাহী সাখাওয়াত হোসেন বলেন, কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত হাজারো মানুষ। কিন্তু বিদেশি পর্যটক না থাকায় তাদের মধ্যে এখন হতাশা বিরাজ করছে। তাই বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করতে এখনই সরকারের উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। দেশি পর্যটকদের ওপর নির্ভর করে পর্যটন খাতের উন্নয়ন সম্ভব নয়। কক্সবাজারে যদি বিদেশি পর্যটক না আসেন, তাহলে এ খাতে পরিবর্তন আনা প্রায় অসম্ভব।
কক্সবাজার সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর এম এ বারী বলেন, ‘পর্যটনের সব উপাদান থাকলেও যথাযথ উদ্যোগের অভাবে বিদেশি পর্যটকদের কাছে কক্সবাজারের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। সবাই তারকা মানের হোটেল নির্মাণে ব্যস্ত। বর্তমানে সেখানে আর নতুন হোটেল-মোটেলের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। নতুন উদ্যোক্তারা যদি হোটেলমুখী না হয়ে পর্যটন স্পটগুলোর উন্নয়নে কাজ করেন, তাহলে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে পরিবর্তন আনা সম্ভব।
তিনি আরো বলেন, রাজনৈতিক টানাপড়েনে বিপর্যস্ত কক্সবাজারের পর্যটন খাত। নিজেদের মধ্যে টানাটানি করেই সময় পার করে প্রশাসন। কিন্তু বিশ্বের উন্নত ও পর্যটনবান্ধব দেশগুলোকে অনুসরণ করতে পারলে দেশের পর্যটন খাতেও পরিবর্তন আসবে।
কক্সবাজার ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের নেতা মফিজুল ইসলাম মফি বলেন, ‘কক্সবাজারে এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোনের কাজ এখনো ঝুলে আছে। কমেনি রাস্তার দূরত্ব, কৃত্রিমভাবে তৈরি হয়নি বিনোদনের নতুন ক্ষেত্র। যেটা আছে, সেটারও সঠিক পরিচর্যা করা হয় না। ফলে বিদেশি পর্যটক টানতে পারছে না বিশ্বের দীর্ঘতম এই সমুদ্রসৈকতটি।
কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আবু তাহের চৌধুরী বলেন, পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে কক্সবাজারে বিদেশি পর্যটক আসছেন না। নতুন যেসব উদ্যোক্তা আসছেন, তারা জমি দখল এবং হোটেল ও রেস্তোরাঁ নির্মাণে ব্যস্ত থাকেন। ফলে সৈকতের ১২০ কিলোমিটারের মধ্যে মাত্র কয়েকটি পয়েন্ট ছাড়া বাকিটুকু পর্যটনের আওতায় আসেনি। তবে সৈকতের বাকি অংশে নতুন পর্যটন স্পট তৈরি করা গেলে বিদেশি পর্যটকরা আসবেন। পর্যটন শিল্পের বিকাশে সরকারের নেওয়া পরিকল্পনাগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন হলে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে।
এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, কক্সবাজারের অপার সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করছে সরকার। কক্সবাজারের উন্নয়নে সরকারের বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে বিদেশি পর্যটকদের আগমন বাড়বে।