খায়রুজ্জামান খান সানি
দীর্ঘ দেড় বছর করোনায় বিপর্যস্ত জনজীবন। স্তব্ধ চারপাশ, নেই কোলাহল। থমকে দাঁড়িয়েছে অর্থনীতির চাকা। সংক্রমণ যেখানে থামছেই না, সেখানে মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলছে প্রতিনিয়ত। স্বজন হারানোর বেদনায় কাতর বাংলার আকাশ যেন ভারী হয়ে আছে আজ। গত বছরের ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় বাংলাদেশে। আর ১৮ মার্চ থেকে সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সংক্রমণ অধিক বৃদ্ধি পেলে একের পর এক সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেও যখন সংক্রমণ ঠেকানো যায়নি, তখন সর্বাত্মক লকডাউনের ঘোষণা আসে। পরবর্তীসময়ে লকডাউনের সময়সীমা দফায় দফায় বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু কার্যত সংক্রমণ আর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে থমকে যেতে থাকে জীবনচাকা, ভেঙে পড়ে অর্থনীতি।
তারপরও করোনাকালীন প্রতিটা দেশে অর্থনীতির চাকা যেখানে স্তব্ধ, সেখানে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে প্রবাসী শ্রমিকদের প্রেরিত রেমিট্যান্স। সরকার কর্তৃক ২% প্রণোদনার ফলে বেড়েছে রেমিট্যান্স আয়ের পরিমাণ। অর্থনৈতিক উন্নয়নে রেমিট্যান্সের অবদান মোট জিডিপির ১২ শতাংশের মতো। থেমে নেই দেশের কৃষিকাজও। কিন্তু থমকে গিয়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, চাকরির বাজার ও শিক্ষাব্যবস্থা। ছোট ছোট ব্যবসাগুলো প্রায় বন্ধের পথে, পুঁজি হারিয়ে কর্মচারীদের বেতন-বোনাস বন্ধ, কাজ হারাচ্ছেন শ্রমিকরা। একইি অবস্থা চাকরির বাজারেও। কর্মী ছাঁটাই, কর্মহীন মানুষের সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেকারত্বের অভিশাপ মাথায় নিয়ে সহায়সম্বলহীন মানুষ শূন্য হাতে ফেরত যাচ্ছেন গ্রামে কোনোরকমে বেঁচে থাকার আশায়।
এর ঢেউ এসে পড়েছে শিক্ষাঙ্গনেও। নেই কোলাহল মাঠ, ঘাট, হাট-বাজারে। সহপাঠীদের সঙ্গে আড্ডা জমে না, একই সুরে সুর বাঁধা হয় না। কয়েকবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কথা বলা হলেও করোনা পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় ছুটির মেয়াদ বেড়েই চলেছে। ঠিক কবে নাগাদ খোলা হবে সে বিষয়েও নেই নিশ্চয়তা। অনিশ্চয়তায় ভুগছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। বর্তমানে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে দেশের সর্বত্র, যা অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় অধিক সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে কঠোর লকডাউন চলছে। কিন্তু যেখানে সংক্রমণ রোধে চাই সর্বোচ্চ সতর্কতা, সামাজিক দূরত্ব; সেখানে মেনে চলা হচ্ছে না এসব স্বাস্থ্যবিধি। যার ফলে দ্রুত গতিতে বেড়েই চলছে সংক্রমণ। নিত্যদিন আক্রান্তের সংখ্যা, মৃত্যুর সংখ্যা রেকর্ড সংখ্যক হারে বেড়েই চলছে। অন্যদিকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে ছিন্নমূল মানুষদের। যাদের পথই শেষ ঠিকানা। লকডাউনের কারণে রাজধানীসহ অন্যান্য জেলায় বসবাসরত সিংহভাগ মানুষের জীবিকা নির্বাহ বন্ধ রয়েছে। কখনো ক্ষুধার তাড়নায় ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ছে। কেউবা স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করেই চলাফেরা করছেন, চায়ের দোকানে আড্ডা জমাচ্ছেন, হাট-বাজারে ভিড় জমাচ্ছেন। ‘উপায় নেই গোলাম হোসেন’। নিম্নবিত্তের সংসারের দায় কে নেবে?
এমন পরিস্থিতির মধ্যে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইডিসিআর জানিয়েছে, গত জুন মাসে দেশে কোভিড-১৯ রোগীদের নমুনা থেকে ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স করে দেখা গেছে, ৭৮ শতাংশই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের। হার্ড ইমিউনিটি বা দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি করে করোনাভাইরাস মোকাবিলা করতে সক্ষম। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা করোনাভাইরাসের অন্য ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে ৯৫ শতাংশ কার্যকারিতা দেখিয়েছিল। ১৪ জুন তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যের বরাতে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, যারা ফাইজারের একটি ডোজ নিয়েছেন চার সপ্তাহ পর দেখা গেছে, তাদের ৩৬ শতাংশের ক্ষেত্রে এ টিকা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কার্যকর সুরক্ষা দিতে পেরেছে। দুই ডোজের পর তা বেড়ে ৮৮ শতাংশ হয়েছে। অন্যদিকে পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের গবেষণার বরাত দিয়ে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার এক ডোজ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে ৩০ শতাংশ কার্যকারিতা দেখিয়েছে। আর দুই ডোজ নেওয়া ব্যক্তিদের ৬৭ শতাংশের ক্ষেত্রে এই টিকা সুরক্ষা দিতে পেরেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসির এক গবেষণার বরাত দিয়ে এনবিসি বস্টনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মডার্নার টিকার এক ডোজ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে ৮০ শতাংশ এবং দুই ডোজ ৯০ শতাংশ পর্যন্ত সুরক্ষা দিতে পারে। চীন উদ্ভাবিত সিনোফার্ম ভ্যাকসিনের দুই ডোজ করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ৭৮.১ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত সুরক্ষা দিতে পারে। গবেষণায় বলা হচ্ছে, করোনা সংক্রমণ রোধ করতে ৮০ শতাংশ দেশের জনগণকে ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আনতে হবে। তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ গণটিকাদান কর্মসূচি শুরু করেছিল গত ৭ ফেব্রুয়ারি। টিকার উৎস ছিল ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট। ভারতে হঠাৎ সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পাওয়াতে গত মার্চে টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার পর বাংলাদেশে গণটিকাদান কর্মসূচি বিঘ্নিত হয় এবং দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট রোধ করতে সীমিত আকারে লকডাউন ঘোষণা করা হলেও ধীরে ধীরে তার বিস্তার অধিক পরিমাণে বেড়ে যায়। বর্তমানে কঠোর লকডাউন দিয়েও রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এক্ষেত্রে গণটিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। সকলকে দুই ডোজ টিকা নিশ্চিত করতে হবে। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে বিভিন্ন উৎস থেকে দুই কোটি ডোজ আসার কথা বলা হয়েছে। পূর্বের ন্যায় যদি কোনো কারণে ভ্যাকসিন আসায় বিঘ্ন ঘটে, তবে অন্যান্য উৎস থেকে ভ্যাকসিনের বিকল্প পদ্ধতি ভাবতে হবে।
আগামী ৭ আগস্ট থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকাদান করা হবে। ভ্যাকসিনের আওতায় এনে সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব হবে এবং একই সঙ্গে দেশের সব মানুষকে ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আনতে হবে। অধিক সংক্রমণ রোধ করতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। তবে টিকার সুরক্ষা কত দিন পর্যন্ত কার্যকর থাকবে এই নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে। এখন পর্যন্ত এর প্রকৃত তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। এমনকি বুস্টার ডোজ নিতে হবে কি না সেটাও অজানা। টিকা নিলেও মানুষকে আরো কিছুদিন সতর্ক থাকতেই হবে। কারণ আমরা দেখেছি, যারা টিকা নিয়েছেন তারাও সংক্রমিত হয়েছেন, তবে দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ায় অন্যদের তুলনায় দ্রুত আরোগ্য লাভ করেছেন।
গণটিকাদান কর্মসূচি পালনের পর সবাইকে ভ্যাককিনেশনের আওয়তায় আনা হলেও আমাদের সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে যেতে হবে। প্রবাসে যারা বসবাসরত আছেন, তারা দেশে যখন আসবেন, তাদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন বাধ্যতামূলক করতে হবে। করোনামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চাইলে সর্বোচ্চ সতর্কতার পাশাপাশি টিকা নিশ্চিত করা এখন অতীব জরুরি। করোনামুক্ত দেশই পারবে দেশের প্রতিটা মানুষের পূর্বের জীবনযাপন ফিরিয়ে দিতে। পৃথিবী সুস্থ হয়ে উঠুক, সুস্থ হয়ে উঠুক প্রতিটি প্রাণ, এই প্রত্যাশাই এখন বিশ্ব মানবের। করোনামুক্ত জাতি ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’।
লেখক : শিক্ষার্থী, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া