কুড়িল-পূর্বাচল লিঙ্ক রোডের (৩০০ ফুট রাস্তার) দুই পাশে কুড়িল থেকে বালু নদী পর্যন্ত ১০০ ফুট খাল খনন ও উন্নয়ন প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণে ন্যায্যমূল্য না দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, জেলা প্রশাসনের দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ ক্ষেত্রে স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন ২০১৭ এবং স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল অধ্যাদেশ ১৯৮২-এর ৮(এ) ধারা লঙ্ঘন করছেন। তারা চিহ্নিত জমির বাজারমূল্য অনেক কম করে ধরছেন। সেখানকার জমির দাম নির্ধারণে ২০১৬ সালের ৮ আগস্ট উচ্চ আদালত যে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা-ও আমলে নেওয়া হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে গত ২৮ জানুয়ারি ঢাকার জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত আবেদন করা হয়েছে। তবে এখনো এর কোনো প্রতিকার মেলেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকার জেলা প্রশাসক আবু সালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান বলেন, ‘অধিগ্রহণ হলে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে সরকার আইন অনুযায়ী এর ক্ষতিপূরণ দেয়। ২০১৭ সালের সর্বশেষ আইন অনুযায়ী অধিগ্রহণ করা এলাকার এক বছরের সব দলিল নিয়ে মূল্য ধরা হয়। আর আগের আইনে যদি কোনো মামলা চলমান থাকে, সেক্ষেত্রে পুরনো আইন অনুযায়ীই তা নিষ্পত্তি করা হয়। এর পরও যদি কোনো ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে ভুল হয়ে থাকে, সেটা আমরা সংশোধন করে দেব।’
জেলা প্রশাসকের কাছে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের করা আবেদন থেকে জানা যায়, এল এ কেস নং ২০/২০১৫-১৬-এর মাধ্যমে কুড়িল-পূর্বাচল লিঙ্ক রোডের উভয় পাশে (কুড়িল থেকে বালু নদী পর্যন্ত) ১০০ ফুট খাল খনন ও উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য জোয়ারসাহারা, বরুয়া, ডুমনি ও মস্তুল মৌজায় ব্যক্তিমালিকানাধীন ও খাস জমিসহ মোট ৯০ দশমিক ১৫৪৯ একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। এতে স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল অধ্যাদেশ, ১৯৮২-এর ৩ ধারার নোটিশ জারির পূর্ববর্তী এক বছরের চারটি মৌজার সাফকবলা দলিলের তথ্যের ভিত্তিতে অবাস্তব বাজারমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাবিত জমির পারিপার্শ্বিক এলাকার সমশ্রেণি ও সমসুবিধাযুক্ত (ভিসিনিটি) প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকার জমির প্রকৃত বাজারমূল্য এক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এটি স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল অধ্যাদেশ, ১৯৮২-এর ৮(এ) ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল অধ্যাদেশ ১৯৮২-এর ৮(এ) ধারা মতে, ‘The deputy commissioner shall take into account the average value, to be calculated in the prescribed manner of the properties of simillar description and with similar advantages in the vicinity during the twelve months preceding the date of publication of the notice under section 3.’
ভুক্তভোগীরা বলছেন, প্রায় ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ ৩০০ ফুট রোডটির গুরুত্ব বিবেচনা করে রাস্তা সংলগ্ন জমির গড় মূল্য নির্ধারণ করা হলে আইন অনুযায়ী প্রকৃত মূল্য নির্ধারিত হবে। অথচ রাস্তা থেকে ৩ কিলোমিটার ভেতরের জমির গড় মূল্যও এক্ষেত্রে ধরা হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকরা কোনো কোনো মৌজায় প্রকৃত মূল্যের অর্ধেকেরও কম এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০ ভাগের ১ ভাগ মূল্যও পাবেন না।
৩০০ ফুট রাস্তার পাশের জমি এখন মহামূল্যবান। ওই জমি ডুমনি, বরুয়া, মস্তুল ও জোয়ারসাহারা মৌজার কুড়িল-পূর্বাচল ৩০০ ফুট সড়কের সমান্তরালে অবস্থিত একই অ্যালাইনমেন্ট ও সমসুবিধাযুক্ত। সব ধরনের ইউটিলিটি সুবিধা থাকায় এর রয়েছে ব্যাপক বাণিজ্যিক ও আবাসিক চাহিদা। এই চার মৌজায় অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাবিত ভিটি/বাড়ি শ্রেণির জমির প্রকৃত মূল্য দেড় থেকে দুই কোটি টাকা। বরুয়া মৌজায় ডোবা-নালা প্রকৃতির প্রতি শতাংশ জায়গার দাম ১ লাখ ৯৩ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। অথচ বাস্তবে সেখানকার প্রতি শতাংশ জমির দাম কোটি টাকারও বেশি। ডুমনি মৌজায় ডোবা শ্রেণির প্রতি শতাংশ জায়গার জন্য ১ লাখ ৮৩ হাজার টাকা হারে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হচ্ছে। বাস্তবে ওই জমির বর্তমান বাজারমূল্য এর ৫০ গুণেরও বেশি। ৩০০ ফুট রাস্তার উভয় পাশে দুই বছর আগেও প্রতি কাঠা জমি দেড় থেকে দুই কোটি টাকায় কেনাবেচা হয়েছে। এখন দাম আরো বেড়েছে। এসব জমির অধিগ্রহণ মূল্য ধরা হয়েছে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা।
সংশ্লিষ্ট এলাকার জায়গার দাম নির্ধারণ বিষয়ে ২০১৬ সালের ৮ আগস্ট উচ্চ আদালতের দেওয়া নির্দেশে বলা হয়েছে, ‘As to why the respondent shall not be directed to access compensation in L/A Case no. 20/2015-16 pending before the respondent in compliance of section 8 of the Acquisition and Requisition of immovable property ordinance. 1982 read with immovable property acquisition manual, 1997 on taking consideration amongst others, the actual market value & natures/class of the property and the advantages such as adjacent 300 feet Kuril-Purbachal road.’ উচ্চ আদালতের ওই আদেশও আমলে নেওয়া হচ্ছে না। এটি আদালত অবমাননারই শামিল। এল এ কেস ২০/২০১৫-১৬-এর ক্ষতিগ্রস্ত জমি মালিকদের করা রিট আবেদনে (নম্বর ৯৭৫৯/২০১৬, ৯৭৬০/২০১৫-১৬) দেওয়া রায়ে অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাবিত জমির প্রকৃত বাজারমূল্য নির্ধারণে জমির পারিপার্শ্বিক এলাকার সমশ্রেণি ও সমসুবিধার (ভিসিনিটি) বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়ার নির্দেশ রয়েছে।
আদালতের আদেশে বলা হয়, ঢাকা জেলা প্রশাসক স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল অধ্যাদেশ, ১৯৮২-এর ৮(এ) ধারা এবং স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ অধ্যাদেশ, ১৯৯৭-এর সংশ্লিষ্ট ধারা অনুযায়ী বাজারমূল্য ও ভিসিনিটি নির্ধারণ করবে। এ ছাড়া সর্বশেষ স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন, ২০১৭ অনুযায়ী বাজারমূল্যের ওপর অতিরিক্ত ২০০ ভাগ যোগ করে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করতে হবে। কিন্তু আদালতের এ নির্দেশ মানছে না কর্তৃপক্ষ।