অক্সিজেন কম অ্যামোনিয়ার মাত্রা ভয়াবহ

শিল্পবর্জে্যর দূষণে হালদা নদীতে মরছে মাছ

ছবি : বাংলাদেশের খবর

জীব ও পরিবেশ

হালদার পানিতে ভয়াবহ দূষণ

অক্সিজেন কম অ্যামোনিয়ার মাত্রা ভয়াবহ

  • চট্টগ্রাম ব্যুরো
  • প্রকাশিত ৩০ জুন, ২০১৮

শিল্পবর্জ্যে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদীর সাম্প্রতিক দূষণকে ‘স্মরণকালের ভয়াবহ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে হালদা নদী রক্ষা কমিটি। গতকাল শুক্রবার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক মনজুরুল কিবরিয়া একে হালদা নদীর জন্য ‘অশনিসঙ্কেত’ বলে উল্লেখ করেছেন।

টানা কয়েকদিনের অতিবৃষ্টিতে পানিতে শিল্পবর্জ্য মিশে দূষিত হচ্ছে হালদা নদী। এই পানি আশপাশের বসতিতে এ শিল্পবর্জ্য ঢুকে পড়ায় পুকুরের মাছও মরে যাচ্ছে, ফসলি জমি নষ্ট হচ্ছে বলে তথ্য দেন হালদা রক্ষা আন্দোলনকারীরা।

এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘গত ১৯ জুন রাত থেকে এই দূষণ শুরু হয়। এরপরের দুদিন হালদা এবং এর অববাহিকার বিলগুলোয় ব্যাপক হারে মাছ মরে ভেসে ওঠে।’ নদীর বিভিন্ন অংশের পানির নমুনা সংগ্রহ করার পর তা পরীক্ষা করে অক্সিজেনের মাত্রা কম ও অ্যামোনিয়ার মাত্রা ভয়াবহ হারে বেশি পাওয়ার কথা জানান তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, প্রতি লিটার পানিতে স্বাভাবিকভাবে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ থাকে অন্তত পাঁচ মিলিগ্রাম। কিন্তু সংগ্রহ করা পানির নমুনায় অক্সিজেনের মাত্রা পাওয়া গেছে শূন্য দশমিক ২১ থেকে এক দশমিক শূন্য মিলিগ্রাম। আর হালদার পাশের খন্দকিয়া খালে দ্রবীভূত অ্যামোনিয়ার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে ১০০ গুণ বেশি।

দ্রবীভূত অক্সিজেন কমার পাশাপাশি ও অ্যামোনিয়ার বিষক্রিয়াই হালদা নদীতে মাছ মারা যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করছে মনজুরুল কিবরিয়া।

‘পানির ওপরের অংশে বাতাসের কারণে কিছুটা অক্সিজেন থাকলেও তলদেশে ছিল না। এ জন্য তলদেশের মাছ বেশি মারা গেছে।’

মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, গত ১৯ জুন থেকে হালদা নদীতে মাছ মরতে শুরু করে। রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউশ ২০ প্রজাতির হাজার হাজার মাছ মরে ভেসে ওঠে। মাটির তলদেশে বসবাসকারী ৫-৬ কেজি ওজনের আইড়, বামোস, চিংড়ি, চেউয়া, কুঁচিয়া, বুরগুনি মাছও মারা গেছে। হালদা নদীতে সাম্প্রতিক সময়ের ভয়াবহ দূষণ বিপর্যয়ের মাত্রা অতীতকে ছাড়িয়ে গেছে।

এই হালদা গবেষক বলেন, নানা রকম দূষণের পরও এ বছর হালদা নদীতে রেকর্ড পরিমাণ ডিম সংগ্রহ হওয়ায় মানুষের মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু তার তিন মাসের মাথায় এ দূষণ ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটিয়েছে; মানুষ এখন উদ্বিগ্ন। সংবাদ সম্মেলনে হালদা নদী রক্ষা কমিটি সম্মিলিত মতামত গ্রহণের মাধ্যমে দূষণ ও বিপর্যয়ের সঠিক কারণ উদ্ঘাটন ও হালদাবান্ধব সিদ্ধান্ত নেওয়ার দাবি জানায়।

গত ২৩ জুন মদুনঘাটে হালদা পাড়ে এক মানববন্ধনে বিভিন্ন সংগঠনের পাশাপাশি এলাকার মানুষও হালদা নদীর পাশাপাশি সংযুক্ত সাতটি খাল দূষণমুক্ত করার দাবি জানায়। বিভিন্ন সরকারি সংস্থা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি ও বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় হালদা রক্ষা কমিটি গত ২১ থেকে ২৫ জুন নদীর বিভিন্ন অংশের পানির নমুনা সংগ্রহ ও মৃত মাছ সংগ্রহ করে।

তাদের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে সংবাদ সম্মেলনে হালদায় দূষণের সম্ভাব্য চারটি উৎসের কথা তুলে ধরেন মনজুরুল। তিনি হাটহাজারী ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট; নন্দীর হাটের এশিয়ান পেপার মিলস; চৌধুরী হাট, ফতেয়াবাদ, বড়দিঘী, নন্দীর হাট এলাকায় ব্যাপক হারে গড়ে ওঠা পোলট্রি ফার্মের বর্জ্য ডাম্পিংকে হালদার সাম্প্রতিক দূষণের অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেন।

পাশাপাশি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) অনন্যা আবাসিক এলাকা নির্মাণকাজ চলাকালে বামনশাহী খাল বন্ধ করে দেওয়াকেও দায়ী করেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বামনশাহী খাল বন্ধ করে দেওয়ায় কয়েক কিলোমিটার এলাকা ভরাট হয়ে ভূমিতে পরিণত হয়েছে।

আগে অক্সিজেন থেকে কুলগাঁও পর্যন্ত এলাকার শিল্পবর্জ্য বামন খালের মাধ্যমে কর্ণফুলীতে যেত। খাল ভরাট হওয়ায় এ বছর অতিবৃষ্টিতে বিপরীতমুখী প্রবাহ সৃষ্টি হয়ে হাটহাজারী উপজেলার শিকারপুর ইউনিয়নসহ পাশের গ্রামগুলোয় বর্জ্যমিশ্রিত পানি ঢুকে পড়েছে। পাশাপাশি খন্দকিয়া ও কাটাখালী খাল হয়ে মদুনাঘাট এলাকায় হালদা নদীতে গিয়ে মিশছে।

হালদা নদী রক্ষায় সংবাদ সম্মেলনে ১১টি সুপারিশ করেছে নদী রক্ষা কমিটি। সুপারিশে হাটহাজারী পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টসহ অক্সিজেন থেকে কুলগাঁও পর্যন্ত শিল্প-কারখানায় ইটিপি স্থাপন নিশ্চিত করা, এশিয়ান পেপার মিলসহ অন্য কারখানাগুলোয় ইটিপি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা, হাটহাজারীর নন্দীর হাটের ‘মরা ছড়া’ খালের বর্জ্য ডাম্পিং স্থায়ীভাবে বন্ধ করা, বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে ওঠা অবৈধ পোলট্রি খামারগুলোর দূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা প্রহণ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) অনন্যা আবাসিক এলাকার ভরাট হয়ে যাওয়া বামনশাহী খাল পুনঃখনন করে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনা, অনন্যা আবাসিকের মাস্টার ড্রেনেজ সিস্টেমকে বামনশাহী খাল ও কুয়াইশ খাল থেকে বিচ্ছিন্ন করা, অনন্যা আবাসিক এলাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় এসটিবি স্থাপন, শিকারপুর ও মাদার্শা এলাকার ছোট খাল ও ছড়াগুলো খনন করে পানিপ্রবাহ বাধামুক্ত করা, হালদাকে পরিবেশগত বিপন্ন এলাকা (ইসিএ) ও ‘জাতীয় নদী’ ঘোষণা এবং হালদা নদী ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়ের জন্য হালদা নদী কমিশন গঠন করা।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন হালদা রক্ষা কমিটির উপদেষ্টা শামসুল হক হায়দরী, সহসভাপতি চৌধুরী ফরিদ, সাধারণ সম্পদ মোহাম্মদ আলী, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক রেজা মোজাম্মেল, সাংবাদিক আমিন মুন্না, হালদা নদী থেকে মাছের ডিম সংগ্রহকারী কামাল উদ্দিন সওদাগর, আশু বড়ুয়া, দুলাল দাশ, শ্রীরাম জলদাস ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আমেনা বেগম।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads