‘দিকুদের’ বাথান বাড়ী

ভুমিসন্তানদের ভূমি হারানোর বোবা কান্না হয়ে বরেন্দ্র ভূমির বুকে এখনও দেখা মেলে ‘দিকুদের’ বাথান বাড়ী। ছবিটি বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত তানোর উপজেলারর বাধাইড় ইউনিয়ন এলাকার জুমার পাড়া এলাকা থেকে তোলা

ছবি : সাইদ সাজু

ফিচার

‘দিকুদের’ বাথান বাড়ী

  • ফিচার ডেস্ক
  • প্রকাশিত ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

সাইদ সাজু, তানোর :

 

হঠাৎ থেমে যাওয়া সমুদ্রের মত ঢেউ খেলানো উচু নিচু বরেন্দ্র ভূমি’র বিস্তীর্ন মাঠ জুড়ে চোখে পড়ে সবুজ ফসলের সমারহ। আঁকা বাঁকা রাস্তার দু’পাশে তাল গাছের সারি, মাটির ঘরের দেয়ালে আদিবাসী নারীর নঁকশা করা ফুল, পাখি. লতা পাতার ছবি। সবই যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা এক একটা ক্যানভাস, যার অন্তরালে লুকিয়ে আছে ভূমিসন্তানদের ভূমি হারানো বেদনার সেই করুন ইতিহাস। কালের বিবর্তনে অজানা সেই ইতিহাসের নিরব সাক্ষী বরেন্দ্র ভূমির বাথান বাড়ী। প্রত্যন্ত আদিবাসী এলাকায় এক সময় হরহামেশা দেখা মিললেও সময়ের পরিবর্তনে এখন তা বিলুপ্ত প্রায়। তবে, ভূমিসন্তানদের ভুমি হারানোর বোকা এবং বোবা কান্না হয়ে বরেন্দ্র ভূমির বুকে এখনও দেখা মেলে ‘দিকুদের’ বাথান বাড়ী। সময় পাল্টায়, ভূমির মালিকানার পরিবর্তন হয়, কালের গর্ভে হারিয়ে যায় দিকুদের বাথান বাড়ী। শুধু পাল্টোয় না ভুমিসন্তনদের বঞ্চনার ইতিহাস !

১৮৫৫ সালে ইংরেজ, জমিদার এবং মাহজন/দিকুদের বিরুদ্ধে সংগঠিত ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ এবং বাথান বাড়ীর প্রেক্ষাপট বিচারে দিয়্যাড়ারা যেহেতু মহাজন শ্রেণীর মধ্যে পড়ে তাই বাথান বাড়ীর সাথে বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূমিসন্তানদের ভুমি হারানোর অজানা ইতিহাস জড়িয়ে আছে একথা বলা যায়।

বরেন্দ্র ভূমির বাথান বাড়ির মালিকদের কেউ সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা না। স্থানীয় ‘বারিন্দাদের’ (বারিন্দা বলতে স্থানীয় ভাষায় বরেন্দ্র ভূমির আদি অধিবাসী-আদিবাসি বাঙ্গালী উভয়কে বোঝায়) নিকট এরা ‘দিয়্যাড়া/দিয়াড়ে’ নামে পরিচিত। এরা মূলত চাঁপাইনবাবগঞ্জের পশ্চিম এবং কানসাট ও শিবগঞ্জের ভারতীয় সীমান্তবর্তি চর এলাকার মানুষ। ‘দিয়্যাড়’ বা ‘দিয়্যাড়া’ নামে নিদিষ্ট কোন অঞ্চল বা জনগোষ্ঠির অস্তিত্ব না থাকলেও রাজশাহীর তানোর, গোদাগাড়ী, রহনপুর, আমনুরা, নাচোল, নঁওগার মহাদেবপুর, সাপাহার পত্নীতলা থেকে শুরু করে জয়পুরহাট, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁ এবং পঞ্চগড়ের বিস্তীর্ণ এলাকার সাধারণ মানুষ এদেরকে ‘দিয়্যাড়া’ নামেই জানেন এবং বলেন। বিশেষত আদিবাসীদের নিকট এরা সবচেয়ে বেশি পরিচিত। সহজ সরল দরিদ্র ভুমি সন্তানদের জমি হাতিয়ে নিতে সুদের উপর নগদ টাকা, ফসল, অগ্রিম মজুরী প্রদানসহ, এক বিঘা জমি কিনে দুই বিঘা লিখে নেয়া, এক’শ টাকা ধার দিয়ে দশ’মন ধান আদায় করা। এমন কি সংঘবদ্ধভাবে দেশিয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে জমি দখলে অসংখ্য ঘটনায় জড়িয়ে আছে বরেন্দ্র ভূমির বাথান বাড়ির ইতিহাস।

‘দিয়্যাড়া’ বলতে নিদিষ্ট অঞ্চলের মানুষকে বোঝালেও সাঁওতাল আদিবাসীরা ‘দিয়্যাড়া’ শব্দটিকে ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেন। তাদের কাছে ‘দিয়্যাড়া’ এবং ‘দিকু’ উভয় সমর্থক শব্দ। তারা বাঙ্গালী মহাজন বা বড় গৃহস্থ বোঝাতে ‘দিকু’ শব্দ ব্যবহার করেন। বরেন্দ্র ভূমিতে দিয়্যাড় বা দিয়াড়া নামে নিদিষ্ট কোন অঞ্চল বা জনগোষ্ঠি নেই তাই দিকু শব্দ থেকে দিয়্যাড়া শব্দের উৎপত্তি হতে পারে বলে আমরা ধরে নিতে পারি। আমরা জানি, আদিবাসীরা ভূমির সামাজিক মালিকানায় বিশ্বাসী। ভূমি তাদের কাছে মায়েরমত। মায়ের বুকের দুধ খেয়ে সন্তান বড় হয় আর ভুমি’র ফসল দিয়ে সেই সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখে।

তাই মা এবং ভূমি কোনটায় ভাগ করা যায় না ! ভূমি কেন্দ্রীক তাদের এই বিশ্বাস, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে পাশ কাটিয়ে ১৯৫০সালে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের পর বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রীয়ভাবে যে সকল ভূমি আইন পাশ করা হয় তার কোনটায় তাদের প্রথাগত ঐতিহ্যকে স্বীকার করেনি। ফলে বরেন্দ্র ভূমির সহজ সরল ভূমি সন্তানরা যুগ যুগ ধরে তাদের দখলে থাকা ভুমির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরীতে ব্যর্থ হচ্ছেন। আর এই সুয়োগটা কাজে লাগায় দিয়্যাড়ারা। প্রথমে তারা নিদিষ্ট কোন আদিবাসী এলাকাকে টার্গেট করে সেই এলাকার আদিবাসী বা পাশের গ্রামের মানুষের সাথে সু-সস্পর্ক গড়ে অল্প কিছু জমি কিনে ঘাঁটি গেড়ে তারপর স্থানীয় ভূমি অফিসের সাথে যোগসাজে খাস ও বিরোধপূর্ণ জমি খুজে সেগুলোর ভূয়া দলিল করে ধীরে ধীরে দখলে নিতে শুরু করতে থাকেন। এভাবে জমির পরিমান একটু বেশি হলে সেখানে নীল কুঠির আদলে তৈরী করা হতো বাথান বাড়ি। যেখানে বছরের নিদিষ্ট সময় ফসল বুনা এবং কাঁটা মাড়াইয়ের জন্য দিয়্যাড় থেকে গরু, মিহিষের গাড়িতে খাবার-দাবার, বিছনাপত্র, চাষের উপকরণসহ লোকজন নিয়ে অস্থায়ী বসত গাড়ে ফসল বুনা বা কাঁটা মাড়ায় শেষ হলে, উৎপাদিত ফসল নিয়ে তারা ফিরে যায় স্থায়ী আবাসের সেই দিয়্যাড়ে। অন্য সময় তালাবদ্ধ অবস্থায় থাকে। বছরের পর বছর তারা এই বাথান বাড়িকে ফসল বুনা এবং কাঁটা মাড়াইড়ের কাজে ব্যবহার করেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads