অঘোষিত ধর্মঘট সীমাহীন দুর্ভোগ

রাস্তায় কোনো বাস নামাননি মালিক-শ্রমিকরা, ঢাকার সড়ক ছিল ফাঁকা। ছবিটি শনিবার মতিঝিল থেকে তোলা

ছবি : তানভীর আহমেদ ছিদ্দিকী

যোগাযোগ

অঘোষিত ধর্মঘট সীমাহীন দুর্ভোগ

# মালিকরা বলছেন, শ্রমিকরা বাস চালাতে চাচ্ছেন না ষ শ্রমিকদের দাবি, #মালিকরা বাস নামাতে নিষেধ করেছেন # মৃত্যুদণ্ড আইন বাতিলের দাবিতে শ্রমিকদের বিক্ষোভ

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ৪ অগাস্ট, ২০১৮

নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজধানী ও দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের মধ্যে যাত্রীবাহী বাস চলাচল বন্ধ রেখেছেন মালিকরা। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর রাজপথে শিক্ষার্থীদের তেমন উপস্থিতি না থাকলেও দুয়েকটা ছাড়া কোনো বাস চলতে দেখা যায়নি। দেশজুড়ে বন্ধ ছিল আন্তঃজেলা বাস সার্ভিসও। এমনকি অনেক জেলায় অভ্যন্তরীণ বাস চলাচলও বন্ধ ছিল। নিরাপত্তার অভাবেই এই ‘অঘোষিত ধর্মঘট’ শুরু করেছেন বলে জানিয়েছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। এতে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে রাজধানীবাসী ও বিভিন্ন জেলার যাত্রীদের।

কোথাও কোথাও যাত্রীদের পরিবহন থেকে নামিয়ে দিয়েছে শ্রমিকরা। তবে বাসের মালিক ও শ্রমিকরা পরস্পরবিরোধী কথা বলছেন। মালিকরা বলছেন, ভাঙচুরের কারণে শ্রমিকরা বাস চালাতে চাইছেন না। শ্রমিকদের দাবি, মালিকরা বাস নামাতে নিষেধ করেছেন। পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা সরাসরি ধর্মঘটের কথা স্বীকার না করলেও তারা বলছেন, আন্দোলনরত ছাত্ররা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করায় নিরাপত্তাহীনতার কারণে তারা বাস চালাচ্ছেন না। শুক্রবার সকাল থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, বগুড়া, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, রংপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, যশোরসহ দেশের অধিকাংশ জেলায় বাস চলাচল পুরোপুরি বন্ধ ছিল। কিছু জেলায় অভ্যন্তরীণ রুটের বাসও তেমন চলেনি।

এ ব্যাপারে শুক্রবার সকালে মহাখালীতে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘এটা আমাদের মালিক-শ্রমিকদের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো ধর্মঘট নয়। মালিক শ্রমিকদের কোনো সংগঠনের পক্ষ থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে গাড়ি বন্ধ রাখতে বলেনি। দেশে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনকে আমরা সমর্থন করি। কিন্তু সড়কে আমাদের কোনো নিরাপত্তা নেই। আমরা যখন নিরাপদ বোধ করব তখন গাড়ি নামাব।’ নতুন পরিবহন আইন নিয়ে এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘আমরা আইন মেনে গাড়ি চালাতে চালকদের নির্দেশ দিয়েছি। আইন অনুযায়ী দোষীদের শাস্তি আমরা মেনে নেব। নতুন আইনকে আমরা স্বাগত জানাই।’

তবে মহাখালীতেই অন্তত তিনজন বাসচালক জানান, কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তেই তারা বাস চলাচল বন্ধ রেখেছেন। বাস টার্মিনালের দোতলায় যখন এনায়েত উল্লাহর সংবাদ সম্মেলন চলছিল, তখন বারান্দায় সিদ্ধান্ত জানতে ঘোরাঘুরি করছিলেন বেশ কয়েকজন বাসচালক ও শ্রমিক। তাদের দু’জন জানান, বাস চালানো যাবে কি না সে সিদ্ধান্ত জানতেই তারা এখানে এসেছেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের সিদ্ধান্তেই বাস চলাচল বন্ধ বলে তারা জানান।

এর আগে মহাখালী বাস টার্মিনাল মসজিদে নিহত ছাত্রী দিয়া খানম মিমের দোয়া মাহফিলে অংশ নেন এনায়েত উল্লাহ। সেখানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি ও নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান এবং দিয়া খানমের বাবা জাহাঙ্গীর আলম। ঢাকায় ও দূরপাল্লার বাস চলাচলের বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, ‘এটা কোনো ধর্মঘট নয়। নিরাপত্তার অভাবে মালিক-শ্রমিকরা দিনের বেলায় বাস চলাচল বন্ধ রেখেছেন। তবে রাতের বাস চলছে। আজ (শুক্রবার) যে পরিস্থিতি ছিল, সেই পরিস্থিতি কাল (শনিবার) থাকলে, সকাল থেকেই বাস চলবে।’

গত বৃহস্পতিবার রাত থেকেই বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসা দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাস মাঝপথে শ্রমিকদের বাধার মুখে পড়ে বলে খবর পাওয়া গেছে। পরে গতকাল ভোর থেকে রাজধানীর অভ্যন্তরীণ রুটগুলোতে চলাচলরত যাত্রীবাহী বাসে বাধা দেন শ্রমিকরা। তারা যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে বাসগুলোকে সড়কের পাশে এলোপাতাড়ি দাঁড় করিয়ে দেন। শ্রমিকদের বাধার মুখে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে রাজধানীর প্রায় সব রুটেই বাস চলাচল একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। বাস চলাচল বন্ধ রেখে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থানরত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নির্দেশেই গতকাল সকাল থেকে সব ধরনের পরিবহন বন্ধ রাখা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্ষন্ত এ ধর্মঘট চলবে।

শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত রাজধানীর ব্যস্ততম সড়কগুলোতে তেমন যান চলাচল চোখে পড়েনি। কিছু সড়কে বিআরটিসি ও ট্রাস্ট পরিবহনের বাস চলাচল করতে দেখা গেছে। তবে এ দুই পরিবহনেরও খুব কমসংখ্যক বাস চলাচল করছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর কোথাও একটি বাসের দেখা মিললে তাতে ওঠার জন্য শত শত যাত্রী হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। সরেজমিন দেখা গেছে, মিরপুরজুড়ে প্রধান সড়কগুলোতে এলোপাতাড়ি বাস-মিনিবাস ফেলে রাখা হয়েছে। শ্রমিকরা সড়কে অবস্থান নিয়েছেন। কোনো গাড়ি চলাচল করলে তা থেকে যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মিরপুর সাড়ে ১১-তে এক দল শ্রমিক জানায়, পরিবহন মালিক সমিতি ধর্মঘট ডেকেছে। তারা কোনো গাড়ি চলতে দিচ্ছেন না।

মিরপুরের ডিসি (ট্রাফিক-পশ্চিম) লিটন কুমার সাহা বলেন, ‘মালিক সমিতি ধর্মঘট ডাকেনি। তাদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তারা ডাকতে চাইলে আমরা তাদের না করেছি। তবে বিচ্ছিন্নভাবে শ্রমিকরা গাড়ি থেকে যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে থাকতে পারেন।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, ‘আমরা কাউকে গাড়ি বন্ধ করতে বলিনি। অনেক মালিকই নিরাপত্তাহীনতার কারণে গাড়ি চালাচ্ছেন না। তবে কোনো ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়নি।’ ঢাকার মহাখালী আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক বলেন, ‘ছাত্ররা এখন রাস্তায় নেই, কিন্তু তারপরও গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। প্রথম দিন থেকেই দেখেছি ছাত্রদের কেউ গাড়ি ভাঙচুর করেনি। কিন্তু ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই ঢুকে গেছে যারা এসব কাজ করছে। এজন্য নিরাপত্তার একটা ব্যাপার আছে।’

এদিন রাজধানীর শনিরআখড়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন পরিবহন শ্রমিকরা। জাবালে নূর মালিকের মুক্তি ও মৃত্যুদণ্ড আইন বাতিলের দাবিতে তারা এ কর্মসূচি পালন করছে। সায়েদাবাদেও গাড়ি চলাচল বন্ধ রেখে সড়কে অবস্থান নিয়েছিল পরিবহন শ্রমিকরা। তারা গণপরিবহনের নিরাপত্তা দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন। তারা জানান, গতকাল শুক্রবার ভোর থেকেই সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে সব ধরনের দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। সকালে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা অবস্থান নেওয়ায় টার্মিনালের সামনের সড়ক বন্ধ হয়ে গেছে। রাজধানীর মহাখালী ও গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস চলাচল করছে না। এদিকে যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। যাত্রাবাড়ী থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ আলী বলেন, পরিবহন শ্রমিকরা গাড়ি চালাবেন না। তাই সকাল থেকে তারা সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকায় রাস্তায় অবস্থান করছেন।

ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের উপকমিশনার (ডিসি-উত্তর) প্রবীর কুমার রায় বলেন, ‘পরিস্থিতি আগের চেয়ে বেটার। আশা করছি ঠিক হয়ে যাবে। সড়কে সার্জেন্ট দিয়ে গাড়ির কাগজপত্র ও লাইসেন্স যাচাই-বাছাই চলছে। এ কাজ আমাদের রুটিনমাফিক। যে কারণে হয়তো লাইসেন্স ও ফিটনেসবিহীন পরিবহন কমে যেতে পারে।’

শ্রমিকরা বলছেন, নতুন পরিবহন আইনের খসড়া অনুযায়ী, নরহত্যার জন্য মৃত্যুদণ্ড এবং হত্যা না হলে যাবজ্জীবন শাস্তির যে প্রস্তাব আনা হয়েছে, সেই আইন মাথায় নিয়ে তারা গাড়ি চালাবেন না। এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বাসচালক (৪০) বলেন, ‘রাস্তায় গাড়ি চললে দুর্ঘটনা হয়ই। এই গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না। আরেকটা কথা হইল, আন্দোলন কইরা তারারডা তারা সংশোধন করছে। আমাদের যে যাবজ্জীবন, জেল, কারাদণ্ড, মৃত্যুদণ্ড- এই আইন নিয়া আমরা গাড়ি চালাতে পারব না। এইজন্য আমরা গাড়ি বন্ধ রাখছি।’

এদিকে নিরাপদ সড়কের দাবিতে এদিন টানা ষষ্ঠ দিনের মতো রাজধানীর বেশ কয়েকটি জায়গায় রাস্তায় নেমেছিল শিক্ষার্থীরা। সকালে রাজধানীর শাহবাগ, সায়েন্স ল্যাব, আসাদগেট, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়ক, উত্তরা, মিরপুর এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে জমায়েত হয় শিক্ষার্থীরা। তারা গাড়ি থামিয়ে লাইসেন্স দেখে এবং সারিবদ্ধভাবে গাড়ি চলাচল করতে সাহায্য করে। এ ছাড়া নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা মানববন্ধনও করে। এ সময় তারা রাজধানীর মিরপুরে আন্দোলনকারীদের ওপর ‘ক্ষমতাসীন দলের’ লোকদের হামলার নিন্দা করে। একই সঙ্গে দাবি বাস্তবায়নে লিখিত প্রতিশ্রুতি চায় তারা। এদিন শান্তিপূর্ণভাবে কয়েক ঘণ্টা কর্মসূচির পর ঘরে ফিরে যায় তারা।

গত ২৯ জুলাই দুপুরে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের অদূরে বিমানবন্দর সড়কে (র্যাডিসন হোটেলের উল্টো দিকে) বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়। ওই দিন দুপুর সাড়ে ১২টায় বিমানবন্দর সড়কের বাঁ-পাশে বাসের জন্য অপেক্ষা করার সময় জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস তাদের চাপা দিলে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads