কাগজ বা কাপড়ের তুলনায় অনেক টেকসই বলে পণ্যের মোড়ক বা ব্যাগ তৈরিতে প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়ছে দিন দিন। কোমল পানীয় থেকে শুরু করে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের বোতল তৈরি হচ্ছে প্লাস্টিক দিয়ে। পাশাপাশি তৈজসপত্র থেকে আসবাব সবকিছুতে প্লাস্টিকের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে।
পৃথিবীতে এখন প্রতিবছর মাথাপিছু ৬০ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহার হয়। উত্তর আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ এবং জাপানের মতো শিল্পোন্নত দেশগুলোয় এই পরিমাণ মাথাপিছু ১০০ কেজিরও বেশি। ১৯৫০ সালে সারা পৃথিবীতে মাত্র ২ দশমিক ২ টন প্লাস্টিকের উৎপাদন হলেও ২০১৫ সালে সে পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৪৮ মিলিয়ন টনে।
আর এর মাত্র ৯ শতাংশকে পুনরায় ব্যবহার করা হয়েছে, পুড়িয়ে নষ্ট করা হয়েছে ১২ শতাংশ আর বাকি ৭৯ শতাংশই পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশে জমা আছে।
সাধারণত প্রকৃতিতে প্লাস্টিক মিশে যেতে ১০০ থেকে ৫০০ বছর লেগে যায়৷ মাইক্রো অর্গানিজম বা অণুজীবরা এগুলো নষ্ট করতে পারে না। আবহাওয়ার কারণে ছোট ছোট টুকরা হয়ে বাতাসে বা পানিতে ভাসতে থাকে এসব ব্যাগ। অনেক প্রাণী প্লাস্টিকের টুকরাগুলো খাবার জিনিস মনে করে তারা খেয়ে ফেলে, হজম করতে পারে না, মলের সঙ্গে বের হয় না, অনেক সময় গলায় আটকে শ্বাসরোধ হয়ে মারাও যায়।
তুলনামূলক সস্তা হওয়ায় বেশিরভাগ কাপড়েই সিনথেটিক ফাইবারের ব্যবহারও বেড়েছে৷ সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক গবেষণায় দেখা গেছে ওয়াশিং মেশিন থেকে প্রতিবছর ৩০ হাজার টন সিনথেটিক ফাইবার পানিতে মেশে।
গবেষকদের দাবি, বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ১২ বিলিয়ন টনে। আর ওই সময়ের মধ্যে বিলুপ্ত হতে পারে সমুদ্রের ৯৫ শতাংশ প্রাণী!
কিন্তু মানুষ আসন্ন এই বিপর্যয় চুপচাপ মেনে নেবে না। এক দিকে কিছু মানুষ যখন তার চারপাশকে দূষিত করেই যাচ্ছেন সেখানে অনেকে আসন্ন এই বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচতে লড়াই করে যাচ্ছেন নিরন্তর।
এ জন্য তাদের জানতে হয়েছে, কেন প্লাস্টিক সহজে পচে না? সাধারণ যেকোনো দ্রব্য পরিবেশে রেখে দিলেই কিছুদিনের মধ্যে এর পচন শুরু হয়ে যায়। আর এই পচনের পেছনে দায়ী সাধারণত কিছু অণুজীব। বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় প্রকৃতিতে প্রাপ্ত সব ধরনের পদার্থকেই ভেঙে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করতে পারে অণুজীব। কিন্তু কৃত্রিমভাবে নির্মিত প্লাস্টিক অণুজীবের আওতার বাইরে। তাই প্লাস্টিক বছরের পর অবিকৃত অবস্থায় থেকে যায়। অণুজীব এদের ভেঙে সরল উপাদানে পরিণত করতে না পারায়, বিশ্বজুড়ে প্লাস্টিক উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রে এদের পরিমাণ বেড়ে চলছে। দিন পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বড় আকারের প্লাস্টিক ক্রমান্বয়ে পরিণত হচ্ছে ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণিকায়। আর একটা অযাচিত অভিশাপ হিসেবে চেপে বসেছে মানব সভ্যতার ঘাড়ে।
প্লাস্টিকের অভিশাপ থেকে মুক্তি
বছর দুয়েক আগে বৈশ্বিক প্লাস্টিক দূষণ সঙ্কট কাটানোর একটি সমাধান আবিষ্কার করেন জাপানের গবেষকরা। তারা এমন এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কার করেন যা বিশ্বের উৎপাদন, প্যাকেজিং ও বস্ত্র শিল্পে অহরহ ব্যবহূত সবচেয়ে টেকসই পলিমার পলিইথিলিন টেরেফথেলেটকে (পিইটি) খেতে পারে। পিইটিকে তাদের মূল শক্তি ও কার্বনের উৎস হিসেবে ব্যবহার করে। নতুন আবিষ্কৃত ইদিওনেলা সাকাইয়েনসিস ২০১-এফ৬ দুটো এনজাইমের মাধ্যমে প্লাস্টিক দ্রবীভূত করে। এরা পিইটিকে পরিবেশবান্ধব টেরেফথ্যালিক অ্যাসিড ও ইথাইলিনে রূপান্তর করে।
তবে তখন বলা হয়, এসব ব্যাকটেরিয়া কার্যকর। তবে তারা অতটা ক্ষুধার্ত নয়। প্লাস্টিক বর্জ্য পচাতে তাদের সময় লাগে অনেক।
কিন্তু সম্প্রতি গবেষকরা দুর্ঘটনাবশত এমন একটি এনজাইম আবিষ্কার করেছেন যা প্লাস্টিককে পুরোপুরি পচিয়ে ফেলতে পারে। লাইভ সায়েন্স ডটকমের এক খবরে বলা হয়েছে, সম্প্রতি আবিষ্কৃত পিইটিএএসই এনজাইমের ক্রিস্টাল গঠনের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গিয়ে তারা দেখেন সেগুলো প্রাকৃতিকভাবেই বিবর্তিত হয়েছে। আর বিবর্তিত হয়ে গঠন করছে নতুন ধরনের এনজাইম যা পিইটির চেয়ে অনেক সহজেই প্লাস্টিক কণা ‘হজম’ করতে পারে।
এই আবিষ্কার নিয়ে যুক্তরাজ্যের পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রাকচারাল বায়োলজির অধ্যাপক জন ম্যাকগিহন বলেন, গবেষণাগারে কাকতালীয়ভাবে অনেক কিছুই আবিষ্কার হয়ে যায়। পিইটিএএসই এনজাইম নিয়ে আমাদের যে আবিষ্কার তা মোটেই প্রত্যাশিত ছিল না।
বছর দুই আগে Ideonella sakaiensis প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে প্রথম পিইটি এএসই এনজাইমের সন্ধান পান জাপানি গবেষকরা। সেই থেকে গবেষকদের গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় এই পিইটিএএসই এনজাইম। তারা প্রথমে মনে করেন, এই এনজাইমটি গাছের ত্বকে যে মোমের প্রলেপ থাকে তা ভাঙতেই পটু। কিন্তু পরে তারা দেখেন, এটি প্লাস্টিক কণা পচাতেও বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
কিন্তু এবারের গবেষণায় পিইটিএএসই এনজাইমের কাঠামোতে বল প্রয়োগ করলে তার প্লাস্টিক পচানোর সক্ষমতা বাড়ে।
যদিও এই গবেষণায় পাওয়া প্রাপ্ত ফলাফল প্লাস্টিকের অভিশাপ থেকে মুক্তির এই নিশানা উড়িয়েছে তবু এখনো বিশ্বজুড়ে প্লাস্টিকের ভাগাড়ে সেটি ব্যবহারের মতো বাস্তব অবস্থায় আসেনি।
তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো এটি আগামীতে আরেক ধরনের প্লাস্টিক পলিথিলিন ফিউরানডিকার্বোক্সিলেট (পিএফই) পচানোর সক্ষমতাও অর্জন করবে বলে আশাবাদী গবেষকরা।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল রিনিউঅ্যাবল এনার্জি ল্যাবরেটরির একজন জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী গিগ বেকহাম বলেন, পিইটিএএসই এনজাইম কাঠামোর প্রোটিন প্রকৌশল নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কাকতালীয়ভাবেই প্লাস্টিক কণাকে ভাঙতে পারে এমন এক ধরনের এনজাইম আবিষ্কার করে ফেলেছি। আগে জাপানি গবেষকরা যে প্লাস্টিক খেকো ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কার করেন তার এনজাইম যত দ্রুত প্লাস্টিক পচাতে পারে নতুন এনজাইমটি তার চেয়েও দ্রুত প্লাস্টিকের কণাকে ভাঙতে পারে।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, এই এনজাইমটি নিয়ে আরো কিছু কাজ করলে, এদের কার্যক্ষমতা আরো বাড়ানো গেলে হয়তো পৃথিবীকে প্লাস্টিকের অভিশাপ থেকে মুক্তি দেওয়া যেতে পারে।