ধর্ম

অন্যের ভুল সংশোধনে ইসলামের আদর্শ

  • প্রকাশিত ৯ জানুয়ারি, ২০২১

মুহাম্মাদ আবু আখতার

 

 

 

মানুষ মাত্রই ভুল। জীবনে কখনো ভুল করে নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মানুষের ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় অনেক কাজে প্রায়ই ভুল হয়ে থাকে। প্রত্যেকে সাধারণত নিজের ভুল সম্পর্কে খুব কমই খেয়াল রাখে। অন্য মানুষের চোখেই তার ভুলগুলো সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। এজন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক মুমিনকে আরেক মুমিনের আয়না বলে ঘোষণা করেছেন। কোনো মুমিন ভাইয়ের ভুল আরেক ভাইয়ের দৃষ্টিতে ধরা পড়লে তা সংশোধনের চেষ্টা করা প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব। এক্ষেত্রে চুপ থাকা দোষণীয়। তবে অন্যের ভুল সংশোধনের ব্যাপারটি যেহেতু খুবই স্পর্শকাতর বিষয়, তাই এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। নতুবা হিতে বিপরীত হতে পারে। ইসলামের দৃষ্টিতে এক্ষেত্রে আমাদের কী করণীয় এবং কারো ভুল সংশোধনের উপায় কী এ বিষয়ে সম্যক জ্ঞান লাভ করা আমাদের জন্য আবশ্যক।

আমরা সাধারণত অন্যের কোনো ভুল দেখলে তাকে সামনাসামনি কটাক্ষ করে কথা বলি অথবা তার অনুপস্থিতিতে অন্যের কাছে সমালোচনা করি। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে এর কোনোটিই উচিত নয়। এভাবে কারো ভুল সংশোধনের চেষ্টা ইসলামসম্মত নয় এবং তা কোনো সুফল বয়ে আনে না। এ দুই উপায়ে মানুষের সংশোধনের সম্ভাবনা খুব কম; বরং এ ক্ষেত্রে মানুষের পারস্পরিক মনোমালিন্য ও শত্রুতা সৃষ্টির সম্ভাবনাই বেশি। তাই এ দুপদ্ধতিই ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। উভয়টার জন্যই পবিত্র কোরআনে সতর্ক করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা এ দুই শ্রেণির লোকদের ব্যাপারে বলেন, ‘ধ্বংস হোক ওইসব লোক, যারা মানুষকে কটাক্ষ করে কথা বলে এবং (আরো ধ্বংস হোক) ওইসব লোক, যারা মানুষের অনুপস্থিতিতে তার নিন্দা করে।’ (সুরা হুমাযাহ, আয়াত-১)

আমাদের সমাজে বিভিন্ন প্রকৃতির মানুষ রয়েছে। সবার মন-মানসিকতা সমান নয়। প্রত্যেকের অবস্থা বিবেচনা করে তার ভুল সংশোধনের চেষ্টা করা দরকার। কিছু মানুষকে ভুলের ব্যাপারে সতর্ক করা হলে তারা তা বুঝতে পেরে অকপটে স্বীকার করে তাদের ভুল সংশোধন করে নেয়। এ ধরনের লোকদের কোনো ভুল হয়ে গেলে তাদেরকে একাকী গোপনে নম্র ভাষায় সে ভুলের ব্যাপারে সতর্ক করা উচিত। তা না করে সবার সামনে তিরস্কার করে তাদেরকে লজ্জা দেওয়া অথবা অন্যের কাছে তাদের দোষ প্রকাশ করা খুব অন্যায়। এটা তাদের ইজ্জতের ওপর আঘাত হানার সমতুল্য গোনাহ। আর কোনো মুসলমানের ইজ্জতে আঘাত হানা হাদিসের ভাষ্যমতে সুদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের গোনাহ। সুদের সর্বনিম্ন পর্যায়ের গোনাহ হচ্ছে নিজ মায়ের সাথে জেনায় লিপ্ত হওযার সমতুল্য। এ থেকে কোনো মুসলমানের ইজ্জতের ওপর আঘাত হানার গোনাহ যে কত জঘন্য তা সহজেই অনুমেয়।

আবার কিছু মানুষ আছে যাদেরকে ভুলের ব্যাপারে সতর্ক করা হলেও তাদের ভুল স্বীকার করে না; বরং ভুলের পক্ষে খোঁড়া যুক্তি দেয়। এ ধরনের লোকদের সামনে হিকমাতের সাথে অকাট্য যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন করে তাদের যুক্তি খণ্ডন করে তাদেরকে লা-জওয়াব করার চেষ্টা করা যেতে পারে। এতে তারা যদি তাদের ভুল বুঝতে পেরে সংশোধিত হয় তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ! যদি সত্যকে গ্রহণ করার মানসিকতা তাদের না থাকে তাহলে তাদের সাথে অযথা তর্কে লিপ্ত হওয়া উচিত নয়। তবে তাদের ভুলের দ্বারা যদি অন্য কারো বিভ্রান্ত হওয়ার আশংকা থাকে তাহলে তাদের এব্যাপারে প্রকাশ্যে সবাইকে সতর্ক করা উচিত। তবে এক্ষেত্রেও সীমালঙ্ঘন করা ঠিক নয়। শুধুমাত্র তাদের ভুলের ব্যাপারে উপযুক্ত দলিলপ্রমাণ পেশ করে সবার সামনে সঠিক তথ্য প্রকাশ করাই কাম্য। অযথা তাদেরকে গালিগালাজ করা, তাদের বিরুদ্ধে কটূক্তি করা এবং তাদের সাথে অনর্থক ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হওয়া বাড়াবাড়ি ও নিন্দনীয় ব্যাপার।

আল্লাহতায়ালা হজরত মুসা (আ) এবং হারুন (আ) কে যখন ফেরাউনের কাছে পাঠান তখন তাদেরকে নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন, ‘অতঃপর তোমরা তাকে নম্র কথা বলো, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভীত হবে।’ (সুরা ত্বহা, আয়াত- ৪৪) যেই ফেরাউন নিজেকে খোদা বলে দাবি করেছিল তার সাথে নম্র কথা বলার জন্য আল্লাহতায়ালা দুজন মহাসম্মানিত পয়গম্বরকে নির্দেশ দিয়েছেন। এ থেকে আমাদের জন্য বিরাট শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। আমরা অনেকে কোনো মুসলমান ভাইয়ের সামান্য ভুল-ত্রুটি পেলেই অকথ্য ভাষায় তাকে বকাঝকা ও গালিগালাজ করি। অথচ একজন সর্বনিকৃষ্ট পর্যায়ের মুসলমানও ফেরাউনের চেয়ে অনেক গুণে উত্তম। কেননা, ফেরাউন আল্লাহতায়ালাকে অস্বীকার করেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং নিজেকেও খোদা বলে দাবি করেছিল। এ বিশ্বে সম্ভবত: আর কোনো কাফের এতো প্রকাশ্যভাবে নিজেকে খোদা দাবি করার ধৃষ্টতা দেখানোর সাহস পায়নি। আর আমাদের কেউ সারা জীবন সাধনা করলেও মুসা (আ) এবং হারুন (আ) এর সমমর্যাদা তো অনেক দূরের কথা তাদের পায়ের ধূলিকণার সমতুল্য হওয়াও সম্ভব নয়। একজন চরম নিকৃষ্ট কাফেরকে দাওয়াতের জন্য তার সাথে দুজন শ্রেষ্ঠ মানবকে যদি নম্র ভাষা ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয় তাহলে একজন মুসলমানের সংশোধনে আরেক মুসলমানের ভাষা কত বেশি নম্র হওয়া উচিত তা আমাদের চিন্তার বিষয়।

অধীন ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো ভুল হলে তাকে এ ব্যাপারে সতর্ক করার পর সংশোধন হলে তো আলহামদুলিল্লাহ। আর সংশোধন না হলে এ জন্য তার ওপর জোর-জবরদস্তি করা কিংবা শাসন করার কোনো অধিকার কারো নেই। তবে এ ব্যাপারে তাদের অভিভাবকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে। আর অধীনদের কেউ ভুল করলে শাসনের অধিকার তার অভিভাবকদের রয়েছে। যেমন মনিব তার গোলামের, পিতা তার সন্তানের, স্বামী তার স্ত্রীর এবং শিক্ষক তার ছাত্রের ভুল সংশোধনের জন্য শরীয়তের নির্দিষ্ট সীমার  ভেতরে শাসন করার অধিকার রাখে। কেননা, প্রত্যেক ব্যক্তি তার অধীনদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। অধীনদের কেউ ভুল পথে পরিচালিত হলে তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করা তার একান্ত কর্তব্য। এ দায়িত্ব পালনের জন্য নির্দিষ্ট সীমার ভেতরে তাকে প্রয়োজনে শাসন করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। এ জন্য নম্র ভাষায় বুঝানোর পরও অধীনদের কেউ তার ভুল সংশোধন না করলে প্রয়োজনে শাসন করে হলেও সে ভুল সংশোধনে বাধ্য করতে পারে। অভিভাবকরা এ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে  আল্লাহর দরবারে তাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে।

কাউকে কোনো ভুল করতে বা অন্যায় কাজে লিপ্ত হতে দেখলে সাধ্যমতো তাকে সে কাজ থেকে ফেরানোর চেষ্টা করা উচিত। তবে অন্যায় কাজে বাধা দিতে গিয়ে অহংকারবশত কাউকে হেয় করে বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘন করা কাম্য নয়। সাধ্যমতো অন্যায়ের প্রতিবাদ করা অবশ্যই আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। কিন্তু অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে শরীয়তের সীমা লঙ্ঘন হয় এমন কিছু করা উচিত নয়। তাহলে এটা তার জাহান্নামে প্রবেশের কারণও হতে পারে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসে শিক্ষণীয় একটি ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘বনী ইসরাইলের মধ্যে দুব্যক্তি ছিল। তাদের একজন পাপ কাজ করতো এবং অন্যজন সবসময় ইবাদতে লিপ্ত থাকতো। যখনই ইবাদতে রত ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে দেখতো তখনই তাকে খারাপ কাজ পরিহার করতে বলতো। একদিন সে তাকে পাপ কাজে লিপ্ত দেখে বললো, তুমি এমন কাজ হতে বিরত থাকো। সে বললো, আমাকে আমার রবের ওপর ছেড়ে দাও। তোমাকে কি আমার ওপর পাহারাদার করে পাঠানো হয়েছে? সে বললো, আল্লাহর কসম! আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করবেন না অথবা তোমাকে আল্লাহ জান্নাতে প্রবেশ করাবেন না। অতঃপর দুজনকেই মৃত্যু দিয়ে আল্লাহর নিকট উপস্থিত করা হলে তিনি ইবাদতগোজারি ব্যক্তিকে প্রশ্ন করলেন, তুমি কি আমার সম্পর্কে জানতে? অথবা তুমি কি আমার হাতে যা আছে তার ওপর ক্ষমতাবান ছিলে? আর পাপীকে বললেন, তুমি চলে যাও এবং আমার রহমতে জান্নাতে প্রবেশ করো। আর অপর ব্যক্তির ব্যাপারে তিনি বললেন, তোমরা একে জাহান্নামে নিয়ে যাও। আবু হুরায়রা (রা) বলেন, সেই মহান সত্তার কসম! যার হাতে আমার জীবন! সে এমন উক্তি করেছে যার ফলে তার দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ই বরবাদ হয়ে গেছে।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৪৯০১)

সারকথা হলো কারো কথায় বা কাজে কোনো ভুল হলে অত্যন্ত নম্র ভাষায় ভালোবাসা ও হিকমাতের সাথে তার সে ভুলের ব্যাপারে সতর্ক করা উচিত। এ ক্ষেত্রে চুপ থাকা ঠিক নয়। কারো ভুলের ব্যাপারে সতর্ক করার পরও যদি সে ভুল সংশোধনে আগ্রহী না হয় এবং তার কথা ও কাজের দ্বারা অন্য মানুষ বিভ্রান্ত হওয়ার আশংকা থাকে তাহলে তার ভুলের ব্যাপারে অন্যদেরও সতর্ক করতে কোনো দোষ নেই। আর কেউ যত বড় পাপীই হউক না কেন তাকে হেয় করে অনুচিত কথা বলা ঠিক নয়। অন্যের ভুলের জন্য গালিগালাজ করা, ঝগড়া-বিবাদ করা, অনর্থক তর্ক-বিতর্ক করা, ঘৃণা বিদ্বেষ প্রকাশ করা সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করা উচিত। কারণ এমনো হতে পারে এসব কারণে আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে পাকড়াও করতে পারেন। আর পাপী ব্যক্তির কোনো নেক আমলের বদৌলতে আল্লাহতায়ালা তার পাপ ক্ষমা করে জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারেন। তাই অন্যের ভুল সংশোধনের ব্যাপারে আমাদের নম্রতা অবলম্বন করা উচিত। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে দীনের সহিহ বুঝ দান করুন।

 

লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads