বিশ্বায়নের এই যুগে প্রযুক্তির আশীর্বাদের ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে আমাদের দৈনন্দিন জীবন। যানবাহন, স্বাস্থ্য খাত, তথ্যের উন্নয়ন থেকে শুরু করে যোগাযোগ, প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আমরা এগিয়ে গেছি বহু গুণ। আর সেই জায়গায় শিক্ষা খাত পিছিয়ে থাকবে, এ যেন কল্পনার বাইরে।
প্রযুক্তির সঙ্গ নিয়ে উন্নয়নের অংশীদার করতে শিক্ষা খাতও পৌঁছে গেছে উচ্চতার শিখরে। এখন দেশের যেকোনো প্রান্তে বসেই রাজধানী ঢাকার মুই শিক্ষা পাওয়া যাচ্ছে শুধু ইন্টারনেট ব্যবহার করে। আক্ষরিক (টেক্সট), মাল্টিমিডিয়া (অডিও-ভিডিও) ভিজুয়ালের মাধ্যমে অথবা সরাসরি ভিডিও স্ট্রিমিং করে পাঠদান দেওয়া হচ্ছে। একাডেমিক শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষার পাশাপাশি পেশাদারি শিক্ষার পাঠদানও এখন অনলাইনে নেওয়া হচ্ছে। এমনকি পরীক্ষা নেওয়া এবং ফল প্রকাশ করা হচ্ছে ইন্টারনেটে। এ ছাড়া দেশে গড়ে উঠেছে অনলাইন লাইব্রেরিও। ইন্টারনেট বিপ্লবে শিক্ষা খাতের নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, উদ্যোক্তার অংশগ্রহণ নিয়েই বাংলাদেশের খবরের আজকের আয়োজন। বিস্তারিত লিখেছেন এম. রেজাউল করিম
টেন মিনিট স্কুল : ইন্টারনেট ব্যবহার করে একাডেমিক শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে টেন মিনিট স্কুল। ২০১৫ সালে শুরু হওয়া এই প্ল্যাটফর্মটিতে পুঁথিগত বিদ্যা নিয়ে গতানুগতিক শিক্ষাদানের কৌশলের বাইরে গিয়ে নানা ধরনের অভিনব নিয়মে ও সৃজনশীলতার সমন্বয়ে পাঠদান করেন এখানকার শিক্ষকরা। গতানুগতিক পাঠদানের বাইরে হওয়ায় খুব দ্রুত সময়েই শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই প্ল্যাটফর্ম।
টেন মিনিট স্কুলে ক্লাস ওয়ান থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং পর্যন্ত সব ধরনের ক্লাস নেওয়া হয়। শুরুর দিকে রেকর্ড করে ভিডিও কন্টেন্ট আপলোড করা হলেও শিক্ষা কার্যক্রমকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিতেই যাত্রা শুরু হয়েছিল ফেসবুকে লাইভ ক্লাস নেওয়ার। এ ছাড়া জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসির প্রস্তুতি যেন সহজ হয়ে ওঠে তাই স্কুলটির ওয়েবসাইটে রয়েছে প্রতিটির জন্য আলাদা সেকশন। ভিডিও কন্টেন্ট ছাড়াও প্ল্যাটফর্মটিতে শিক্ষামূলক ব্লগ, ইন্টার্যাকটিভ ভিডিও, স্মার্টবুক, কুইজসহ দক্ষতা উন্নয়ন (স্কিল ডেভেলপমেন্ট) এবং পেশাদার কোর্স (প্রফেশনাল কোর্স) নিয়েও নানা ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। তাই শিশু থেকে যুবক, একে একে সব বয়সের মানুষই শিক্ষার্থী হয়ে উঠছে এই ডিজিটাল লার্নিং প্ল্যাটফর্মের।
টেন মিনিট স্কুলের বর্তমানে চারটি ফেসবুক গ্রুপ আছে, যেখানে আলাদা করে শিক্ষামূলক কন্টেন্ট পোস্ট করা হয়। এতে শিক্ষার্থীরা তাদের কাঙ্ক্ষিত পোস্টগুলো সহজেই পেতে পারে। গ্রুপগুলো হচ্ছে, টেন মিনিট স্কুল লাইভ, টেন মিনিট স্কুল স্কিল ডেভেলপমেন্ট ল্যাব, টেন মিনিট স্কুল ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ ক্লাব, টেন মিনিট স্কুল লাইভ বিবিএ, এমবিএ, রিক্রুটমেন্ট টেস্ট প্রিপারেশন।
জাগো ফাউন্ডেশনের অনলাইন স্কুল : ইন্টারনেট সুবিধা ব্যবহার করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষা ব্যবস্থা পৌঁছে দিচ্ছে এমন কথা বলার পর যে নামটি সবার আগে মুখে চলে আসবে তা হচ্ছে জাগো ফাউন্ডেশনের নাম। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা নিয়ে কাজ করে এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি। ২০০৭ সালে ঢাকার রায়েরবাজারে এই ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম শুরু হয়। আর ২০১১ সালে গাজীপুরের টঙ্গীতে প্রথম অনলাইন স্কুল চালু করে জাগো ফাউন্ডেশন। এরপর বনানীর কড়াইল বস্তি। এভাবেই অনলাইন স্কুলে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে চলতে থাকে ঢাকার দূরবর্তী একটি গ্রামের ক্লাসরুমে বসে থাকা শিশুদের সঙ্গে ঢাকায় থাকা মানসম্মত শিক্ষকদের সংযোগ। এরপর ঢাকার গণ্ডি পেরিয়ে ২০১২ সালে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী, ২০১৩ সালে গাইবান্ধার মগটু, ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে অনলাইন স্কুলের সংখ্যা। গাজীপুর, রাজশাহী, গাইবান্ধা, বান্দরবান, মাদারীপুর, লক্ষ্মীপুর, টেকনাফ, দিনাজপুর, রংপুর ও হবিগঞ্জে মোট ১০টি অনলাইন স্কুল পরিচালিত হচ্ছে।
কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকার রায়েরবাজারে স্থাপিত স্টুডিও থেকে সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সিসকোর ‘ওয়েবয়েক্স’ নামের সফটওয়্যারের মাধ্যমে স্কাইপের সহায়তায় লাইভ ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ক্লাস নেন অনলাইন শিক্ষক। অনলাইন শিক্ষক শুধু সরাসরি পাঠই দেন না, পরীক্ষাও নেন অনলাইনে থেকেই। তবে প্রতিটি অনলাইন স্কুলেই স্থানীয় দুজন শিক্ষক থাকেন স্কুল ও শিক্ষার্থীদের দেখাশোনার জন্য।
শিক্ষা খাতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (আইসিটি) সফল ব্যবহার করায় ‘আইসিটি ইন এডুকেশন বিভাগ’-এ ‘ইউনেস্কো কিং হামাদ বিন ইসা আল খলিফা’ পুরস্কারও অর্জন করেছে জাগো ফাউন্ডেশন। সংগঠনটির এই অনলাইন স্কুল পরিচালনায় সহায়তা করছে মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন ও ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান অগ্নি সিস্টেমস।
প্রোগ্রামিং নিয়ে আইসিটি বিভাগের ই-শিক্ষা ডট নেট : কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শিক্ষাকে সহজ ও কার্যকর করতে বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অঙ্ক, ইংরেজি, বিজ্ঞানের পাশাপাশি প্রোগ্রামিং এবং কোডিংয়েও দক্ষ করে গড়ে তুলতে ই-শিক্ষা ডট নেট নামের একটি ওয়েবসাইট তৈরি করেছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ (আইসিটি ডিভিশন)। এখানে থাকছে হাতেকলমে প্রোগ্রামিং শেখার মাল্টিমিডিয়া ভিত্তিক ইন্টারেক্টিভ শিক্ষাকেন্দ্র, কোডমার্শাল আইটি সিস্টেমস লিমিটেডের বিশ্বমানের স্বয়ংক্রিয় জাজিং প্রযুক্তির মাধ্যমে অনুশীলনীর সমাধান যাচাইকরণ, বিশ্বমানের অনলাইন কোড ল্যাবে প্রোগ্রামিং প্র্যাকটিসের সুবিধা এবং কন্টেন্ট রেকমেন্ডেশন প্রযুক্তির মাধ্যমে সহায়তা ও দিকনির্দেশনা।
এই প্ল্যাটফর্মে মূলত বেসিক সি প্রোগ্রামিং ভাষার মাধ্যমে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের বেসিক শেখানো হয়। এই কোর্স সি প্রোগ্রামিং ভাষার একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভূমিকা প্রদান করবে এবং আপনাকে দেবে আধুনিক প্রোগ্রামিং ভাষায় দক্ষতা অর্জনের দিকনির্দেশনা। সি উইনিক্স, এমবেডেড প্রসেসর এবং মাইক্রো-কন্ট্রোলারের মূল চালিকাশক্তির ভাষা যাকে বলা হয় প্রোগ্রামিংয়ের লিংগা ফ্রান্সা (Lingua Franca)। সি প্রোগ্রামিং দক্ষতা আপনাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ও এম্বেডেড সিস্টেম ইলেক্ট্রনিক্স কোম্পানিতে কাজ করতে সহায়তা করবে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল এবং প্ল্যাটফর্মটি তৈরিতে কারিগরি সহায়তা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে মুক্ত সফটওয়্যার লিমিটেড।
অনলাইনে সাংবাদিকতা শিক্ষা : তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার ঘটিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি হচ্ছে, সেই অগ্রগতির ধারাকে গণমাধ্যমের ক্ষেত্রেও বজায় রাখতে অনলাইনে সাংবাদিকতা শেখার সুযোগ চালু করেছে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) এবং একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রাম। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষার্থীসহ যেকোনো নাগরিক অনলাইনে সাংবাদিকতার এই কোর্সগুলোর মাধ্যমে নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করতে পারবেন।
২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট সাংবাদিকতা বিষয়ক ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্মের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। ‘অনলাইন সার্টিফিকেট কোর্স অন জার্নালিজম’ শীর্ষক সাংবাদিকতা বিষয়ক চার মাস মেয়াদি চারটি অনলাইন সার্টিফিকেট কোর্স দিয়ে চালু হয় এই অনলাইনে সাংবাদিকতা প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। এ ছাড়া আছে সাংবাদিকতায় বেসিক কোর্স, টেলিভিশন সাংবাদিকতা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও উন্নয়ন সাংবাদিকতা শীর্ষক চারটি কোর্স। এসব প্রশিক্ষণে সাংবাদিকসহ আগ্রহী শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে কোর্সে অংশ নিতে পারবেন। কোর্স শেষে শিক্ষার্থীদেরকে সনদপত্রও প্রদান করা হবে। বিস্তারিত জানা যাবে এই ঠিকানায় : https://pib.muktopaath.gov.bd
ইন্টারনেট লাইব্রেরি ‘আলোর পাঠশালা’ : প্রথাগত বই পড়ার পাঠক তৈরি করার জন্য গত ৩৫ বছর ধরে কাজ করে আসছে দেশের শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। তবে প্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান সময়ে সব বয়সী মানুষের কাছে বাংলা বই পৌঁছে দিতে সম্প্রতি অনলাইনে বই পড়ার কর্মসূচি চালু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিনামূল্যে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়তে পারবেন পাঠকরা।
‘আলোর পাঠশালা’ নামে এই অনলাইনে বই পড়া কর্মসূচির উদ্যোগে দেশ-বিদেশের পাঠকরা আপাতত প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব প্রকাশনার ৭২টি বই পড়তে পারবেন। অনলাইনে রেজিস্ট্রেশনের করে ইন্টারনেট সংযোগ থাকা ল্যাপটপ, ট্যাবলেট কম্পিউটার, ই-বুক রিডার অথবা মোবাইল হ্যান্ডসেটের মাধ্যমে বিনামূল্যে বইগুলো পড়তে পারবেন। এ ছাড়া চাইলেই পাঠকরা বইগুলো ডাউনলোডও করতে পারবেন।
এ ছাড়া দ্রুত সময়ে সঠিক, উপযোগী বিষয়ে শিক্ষা প্রদানে বিভিন্ন শ্রেণির পড়ালেখা ও পরীক্ষার ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছে আরো কিছু অনলাইন শিক্ষা পোর্টাল। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ডয়চে ভেলে, গুগল, ইন্টারনেট সোসাইটি ও আইএসআইএফ থেকে পুরস্কার পাওয়া শিক্ষক ডটকম। শিক্ষকের ভূমিকায় থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিরা কম্পিউটার বিজ্ঞান, পদার্থ, রসায়ন, প্রকৌশল, জ্যোতির্বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয় বাংলায় ক্লাস নিচ্ছেন এই প্ল্যাটফর্মে।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সালমান খানের তৈরি এই খান একাডেমির সব লেকচার বাংলা ভাষায় পাওয়া যাবে খান একাডেমি ডটকমে। আবার পাঠ্যপুস্তকের বিভিন্ন বিষয়ের অডিও ভিজ্যুয়াল টিউটোরিয়ালসহ স্কুলের সিলেবাস অনুযায়ী অধ্যায় ও টার্মভিত্তিক পরীক্ষা দিয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতির বিষয়টি সহজেই অনুধাবন করা যাবে সৃজনশীল ডটকমে।
এ ছাড়া উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাকের মতো আরো অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের দিকে এগিয়ে আসছে।