একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নানা অনিয়মের জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ সংশ্লিষ্টদের দায়ী করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবি জানিয়েছে নাগরিক সংগঠন সুজন।
গত ৩০ জানুয়ারির ভোট নিয়ে প্রশ্ন তুলে আসা সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) এক সংবাদ সম্মেলনে রাষ্ট্রপতির কাছে এ দাবি জানান।
‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ’ বিষয়ক এই সংবাদ সম্মেলনে ভোট ঘিরে নানা অনিয়মের তথ্য তুলে ধরেন সুজনের সমন্বয়ক দিলীপ কুমার সরকার।
সুজনের দাবি, ওই নির্বাচনে ৩০০টি আসনের ৪০ হাজার ১৫৫টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ১০৩টি আসনের ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। আর ৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে ১২৭টি কেন্দ্রে, ৯৮ শতাংশ ভোট পড়েছে ২০৪ কেন্দ্রে, ৯৭ শতাংশ ভোট পড়েছে ৩৫৮ কেন্দ্রে এবং ৯৬ শতাংশ ভোট পড়েছে ৫১৬ ভোটকেন্দ্রে।
অর্থাৎ ১ হাজার ৪১৮টি ভোটকেন্দ্রে ৯৬ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ ভোট পড়েছে দাবি করে দিলীপ প্রশ্ন করেন, ‘ভোটের জন্য নির্ধারিত সময়ে শতভাগ ভোট পড়া কি সম্ভব?’
একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোট ডাকাতির অভিযোগ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল করলেও তা নাকচ করে আসছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সম্প্রতি ইসির দেওয়া কেন্দ্রভিত্তিক ফল অনুযায়ী, ওই নির্বাচনে ৬৯টি কেন্দ্রে ১০০ শতাংশ ভোটগ্রহণ হয়েছে। এই সংখ্যক কেন্দ্রে শতভাগ ভোটগ্রহণও স্বাভাবিক নয় বলে স্বীকার করেছেন সিইসি নূরুল হুদা। তবে তিনি বলেছেন, এ বিষয়ে এখন আর করার কিছু নেই।
দিলীপ কুমার বলেন, গোপালগঞ্জ জেলার তিনটি আসনের ৩৮৭টি কেন্দ্রের মধ্যে ২৩৯টি কেন্দ্রে প্রদত্ত (৬১.৭৫ শতাংশ) সব ভোট নৌকায় পড়েছে।
‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অধিক হারে ভোট পড়াকে অনেকেই প্রশ্নবিদ্ধ মনে করেন। অনেকের মতে, নির্বাচনের দিনের ভোটের চিত্রের সঙ্গে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়া স্বাভাবিক ঘটনা নয়।’
সংবাদ সম্মেলনে এই নির্বাচনের প্রাথমিক ফলাফলের সঙ্গে কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলের অমিলের চিত্রও তুলে ধরা হয়।
সুজন সমন্বয়ক দিলীপ বলেন, ‘আমরা সুজনের পক্ষ থেকে নির্বাচনের পর পরই রিটার্নিং অফিসারের স্বাক্ষরিত আসনভিত্তিক ফলাফল সংগ্রহ করেছিলাম। কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল প্রকাশের পূর্বে প্রাপ্ত ফলাফলের সঙ্গে কিছু আসনে পার্থক্য লক্ষ করা গেছে।’
তিনি জানান, ঢাকা-১০ আসনে তাৎক্ষণিক ফল ঘোষণায় ৬৯.৯২ শতাংশ ভোট পড়েছে জানানো হলেও কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলে তা বেড়ে ৭৩.০৯ শতাংশ দেখানো হয়েছে।
একইভাবে ঢাকা-১১ আসনে তাৎক্ষণিক ঘোষণায় ৬০.৪৬ শতাংশ কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলে ৬২.৬৫ শতাংশ, চট্টগ্রাম-৮ আসনে তাৎক্ষণিক ঘোষণায় ৭৪.৪৪ শতাংশ কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলে ৭৬.৭২ শতাংশ এবং গোপালগঞ্জ-৩ আসনে তাৎক্ষণিক ঘোষণায় ৯৩.২৪ শতাংশ কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলে ৯৪.৩৩ শতাংশে উন্নীত হয় বলে সুজনের দাবি। দুই ফলের অনিয়ম তুলে ধরে দিলীপ বলেন, চট্টগ্রাম-১০ আসনে গণসংহতি আন্দোলনের প্রার্থীর বেসরকারি ফলাফলে প্রাপ্ত ভোট ‘শূন্য’ দেখানো হলেও কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলে দেখানো হয়েছে যে ওই প্রার্থী ২৪৩টি ভোট পেয়েছেন।
ব্যালট পেপার ও ইভিএমে ভোট প্রদানের মধ্যে ভোটের পার্থক্য ২৯.৩৮ শতাংশ উল্লেখ করে তিনি জানান, এবার নির্বাচনে ৩০০ আসনে মধ্যে ছয়টি আসনে সম্পূর্ণ ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ করা হয়। ৩০০ আসনে গড় ভোট পড়েছে ৮০.২০ শতাংশ। এর মধ্যে ব্যালট পেপারে ভোট হওয়া ২৯৪টি আসনের গড় ভোট ৮০.৮০ শতাংশ হলেও ইভিএমে গড় ভোট পড়েছে ৫১.৪২ শতাংশ।
দিলীপ কুমার বলেন, ‘যে ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে ১০০ শতাংশ ভোট পড়েছে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ৭৫টি নির্বাচনী এলাকার ৫৮৭টি ভোটকেন্দ্রের প্রদত্ত সকল ভোট নৌকা প্রতীকে পড়েছে। আর ধানের শীষে জয়ী ছয়টি আসনের মধ্যে চারটি আসনে অস্বাভাবিক কম ভোট পড়েছে।’
শতভাগ ভোটগ্রহণের বিষয়টি অনুসন্ধানসহ গুরুতর নির্বাচনী অনিয়মের অভিযোগগুলো তদন্ত করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান দিলীপ। সংবাদ সম্মেলনে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘এগুলো সুজনের তথ্য না, কোনো রাজনৈতিক দলের তথ্যও না। এটা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের প্রদত্ত তথ্য। বিদেশি বিভিন্ন অর্গানাইজেশন যখন বাংলাদেশ সম্পর্কে নেগেটিভ রিপোর্ট করে, টিআইবি থেকে শুরু করে অন্যান্য সংগঠন, তখন মন্ত্রীদের অনেকে বলে যে, তাদের তথ্যের উৎস সম্পর্কে আমাদের সন্দেহ আছে। তবে এইটার ব্যাপারে তো সরকার বলতে পারবে না যে, উৎস সম্পর্কে সন্দেহ আছে।’
ইসির এক সময়ের প্যানেল আইনজীবী শাহদীন বলেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট পার্টি ৭০-এর দশকের নির্বাচনে একমাত্র পার্টি হয়েও কোনো কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পায়নি। আমরা মনে হয়, সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টিকেও ছাড়িয়ে গেছি। এখন এই ফলাফল দেখে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, এটা পাগল ছাড়া কেউ দাবি করতে পারবে না।’
যেসব কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে, সেখানে যে জালিয়াতি হয়েছে, তা প্রমাণ করতে হলে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের বিচারককে এই ফলাফল দেখানো যথেষ্ট বলে মনে করেন এই আইনজীবী।
তিনি বলেন, ‘ফলাফলে নির্বাচন কমিশন জালিয়াতি করেছে। এই বিষয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবিতে আমি সমর্থন করছি। সাংবিধানিক পদের কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন যে অসদাচরণের অভিযোগের কিছুটা বিশ্বাসযোগ্যতা আছে, তাহলে তিনি তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করতে পারেন।’
এসময় সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘এই তথ্যগুলো আপনাদের সামনে উপস্থাপন করলাম। আমরা মনে করি এই নির্বাচনে চরম অনিয়ম হয়েছে। এই সংবাদ সম্মেলেন থেকে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে অনুরোধ থাকবে, তিনি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে এই অনিয়মের অভিযোগগুলো তদন্ত করে... যারা এর জন্য দায়ী বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন, তাদের বিরুদ্ধে যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
সুজন সম্পাদক বলেন, ‘নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। মানুষের মধ্যে অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এখন পুরোপুরি যদি ভেঙে যায়, তাহলে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদলের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। তখন আমরা কেউ নিরাপদ থাকব কি না, এই প্রশ্ন রইল।’
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিয়মের এত তথ্য থাকা সত্ত্বেও এই নির্বাচন কমিশন দিয়ে আর কোনো নির্বাচন করা ঠিক হবে না বলে মনে করেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘এটার বিচার না হওয়া পর্যন্ত এই নির্বাচন কমিশন দিয়ে আর কোনো নির্বাচন যেন না করা হয়। এই একটা দাবি থাকবে।’
কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘অতীতে বাংলাদেশে অনেক অস্বচ্ছ নির্বাচন হয়েছে, গোঁজামিলের নির্বাচন হয়েছে। এবারে নির্বাচন কমিশন গোঁজামিলে না গিয়ে সোজামিলে চলে গেছে। সোজামিল মানে শতভাগ ভোট।’ সুজন সভাপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খানের সভাপতিত্বে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
 
                                 
                                 
                                         
                                         
                                         
                                        





