কার্টুন বাচ্চাদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি বিষয়। ছোটবেলা থেকেই কার্টুনের রঙিন সব চরিত্র আর তার কীর্তিকলাপ দেখে কথা বলতে না শেখা শিশুটিও আনন্দ পায় ভীষণ। এই আনন্দ পাওয়া একসময় নেশায় পরিণত হয়। অনেক বাবা-মা ও শিশুর পরিচর্যাকারীরা প্রায়ই এই আসক্তির সুযোগটা কাজে লাগাতে চান। শিশুকে খাওয়াতে বা তাকে বাসায় রেখে বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রেও টেলিভিশন, মোবাইল বা ল্যাপটপে কার্টুন ছেড়ে দিয়ে কাজটা সেরে নেন। বাচ্চার মন ভোলানোর জন্য এই পদ্ধতি বেশ কার্যকর হলেও কার্টুন দেখার এই নেশা শিশুর জন্য মোটেও ভালো নয়। কার্টুনের প্রতি এই আসক্তি বাচ্চাদের মানসিক, শারীরিক এবং সামাজিক বিকাশেও ক্ষতিসাধন করে থাকে। চলুন আজ আমরা জেনে নিই, কীভাবে কার্টুন বাচ্চাদের বিভিন্ন বিকাশে ঘাটতি তৈরি করে।
১. চোখের ক্ষতি
কার্টুনে আসক্ত শিশুরা দীর্ঘক্ষণ টিভি বা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থেকে কার্টুন দেখে থাকে। এ ছাড়া যেসব শিশু টিভিতে কার্টুন উপভোগ করে থাকে, তারা টেলিভিশনের খুব কাছে বসে কার্টুন দেখতে পছন্দ করে। ফলে এটি বাচ্চাদের চোখে প্রচণ্ডভাবে প্রভাব ফেলে। একটানা টিভি দেখার অভ্যাস আস্তে আস্তে বাচ্চাদের দৃষ্টি কমিয়ে দেয়। বাচ্চার চোখ দিয়ে পানি পড়া, দূরের জিনিস দেখতে সমস্যার মতো বিষয়গুলো ঘটে থাকে। যার ফলে অল্প বয়সেই শিশুর চোখে চশমা তুলে দিতে হয়।
২. বাচ্চাদের শারীরিক ব্যায়ামে ঘাটতি ঘটে
শিশুদের শারীরিক ব্যায়াম তার বিকাশের জন্য অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু এখন বাচ্চারা খেলাধুলার চেয়ে ঘরে বসে কার্টুন দেখতেই বেশি পছন্দ করে। এতে শিশুর অঙ্গ সঞ্চালনের দক্ষতা বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। অভিভাবকদের বুঝতে হবে যে, বাইরে বেরুলে বাচ্চারা প্রকৃতির সৌন্দর্য অনুভব করতে পারে এবং এই অনুভূতি বাচ্চাদের প্রকৃতির আরো কাছে নিয়ে যায়। শারীরিক বিকাশে ঘাটতি কিন্তু মানসিক বিকাশেও অবনতি ডেকে আনে। বাচ্চারা ঘরেই বসে টিভি বা মোবাইলে কার্টুন দেখলে তাদের শারীরিক পরিশ্রম না হওয়ার ফলে তাদের বেড়ে উঠতেও বাধা পড়ে।
৩. বাচ্চারা কার্টুন দেখতে না পেলে খেতে চায় না
অনেক মা বাচ্চাদের কার্টুন দেখিয়ে মন ভুলিয়ে খাওয়ান। বাচ্চাদের এই অভ্যাস করানো কিন্তু একদমই উচিত নয়, কারণ অভ্যাস হয়ে যাওয়ার কিছুদিন পর দেখা যায় যে তারা কার্টুন না দেখতে পেলে খেতেই রাজি হচ্ছে না। এর ফলে বাচ্চাদের খাওয়ার অভ্যাসও চলে যায়।
৪. বাচ্চাদের সামাজিকতা শিক্ষায় প্রতিবন্ধক
সারাদিন বাচ্চারা একা থেকে কার্টুন দেখতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এর ফলে তারা নতুন বন্ধু পাতানো বা অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মিশতেও চায় না। অন্য কোনো বাচ্চার সঙ্গে দেখা বা বন্ধুত্ব না করলে বাচ্চারা অন্যদের সঙ্গে খেলার আনন্দই বুঝতে পারে না। আগেও যেমন লিখেছি, বাচ্চারা অন্যদের দেখে শেখে। অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে যদি দেখাই না হয়, তাহলে অন্য বাচ্চাদের থেকে নতুন কিছু শিখতে পারে না শিশুরা। এর ফলে শিশুদের মানসিক বিকাশেও ঘাটতি ঘটে।
৫. বাচ্চাদের ভাষা শিক্ষায় প্রভাব ফেলে
৪ বছরের নাজিয়ার কাছে তার হাতের পুতুল চেয়ে রীতিমতো অবাক হয়ে যেতে হলো মায়ের। নাজিয়া উত্তর দিল, ‘ঠিক হ্যায় লে যাও।’ মায়ের বুঝতে আর বাকি রইল না এর পুরোটাই হিন্দি কার্টুন দেখেই শিখেছে। নাজিয়া এখন অনেক কথাতেই সাবলীল ভাবে হিন্দি শব্দ ব্যবহার করছে। অতিরিক্ত কার্টুন দেখলে বাচ্চারা তাদের প্রিয় কার্টুনের চরিত্রদের মতোই কথা বলতে শেখে। কোনো কথার উত্তর দিতে হলে তারা তাদের কার্টুনের চরিত্রের মতো করে উত্তর দেয়। অনেক সময় তারা বিভিন্ন শব্দ করেও উত্তর দেয়, যা তারা কার্টুন দেখে রপ্ত করে থাকে। স্বাভাবিকভাবে কথা বলার থেকে এই অভ্যাসটি বাচ্চাদের মানসিক বিকাশের অবনতি ঘটায়।
৬. আক্রমণাত্মক মনোভাব সৃষ্টি করে
কার্টুন শিশুদের মানসিক বিকাশের ও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কার্টুন দেখার আরেকটি ক্ষতিকারক দিক হলো কার্টুনের অনেক দৃশ্যতে হিংসা, মারপিট এবং মিথ্যা বলা দেখানো হয়। এতে শিশুটি খুব সহজেই এই নেতিবাচক বিষয়গুলো আত্মস্থ করে ফেলে। কার্টুন চরিত্রগুলোর মারামারি এবং বিজয়ী চরিত্রটিকে নিয়ে অন্যদের বাহ্ বাহ্ দেওয়া দেখে শিশুটিও উৎসাহিত হয়।
কার্টুনের এই প্রভাবটি মারাত্মক। তাই অভিভাবকদের উচিত বাচ্চাদের কার্টুন দেখার অভ্যাস আস্তে আস্তে কমিয়ে দেওয়া। বাচ্চাদের কার্টুন দেখার অভ্যাস একদমই উপকারী নয়। বরং এই অভ্যাস অজান্তে বাচ্চাদের অনেক ক্ষতিই করে দেয়। তাই আমাদের উচিত বাচ্চাদের বাড়ির বাইরে নিয়ে গিয়ে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেলানো এবং ছোটদের ভালো গল্পের বই পড়ানোর অভ্যাস করানো, যাতে তাদের মানসিক বিকাশে উন্নতি হয়।
ফারজানা বীথি