ধর্ম

প্রতিবেশীর হক আদায়ের গুরুত্ব

  • প্রকাশিত ৯ জানুয়ারি, ২০২১

মো. হুসাইন আহমদ

 

 

 

মানুষ একা নয়, সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধতা মানুষের স্বভাবজাত চাহিদা। সমাজের সংজ্ঞা এভাবে দেওয়া হয়, পরস্পরের সহযোগিতায় অবস্থানকারী মানবসংঘকে সমাজ বলে। সমাজে মানুষ একে অপরকে সহযোগিতা করে। মানুষের এ পারস্পরিক সহযোগিতার সূচনা হয়েছিল হজরত আদম (আ.) ও হজরত হাওয়া (আ.)-এর সময়কাল থেকেই। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে মানুষের সামাজিক পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে মানুষের সামাজিক চাহিদা ও প্রয়োজন। তাই ইসলাম পরস্পরের মাঝে যথাযথ হক আদায়ের ব্যাপারে অনেক গুরুত্ব দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয় (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-১৮৩) অন্যত্র প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, জিবরাঈল (আ.) আমাকে প্রতিবেশীর হক সম্পর্কে এত বেশি তাগিদ করতেন যে, এক পর্যায়ে আমার মনে হয়েছে! হয়তো অচিরেই প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকারী সাব্যস্ত করা হবে।’ (বুখারি, হাদিস নং-২/৮৮৯)

আশপাশের মুসলিম, অমুসলিম যে কোনো ধর্মাবলম্বীর অনুসারী হোক না কেন-নেক বান্দা, ফাসেক, বন্ধু, শত্রু, ভিনদেশি, স্বদেশি, উপকারী, অনিষ্টকারী, আত্মীয়, অনাত্মীয়, কাছের বা দূরের সবাই প্রতিবেশীর অন্তর্ভুক্ত। শুধু পাশের ঘরের লোকেরাই প্রতিবেশী তা নয়। প্রতিবেশী বিভিন্নভাবে হতে পারে। একজনের জমির পাশে আরেকজনের জমি থাকলে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পাশে আরেকজনের প্রতিষ্ঠান থাকলে তারাও পরস্পর প্রতিবেশী। কোনো বাহনে কোথায় যাওয়ার সময়ে যাত্রীরাও কিছু সময়ের জন্য একে অপরের প্রতিবেশী। মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘তোমার ঘরের চারপাশে ৪০ ঘরের অধিবাসীরা তোমার প্রতিবেশী।’

 

 

প্রতিবেশী তিন প্রকার

 

১. অনাত্মীয় বিধর্মী প্রতিবেশী : এরা প্রতিবেশী হওয়ার হক পাবেন। ২. মুসলিম প্রতিবেশী : এরা মুসলিম এবং প্রতিবেশী হিসেবে দুই দিক থেকে হক পাবেন। ৩. মুসলিম আত্মীয় প্রতিবেশী : এরা প্রতিবেশী, মুসলিম এবং আত্মীয় হিসেবে তার হক পাবে। ইসলামে আত্মীয়-স্বজনের জন্য বিশেষ হক রয়েছে। যে ব্যক্তি আত্মীয় -স্বজনের হক আদায় করে না এবং তাদের বঞ্চিত করে সে ব্যক্তি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মত নয়। প্রতিবেশীর বিপদে সহায়তা করা, অসুখ হলে প্রয়োজনে সেবা করা বা চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেওয়া, মারা গেলে একে অন্যের দাফন ও জানাজায় অংশ নেওয়া, প্রতিবেশীর কষ্ট হয় এমন কোনো কাজ না করা ইত্যাদি বিষয়গুলো একজন উত্তম প্রতিবেশী হিসেবে খেয়াল রাখা জরুরি।

হজরত আলী (রা.) হক আদায়ের তাগিদ দিয়েছেন। একবার এক ব্যক্তি ছাগল জবেহ করে ছাগলের চামড়া ছাড়াচ্ছিল। তখন হজরত আলী প্রতিবেশীদের মাংস বণ্টনের কথা বলেন এবং বণ্টন কাজ এক ইহুদির বাড়ি হতে ক্রমানুসারে শুরু করতে বলেন। কাজেই, ইসলামে প্রতিবেশী যে ধর্মের হোক না কেন, কোনো প্রতিবেশী যেন অভুক্ত না থাকে সে ব্যাপারে সজাগ থাকার নির্দেশনা দেয়। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যে তার ভাইয়ের প্রয়োজন পুরা করে আল্লাহ তার প্রয়োজন পুরা করেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-২৪৪২) অন্য হাদিসে এসেছে, একবার একলোক রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আল্লাহর নবী! অমুক মহিলা অধিক পরিমাণে নামাজ, রোজা ও দান-খয়রাত করে কিন্তু সে আপন প্রতিবেশীদেরকে নিজের জবানের দ্বারা কষ্ট দেয় অর্থাৎ গালিগালাজ করে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সে দোজখে যাবে। এরপর সে লোক আবার বললেন, হে আল্লাহর নবী! অন্য এক মহিলা নফল নামাজ, নফল রোজা ও দান-খয়রাত কম করে। তার দান-খয়রাত পনীরের একটি টুকরোর চেয়ে বেশি নয়। কিন্তু নিজের প্রতিবেশীদের জবান দ্বারা কষ্ট দেয় না। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সে জান্নাতে যাবে।’ (মুসনাদে আহমদ)

হজরত আয়েশা (রা.) তাহাজ্জুদের নামাজের সময় প্রতিবেশীদের জন্য সবার আগে  দোয়া করতেন। মা ফাতেমা (রা.) যখন তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তেন তখন প্রতিদিন ইমাম হাসানের (রা.) ঘুম ভেঙে যেত। ইমাম হাসান বিছানা ছেড়ে অজু করে নামাজে মায়ের সঙ্গে শামিল হতেন। তিনি দেখতেন মা ফাতেমা (রা.) কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে দোয়া করছেন প্রতিবেশীদের জন্য। শিশু ইমাম হাসান কয়েকদিন দেখে একদিন মাকে কৌতুহল মন নিয়ে প্রশ্ন করেন, ‘মা, মোনাজাতের সময় আপনি কেবল পাড়া-প্রতিবেশীর জন্য মঙ্গল কামনা করেন। আপনার নিজের জন্য বা আমাদের কারো জন্য তো দোয়া করেন না কেন? মা ফাতেমা (রা.) বললেন, জেনে রেখো, প্রতিবেশীর হক আগে। প্রতিবেশীর মঙ্গল কামনা করলে, তাদের খোঁজখবর নিলে আল্লাহরাব্বুল আলামীন খুব খুশি হন। তাই আমি ওদের জন্য দোয়া করি। আমি তোমাদের জন্যও দোয়া করি। তবে প্রতিবেশীর অধিকার আগে, এটা মনে রাখবে।’

একজন প্রতিবেশী সম্পর্কে তার প্রতিবেশীই সবচেয়ে ভালো জানেন। হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘এক ব্যক্তি মহানবীকে বললো, হে আল্লাহর রাসুল! কীভাবে জানবো, ভালো কাজ করছি নাকি মন্দ কাজ করছি? মহানবী বললেন, যখন প্রতিবেশীদের বলতে শুনবে যে, ভালো কাজ করছো তখন মূলতই ভালো কাজ করছো। আর যখন তাদের বলতে শুনবে, খারাপ কাজ করছো তখন মূলতই খারাপ কাজ করছো।’ একজন প্রকৃত মুমিন বা মুসলিম হতে হলে ইসলামের সব নির্দেশনা মেনে চলা খুবই প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে প্রতিবেশীর ওপর দায়িত্ব ও কর্তব্য মেনে চলাও একান্ত জরুরি। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে প্রতিবেশীর হক আদায়ের তাওফিক দান করুন। আমিন!      

 

লেখক : শিক্ষার্থী, তাকমিল (মাস্টার্স), দারুস-সুন্নাহ মাদরাসা, টাংগাইল

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads