অনন্য হায়াৎ মামুদ

হায়াৎ মামুদ

সংরক্ষিত ছবি

ফিচার

অনন্য হায়াৎ মামুদ

  • প্রকাশিত ৭ জুলাই, ২০১৮

তুষার প্রসূন

ঘরে কি বাইরে, সমাজে কি রাষ্ট্রে সর্বক্ষেত্রে দু-একজন দিকনির্দেশকের প্রয়োজন হয়, যে বা যারা সামনের প্রতিকূলতা অতিক্রম করে হাসিমুখে মানুষদের পথ চলতে শেখায়, তেমনি একজন প্রাতিস্বিক হায়াৎ মামুদ। প্রায় ২৫ বছর হবে, তাকে একজন বৈয়াকরণ হিসেবে জানি। তার পাশাপাশি আর কারো নাম তেমন শোনা যেত না। অন্য যাদের নাম শোনা যেত, তাদের জনপ্রিয়তা অতটা নয়। দীর্ঘ সময় ধরে জিইয়ে রাখা মানুষটিকে স্বচক্ষে দেখেছি এবং সাক্ষাৎ পেয়েছি তা প্রায় চার বছর হয়ে গেল। তারপর থেকে শুরু আমার জ্ঞানের ভান্ডারে কিছু যোগ হওয়া। পড়াশোনা করে যে জ্ঞান অর্জন করেছি, তা বেশ হালকা মনে হতে থাকে। হাসতে হাসতে যে কতকিছু শেখা যায় তা আর কতজন বুঝতে পারে! চরম আড্ডাপ্রিয় এই পণ্ডিতের সঙ্গে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পুঁথিনিলয়-এ চাকরিসূত্রে কাছাকাছি কাজ করার সুযোগ হয়েছে বিধায় সব সময় আমি তাকে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করে নিজেকে ঋদ্ধ করেছি। ভুল বানানের কোনো কাগজ পেলে তিনি সেটা নির্ভুল না করা পর্যন্ত কাজ এগিয়ে নিতেন না কারণ ভুল কিছু সামনে রেখে কোনো কাজই এগোতে পারে না।  

গত চার বছরে তার এই পাণ্ডিত্যপূর্ণ জীবনের সার্বিক দিক নিয়ে কথা বলেছি, গল্প করেছি, আড্ডা দিয়েছি। কখনো অফিসে চা খেতে খেতে, কখনো তার বাসায় আড্ডায় আবার কখনো রিকশায় চলতে চলতে। হায়াৎ স্যারকে পেয়েছি সরলতার প্রতিমূর্তি হিসেবে কারণ সবার সঙ্গে তিনি শিশুর মতো মিশে যেতে পারেন। যারা তার কাছে আসেন, তারাই মুহূর্তে প্রিয় হয়ে যান, বন্ধু হয়ে যান। যার সঙ্গে তার একবার বন্ধুত্ব হয়েছে, তাতে আর কখনো ছেদ পড়েনি। তাহলে কী জাদু আছে এই মানুষটার মধ্যে? 

ছাত্রাবস্থায় প্রথম দিকে মনে হয়েছিল ‘বাংলা বানানের নিয়মকানুন’  এবং আমার পড়া স্যারের প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ ‘নষ্ট বঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্রের প্রব্রজ্য’। এই দুটি বই-ই তার রচনা। অনেক বছর পর জানতে পারি তিনি একাধারে যেমন বৈয়াকরণ-গবেষক বুদ্ধিজীবী অন্যদিকে কবি, প্রবন্ধকার, গবেষক, অনুবাদক ও একজন সফল সম্পাদক। এমনকি শিশুদের জন্য তার লেখা বই বেশ জনপ্রিয়। তার কাছের অনেক বন্ধু তাকে গল্প উপন্যাস লেখার কথা বলেছেন কিন্তু গল্প উপন্যাস যে তার দ্বারা হবে না, তা তিনি লেখক-জীবনের শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছেন। তিনটি কবিতাগ্রন্থ লিখতে লিখতে তিনি সম্পূর্ণ ডুব দিয়েছেন সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়। 

যারা তাকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন, তারা একটি কথাই বলেন, স্যার কখনো আমাদের সঙ্গে শিক্ষকসুলভ আচরণ করেননি। হাসিখুশি এবং নির্ভার হয়ে আমাদের শিখিয়েছেন। তিনি যা বোঝানোর তা বুঝিয়ে দেন যুক্তি সহযোগে, সেখানে কোনো দায়সারা ভাব নেই। তিনি সবাইকে দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়ে দিয়েছেন সফলতার হাত ধরতে হলে লেখাপড়ার কোনো বিকল্প নেই। স্যারের ব্যক্তিজীবন বেশ রবীন্দ্রপ্রভাবিত। ফলে তার জীবনযাপন পুরোটাই বাঙালিয়ানায় পূর্ণ। কানাডা, রাশিয়া, আমেরিকাসহ বেশ কয়েকটি দেশে তিনি ঘুরেছেন, থেকেছেন, চাকরি করেছেন কিন্তু বাবুয়ানায় তাকে কখনো পেয়ে বসেনি। প্রায়ই তিনি বলেন, ‘আমার এই পুরোনো ঢাকা বিশেষ করে গ্লোরিয়া ছেড়ে কোথাও বেশিদিন থাকতে ভালো লাগে না।’ গ্লোরিয়ার দীননাথ সেন রোডে স্যারের বাসা। তবে এটা শুধু স্যারের বাসাই নয়, এটা শত শত মানুষের ভালোবাসা। কত মানুষ যে এই বাসাটিকে তাদের অভিভাবকের বাড়ির মতো করে আশ্রয় পেয়েছেন, তার ঠিক নেই। স্যারের স্ত্রীও মানুষের প্রতি ভালোবাসায় কোনো কমতি রাখেননি। 

স্যারের স্ত্রীর প্রসঙ্গ যখন এলো, তখন একটি কথা না বললেই নয়। স্যারের খুব কাছের বন্ধু জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত এবং তার স্ত্রী পূরবী বসু সুদূর আমেরিকায় থাকেন। বাংলাদেশে এলে তারা তাদের শান্তিনগরের বাসায় ওঠেন। হায়াৎ স্যার সেখানে সস্ত্রীক আড্ডা দিতে চলে যান। আমিও সেখানে আড্ডার ছুতো ধরে কিংবা তাদের বইয়ের কাজের ছুতো ধরে তাদের বাসায় যাই। একদিন শুনি এই দত্ত দম্পতি হায়াৎ স্যারের স্ত্রীকে খুকু আর স্যারকে মণি বলে ডাকছেন। আর ঠিক তখনই আমার কানের মধ্যে ‘খুকুমণি’ শব্দটি খেলে গেল। স্যারকে জিজ্ঞাসা করলাম এমন মিল কেমন করে হলো? তিনি সেদিন তাদের দাম্পত্য বন্ধনের কথা অবলীলায় বলে গেলেন। মূল কথা হলো, স্যারের পিতৃপ্রদত্ত নাম মনিরুজ্জামান আর স্ত্রীর নাম ফিরোজা বেগম খুকু। যেহেতু তাদের হয়েছিল প্রেমের বিয়ে, ফলে তাদের হাত একসঙ্গে মিলে যাওয়ার পর তারা হয়ে যান খুকুমণি। তাদের এই দাম্পত্য জীবনের পঞ্চাশ বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে নির্বিঘ্নে। 

দুই বাংলাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমান পাঠকপ্রিয় এই মানুষের বন্ধুতালিকার কলেবর ঈর্ষণীয়। চলার পথে তিনি বন্ধু হিসেবে পেয়েছেন— জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, পূরবী বসু, হাসান আজিজুল হক, শামসুজ্জামান খান, দ্বিজেন শর্মা, রমণীমোহন দেবনাথ, খালেদ চৌধুরী (প্রভু), ননী ভৌমিকসহ অনেক গুণী জন। তাদের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময়। তার অনেক ছাত্র, সহকর্মী, বন্ধু ও স্বজনের সঙ্গে কথা হয়েছে কিন্তু কখনো কোনো অভিযোগ তার বিরুদ্ধে শোনা যায়নি। কেবল স্যারের ছেলে সৌম্য মামুদের কাছে শুনেছি, ডাক্তাররা তার চিকিৎসা করতে এসে বিব্রত হন। কেননা ডাক্তারের দেওয়া ব্যবস্থাপত্র তিনি একেবারেই আমলে নেন না। স্যারের মতে, নিয়ম মানতে গেলেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এত বয়সেও তিনি সদানন্দ শিশুর মতো চলাফেরা করেন।  

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে হায়াৎ স্যার যথেষ্ট কাজ করেছেন। উল্লেখ্য, ‘মৃত্যুচিন্তা : রবীন্দ্রনাথ  ও অন্যান্য জটিলতা’ ষাটের দশকে বেশ সাড়া ফেলেছিল। রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি তিনি কাজী নজরুল ইসলাম, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, লালন সাঁই, জসীম উদ্দীন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আবুজাফর শামসুদ্দীন, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সিকান্দার আবু জাফর, সোমেন চন্দ প্রমুখ লেখকের জীবনী রচনা করেছেন এবং তাদের অনেকের গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন। এসব লেখকের কাছ থেকে তিনি যেমন নিয়েছেন, তেমনি অর্জিত জ্ঞান ছড়িয়ে দিতেও পিছপা হননি। অপরদিকে বিদেশি সাহিত্য বাঙালি পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে। বিশেষ করে রুশ সাহিত্য। দীর্ঘদিন রাশিয়ার প্রগতি প্রকাশনে চাকরিসূত্রে কাজ করার সুবাদে রুশভাষা আয়ত্ত করে ম্যাক্সিম গোর্কি, তলস্তয়, গবেষণাগ্রন্থ গেরাসিম স্তেপানভিচ্ লিয়েবেদেফসহ অনেক লেখকের বইয়ের অনুবাদ তিনি করেছেন। আনন্দের বিষয়, রুশ থেকে বাংলা অনুবাদের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৯ সালে ঢাকাস্থ রুশ দূতাবাস থেকে পেয়েছেন পুিকন পুরস্কার।  

বাংলাদেশের সংস্কৃতি তথা বাঙালি জাতিসত্তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে তিনি কাজ করেছেন। তিনি বাংলা ভাষা তথা বাঙালি জাতিকে যে কতটা ভালোবাসেন, তা তার লেখা কিছু গ্রন্থের কথা উল্লেখ করলেই বোঝা যায়। তার লেখা গ্রন্থ অমর একুশে, কিশোর বাংলা অভিধান, বাঙালির বাংলা ভাষা ইদানীং, বাংলাদেশে মাতৃভাষার অধিকার, বাঙালি বলিয়া লজ্জা নাই ইত্যাদি তার ভাষাপ্রীতির এবং জাতির প্রতি দায়বদ্ধতার পরিচয় বহন করে। হায়াৎ স্যার শুধু লিখেই চুপ থাকেননি, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় অসহায় মানুষকে আশ্রয় দেওয়াসহ যুদ্ধ-পরবর্তীকালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ছিলেন সোচ্চার। হায়াৎ স্যার সম্পাদিত গ্রন্থ ‘যুদ্ধাপরাধীর শাস্তি চাই’ তার আপসহীন মনোভাবেরই প্রমাণ। এমনকি ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর লিখেছেন বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত কবিতা।  

স্যারের পাণ্ডিত্যপূর্ণ জীবনের আলোচনা থেকে আবার তার গ্লোরিয়ার বাড়িতে ফিরে আসি। দেখেছি এই মানুষের কাছে তার বাড়ির কাজে সহযোগিতা করা মেয়েটি তার ‘মা’ ডাক থেকে বঞ্চিত হয় না। দ্বাররক্ষী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় কোনো অতিথি— তার সামনে যে-ই আসুক, সবাই তার একই রকম ব্যবহার পেয়ে থাকেন। জীবনে চলার পথে মানুষের মুখ আর মুখোশ দুটি থাকতে নেই— স্যার তা সুনিপুণভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত স্যারকে ‘কেমন আছেন?’ প্রশ্ন করলে মিষ্টি হাসি দিয়ে তিনি সোজাসাপ্টা একটিই উত্তর দেন- ‘আমি সবসময় ভালো থাকি, তুমি কেমন আছো গো?’ মানুষকে কাছে টেনে আপন করে নেওয়ার এ এক মস্তবড় গুণ। তাকে কখনো মুখ গোমড়া করে থাকতে দেখা যায়নি। মানুষ মাত্রই তো দুঃখ-কষ্ট আছে কিন্তু স্যারের দুঃখ-কষ্ট কোথায়? হয়তো তিনি তা মানুষের মাঝে বিলাতে চান না। যেন নিজে সুখী থাকা এবং মানুষকে সুখী রাখাই তার প্রধান কাজ। 

কাজের ভেতর ডুবে থাকা এই মানুষটির জীবনে অর্জন কম নয়। তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে পিএইচ-ডি করেছেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন, শিশু একাডেমি পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, রবীন্দ্র পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে এবং সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। তবে এসব নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। পুরস্কার পাওয়ার ব্যাপারে তার একটিই উত্তর- ‘পুরস্কার পেলে কার না ভালো লাগে?’ স্যারের বইয়ের সংখ্যা একশ ছাড়িয়ে গেছে কিন্তু হয়তো স্যারের এসব নিয়ে ভাবার সময় নেই। তবে তিনি তো মানুষ, নিশ্চয়ই ভাবেন, তাহলে কী নিয়ে ভাবেন? উত্তর পেয়েছি, স্যার ভাবেন সত্যিকারের মানুষ হওয়ার কথা, সত্যিকারের মানুষ গড়ার কথা। বর্তমান সামাজিক, রাষ্ট্রীয় সমস্যা তাকে ভাবিত করে, কখনো কখনো তিনি সেসব মেনে নিতে পারেন না, আবার হতাশায় পশ্চাৎপদও হন না। তিনি বলেন, সমস্যা থাকলে প্রতিবাদ যেমন করতে হবে, অন্যদিকে একটি সুন্দর আদর্শিক জীবন যাপন করা থেকে কখনো বিচ্যুত হওয়া যাবে না।  

২০১৮ সালের জুলাই মাস চলছে। এই মাসের ২ তারিখে হায়াৎ স্যার (জন্ম ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ, হুগলী, পশ্চিমবঙ্গ) ৮০ বছরে পা রেখেছেন— ক্ষণজন্মা এই মানুষটির জন্মদিনে সবার পক্ষ থেকে প্রণতি জানাই। তার কলম যেন সবসময় আমাদের উজ্জীবিত রাখে। বর্তমান ভূলুণ্ঠিত মানবতার ঘুণেধরা সময়ে, অসাম্প্রদায়িক মনোভাবে দীক্ষা নিয়ে তরুণ সমাজ যেন হায়াৎ স্যারের মতো সত্যিকারের মানুষ হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে পারে। আমরা তার দীর্ঘজীবন কামনা করি। ৎ 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads