বড় বিল্ডিংটার পার্কিংয়ে গাড়িটা রেখে গিয়ে ঢুকে পরলাম সামনের এনট্র্যান্সে । আমার সাথে আমার বন্ধু এবং আর তার স্ত্রী, যে কিনা আমারও বন্ধু এবং আমার বন্ধুরও প্রাক্তন বন্ধু ওরফে ক্লাসমেট । বিকাল ৬টা বেজে গিয়েছিলো বিধায় সামনের কাচের দরজা লক ছিলো । কি করবো বুঝতে পারছিলাম না, দরজাটা ধরে একটু নাড়াচাড়া করলাম, নাহ, খুললো না । চারিদিকে তাকাচ্ছি, একটু কিংকর্তব্যবিমুঢ় । কাচের ভিতর দিয়ে বিল্ডিঙের ভিতরে অবস্থিত বিরাট খোলা আঙ্গিনা দেখা যাচ্ছে । চারিদিক কাচ দিয়ে ঘেরা, প্রচুর আলোর সমাগম, উজ্জ্বলতায় কোন কার্পণ্য নেই । বিকাল বেলার মোলায়েম অলস হলুদ রোদ এসে পড়েছে ওই বিশাল আঙ্গিনার মেঝেতে । ঝকঝকে আলোকময় বিকাল তবু কোথাও কোন মানুষের আনাগোনা নেই, কেমন বিষণ্ণতায় ভরা ওই ফ্রন্ট ডেস্কের পুরো এলাকাটা । কেমন যেন জানান দিয়ে যাচ্ছে করুন কোন ব্যাথার সুর! জানিনা কেন আমার এমন মনে হলো !
এক.
হঠাৎ করে কোন কিছু না জানিয়েই খুলে গেলো সামনের কাচের দরজা, হয়তো কেউ ক্যামেরায় আমাদের দেখতে পেয়েছে । ঢুকে পরলাম ভিতরে । বিশাল একটা আঙ্গিনা, কিন্তু কেউ নেই । একবার বাঁয়ে তারপর ডানে তাকালাম, কাউকে দেখলাম না । হটাত বেশ দূরে চোখ পড়লো, বেশ বয়স্ক একজন মহিলা ওয়াকার নিয়ে খুব স্লথ গতিতে হেটে হেটে এগিয়ে আসছেন, মাথাটা মাটির দিকে দিয়ে খুব ধীর গতিতে হাঁটছেন । আমি ওনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম নিমগ্ন চিত্তে, ইতিমধ্যে আমার বন্ধু বাঁয়ে ঘুরে হাটতে শুরু করেছে । সম্বিত ফিরে পেয়ে ওদের ফলো করলাম । একটু এগোতেই হাতের বাঁয়ে আরেকটা বেশ বড় আঙ্গিনা পড়লো । বেশ কয়েক জোড়া সোফা রাখা ওখানে । পানির একটা ফাউন্টেন আছে । চারিদিকে কাচ দিয়ে ঘেরা তাই দেখা যাচ্ছে রাস্তা অবধি । চোখে পড়লো দুজন মানুষ পাশাপাশি হুইল চেয়ারে বসে আছে । একজন মহিলা, একজন পুরুষ । আমাদের পায়ের আওয়াজ পেয়ে আমাদের দিকে তাকালেন ওরা । বয়স হবে ৮০/৮৫ । দুজনই নীরব, মুখে কোন কথা নেই, চোখে কোন ভাষা নেই, এক্সপ্রেশনলেস অভিব্যাক্তি । দুজনই চুপ করে বসে আছেন, কেউ কারো সাথে কথাও বলছেন না, ওনাদের বলার আর কিছুই নেই, জীবনে যা বলার ছিলো সবই প্রায় বলা হয়ে গিয়েছে, এখন শুধু চেয়ে দেখা। শোনারও কিছু নেই, কারন শোনার পরও যেহেতু বলার কিছু থাকেনা তাই ওনারা শুনতেও বোধহয় আর ইন্টারেস্টেড না । এখন শুধুই চেয়ে থাকা একটু কিছু দেখার আশায় ।
দুই.
আমার বন্ধুর বউ এর বাবা মা আজ থেকে ৫ বছর আগে এদেশে এসেছিলেন ঘুরতে দুমাসের জন্য । ঠিক ৫ বছর আগে ২০১৩ এর ১৮ই জানুয়ারিতে ছিলো ওনাদের ৫১ বছর বিবাহ বার্ষিকী । বন্ধুরা ওনাদের সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য একটা সারপ্রাইজ পার্টির আয়োজন করে, অনেককে দাওয়াত দেয় । ওনারা একটু মার্কেটে যাওয়ার ফাঁকে সবাই বাসায় এসে বাসাটাকে সাজিয়ে গুজিয়ে সবাই অপেক্ষা করতে থাকে । ওনারা ফিরে এসে এতবড় আয়োজন দেখে ভীষণ খুশি হন। আনন্দের অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ে দু’চোখ দিয়ে। অনেক আনন্দ হয়, খাওয়া দাওয়া হয় । সবকিছুর পর সবাই এক সাথে বসেন ওনাদের সামনে । একজন জানতে চানঃ
খালাম্মা, আমাদের কি একটা বিষয় বলবেন, আপনারা এখন যেখানে এসে দাঁড়িয়েছেন সারাজীবনের অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে, আপনাদের ওই জায়গা থেকে আমাদেরকে কেমন দেখছেন এবং আমাদেরকে কি বলার আছে এবং আপনাদের এই ৫১ বছরের ভালবাসার গল্প শুনতে চাই ।
খালাম্মাঃ আমার এই ৬৭ বছরের জীবনে আজকে আমি একটা কথাই বলতে চাই , আমি এ জীবনে যা চেয়েছি, তাই পেয়েছি । তোমাদের খালুজান আজ পর্যন্ত আমার কোন স্বাদ-আহ্ললাদ অপূরণ রাখেন নাই, আমাকে সবভাবে সাপোর্ট করছেন, আমার লেখাপড়া, আমার সাহিত্য কর্ম, আমার ক্যারিয়ার, সব ব্যাপারেই তার সবচাইতে বড় অবদান । আজকে আমি একজন পরিপূর্ণ মানুষ যার আর কিছুই চাওয়ার নেই ।
শুধু এই কথাটা বলেই হটাত করে খালাম্মা সোফার একধারে এলিয়ে পড়েন এবং বলতে থাকেনঃ
এই আমার কি হলো, আমার বা হাতটা এরকম কেন করছে, আমার হাতটা গেলো ।
এই বলতে বলতে খালাম্মা চিৎকার করতে থাকেন এবং সঙ্গে গল গল করে বমি শুরু হয় এবং বমিতে ভেসে যান । 911 কল করা হয়, ৩ মিনিটের মধ্যে চলে আসে অ্যামবুলেন্স, নিয়ে যায় হসপিটাল । ওখানে নেয়ার পর ওনার মাথায় বড় একটা সার্জারি হয় । জানা যায় যে ওনার বেশ বড় ধরনের স্ট্রোক হয়েছে ।
তিন.
অপারেশনের পর খালাম্মা চেতনাহীন হয়ে পড়েন লম্বা সময়ের জন্য, কিছুটা ক্লিনিকালি ডেড এর মতো । হসপিটাল থেকে এক সময় ওরা রিলিজ করে দেয় এবং জানিয়ে দেয় যে সারাক্ষণ ওনাকে চোখে চোখে রাখতে হবে । এই অবস্থায় চলে যায় প্রায় বছর খানেক । আমার দুই বন্ধুই কাজ করে, ছেলে-মেয়েগুলো বড়, স্কুল কলেজে চলে যায় সকালে উঠে । বাসায় একমাত্র খালুজান থাকেন । তার বয়স হয়েছে, দীর্ঘদিন যাবত পারকিনসন্স রোগে ভুগছেন বিধায় নিজেই একরকম অন্যের ওপর নির্ভরশীল । তাই উনি ঠিকমতো খালাম্মার দেখাশোনা করতে পারেন না । বন্ধুরা বাধ্য হয়েই খালাম্মাকে দিয়ে দিয়েছে লং টার্ম কেয়ার ইউনিটে ।
চার.
জীবনে যখন খরা আসে, তখন পানির কোন লেশ মাত্র থাকেনা । এরকম একটা অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় হটাত করে খালুজান ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক করেন এবং কিছুটা প্যারালাইজড হয়ে যান । কিছুদিন হসপিটাল এ থেকে বাসায় ফেরার পর ওনার জন্যেও প্রয়োজন হয় ২৪ ঘণ্টা নার্স অথবা পার্সোনাল কেয়ার । আমার দুই বন্ধু খালুজান এর পরিচর্যার জন্যে নার্স রেখে দেয় । চলতে থাকে জীবন । কিন্তু আরো একটু উন্নত পরিচর্যার জন্য খালুজানকেও লং টার্ম কেয়ারে ট্রান্সফার করা হয়, ঠিক খালাম্মার পাশের ঘরে । পাশাপাশি দুটো ঘর, দুজন অচেতন মানুষ, যারা একসময় চেতন ছিলেন, শুয়ে থাকেন অনাদিকালের অপেক্ষায় । কারো মুখে কোন কথা নেই, শুধু চেয়ে থাকা ।
পাঁচ.
এখাবে চলতে চলতে ৪ বছর হল খালাম্মা খালুজান ওই লং টার্ম কেয়ারে আছেন । পাশাপাশি রুম, শুধু শুয়ে থাকা । খালাম্মা এখন একটু চিনতে পারেন কিন্তু কথা বলতে পারেন না, শুধু তাকিয়ে থেকে বুঝিয়ে দেন “আমি তোমাকে চিনি”। দেখা শেষ করে চলে আসার সময় হাত ধরে রেখে দিতে চান, আসতে বাধা দেন, ওনার ইচ্ছা করেনা মেয়েকে বা মেয়ের জামাই কে যেতে দিতে । আর ওদিকে খালুজানের কিছুই বলার নাই শুধু নীরব চেয়ে থাকা ছাড়া । মাঝে মাঝে হসপিটাল কর্তৃপক্ষ বিকালের রোদ পোহানোর জন্য ওনাদের দুজনকে নিচের তলার বিরাট করিডোরে নিয়ে যায়, পাশাপাশি দুটো হুইল চেয়ারে বসিয়ে রাখে । ওনারা পাশাপাশি বসে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কিন্তু কোন কথা হয়না । ওনারা জানেন না কিভাবে কথা বলতে হয়, ওনারা ভুলে গিয়েছেন কথা বলা । জীবনে অনেক কথা ইতিমধ্যে বলা হয়েই গিয়েছে। আর কি লাভ কথা বলে?? দেখে ওনাদের বোঝা যায় না যে ওনারা একে অপরকে চেনেন কিনা । কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন করিডোরের কাচের গ্লাস পেরিয়ে দুরের রাস্তার দিকে যেখানে ১ ঘণ্টায় হয়তো একটা গাড়ী যায় । কারো কোন অভিযোগ নেই, অভিমান নেই, আশা নেই, ভালোবাসা নেই, স্বপ্ন নেই, দুঃখ নেই এবং সব চাইতে বড় বিষয় হলো এগুলো বোঝার চেতনা নেই । আছে শুধু ধুক ধুক ধুক ধুক ৮০ বা ৯০ বার হার্টবিট প্রতি মিনিটে ।
ছয়.
মানুষ আসলে জানেনা কোথায় তার শুরু আর কোথায় শেষ । খালাম্মা খালুজান ৫ বছর আগে এসেছিলেন মাস দুয়েকের জন্য বেড়াতে । সেই বেড়াতে আসাটা যে চিরতরের চলে আসা হবে, তা কোনদিনও ওনারা ভাবেননি । যদি জানতেন তাহলে হয়তো এমুখো হতেন না অথচ জীবন এমন একটা আনপ্রেডিকটেবল জার্নি যা আগে থেকে বোঝা যায়না কোথায় এর শুরু আর কোথায় শেষ ।
সাত.
ওনাদের মাথার ভিতরটা একেবারে খালি হয়ে গিয়েছে, হাল্কা হয়ে গিয়েছে । কোন টেনশন নেই, নেই ফিরে যাওয়ার তাড়া । ওনারা জানেন না কাকে ফিরে যাওয়া বলে । পাশাপাশি বসে খালাম্মা তাকিয়ে থাকেন একদিকে আর খালুজান আরেকদিকে । মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ অথবা চোখ দিয়ে কোন জল বের হয়না । ধীরে ধীরে সন্ধ্যা হয়ে আসে, সবাই একে একে নিজের ঘরে ফিরে । কেউ হয়তো এসে নিয়ে যায় খালাম্মা খালুজানকে তাদের ঘরে । যদি নাও নিয়ে যায় কেউ, ওনাদের কিছুই যায় আসে না । ওনারাতো জানেনই না যে ওনাদের ঘরে ফিরতে হবে । ওনারা শুধু জানেন নিরবে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে । আসলে ওনারা এখন অনেক দুরের যাত্রী, টার্মিনালে বসে আছেন গোধূলি বেলায়, বাস ছাড়ার ঘোষণা শোনার জন্য, যে মুহূর্তে ঘোষণা হয়ে যাবে, ওনারা বাসে উঠে পড়বেন, সন্ধ্যা হয়ে যাবে, বাস ছেড়ে দেবে, ধোঁয়া উড়িয়ে ওনাদেরকে উড়িয়ে নিয়ে চলে যাবে সেই অচিনপুরের রাজ্যে যেখানে গেলে আর কোনদিন ফেরা হয়না । কে যেন একবার বলেছিলো-‘অচিনপুর, অনেক দূর’ ।
আশিকুজ্জামান টুলু
ব্যান্ডসঙ্গীত শিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক