মুক্তমত

‘আগামী প্রজন্মের ভাগ্য শিক্ষকদের ওপর নির্ভর করছে’

  • প্রকাশিত ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

জিয়াউল হক

 

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, পাক শাসকগোষ্ঠীর কাছে বাঙালিরা কতটা বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে। আর তিনি এও জানতেন, বৈষম্যের এই চিত্র বাঙালিকে হাতেকলমে বোঝাতে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। সেজন্যই সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে এক চোখে নুন এক চোখে তেল বিক্রির মতো দুই যুগ শাসনের নামে শোষণ করেছিল। জাতির পিতা তাদের পুঞ্জীভূত শোষণের দাঁতভাঙা জবাব দেওয়ার জন্য ১৯৭০ সালে জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষে টেলিভিশন ভাষণে শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ‘সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের চেয়ে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছুই হতে পারে না।’

জাতির পিতার ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও ১৯৭০ সালের শিক্ষানুরাগী ঐতিহাসিক নির্বাচনী ভাষণ যে শুধু প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছিল না, তা সদ্য স্বাধীন দেশের প্রথম অর্থনৈতিক বাজেটে শিক্ষা খাতে সামরিক খাতের চেয়ে ৭ শতাংশ বেশি বরাদ্দ দিয়ে তারই প্রমাণ। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে এক ঘোষণায় ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেছিলেন। একই সাথে ১২ হাজার নতুন বিদ্যালয় স্থাপন, ৪৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই, খাতা, কলম, পেন্সিল বিতরণ ও গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যে পোশাক বিতরণের ব্যবস্থাও তিনি করেছিলেন। ক্ষণজন্মা এই প্রবাদপ্রতিম পুরুষ মাত্র সাড়ে তিন বছরের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অসীন হয়ে বাঙালি জাতিকে আধুনিক ও কল্যাণমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ কুদরত-ই-খুদাকে প্রধান করে একটি যুগোপযোগী ও বাস্তবভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রণয়নের নিমিত্তে কমিশন গঠন করেন। ইসলামী শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে মাদরাসা এডুকেশন অর্ডিন্যান্স জারি করেন। ১৯৭৩ সালে ইউনিভার্সিটি গ্রান্ড কমিশন অব বাংলাদেশ আদেশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট, বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান আদেশ জারি করেন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের প্রথম বার্ষিক সম্মেলন উদ্বোধনকালে তিনি বলেন, ‘ক খ শিখলেই শিক্ষিত হয় না। সত্যিকারের আলোকপ্রাপ্ত শিক্ষিত হতে হবে।’ একই বছর দেশের প্রথম সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে তিনি বলেন, ‘আমি সর্বত্রই একটি কথা বলি, সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। সোনার মানুষ আকাশ থেকেও পড়বে না, মাটি থেকেও গজাবে না। এই বাংলার সাত কোটি মানুষের মধ্য থেকেই তাদের সৃষ্টি করতে হবে।’

জাতির পিতা যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য নবজাতক বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তূপ থেকে টেনে তুলে হাঁটি হাঁটি পা পা করে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই ’৭১-এর পরাজিত শক্তি, মস্তিষ্কবিকৃত তৎকালীন সাবেক কিছু উচ্ছৃঙ্খল সেনা কর্মকর্তা ও দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বাংলার ইতিহাসের ললাটে এঁকে দেয় কলঙ্কের কালিমা। তাকে ও তার পরিবার, আত্মীয়স্বজনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ঘাতকরা জাতির ভাগ্যাকাশ ঢেকে দেয় অমানিশার কালো আঁধারে। ততদিনে উর্দিপরা জেনারেলরা মাথায় বন্দুকের নল ঠেকিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। পাকিস্তানি জেনারেলদের খুশি করতে দেশকে ‘পাক সার জামিন সাদ বাদ’ ভাবধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়। ৩০ লাখ শহীদ আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত দেশে স্বাধীনতার স্বীকৃত শত্রু গোলাম আযমের মতো রাজাকারকে নাগরিকত্ব দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। শাহ আজিজুর রহমানের মতো কুখ্যাত রাজাকারকে লাখো শহীদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করে স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী করা হয়। এবং জাতির পিতার খুনিদের প্রতি খুশি হয়ে পদোন্নতিসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূত করে পুরস্কৃত করা হয়। এরপর কেটে যায় ২১টি বছর। ’৭৫-পরবর্তী সময়ে যুগল জেনারেল স্বৈরশাসকরা স্বাধীনতার মূল উদ্দেশ্যকে বুটের তলায় পিষ্ট করে দেশে স্বৈরাচারী শাসনের বিষবৃক্ষ রোপণ করে। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা প্রথমবারের মতো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। পিতার মতো তিনিও উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, শিক্ষা ছাড়া একটি জাতির কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয়। এজন্য তিনি ২০১০ সালে যুগোপযোগী আধুনিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন। বছরের প্রথম দিন প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই তুলে দেন। এবং খ্রিস্টীয় নববর্ষের প্রথম দিনকে বই উৎসব ঘোষণা করেন। যা সারা বিশ্বের কাছে এক নজিরবিহীন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

দেশের সব স্কুল কলেজ মাদরাসায় পর্যায়ক্রমিকভাবে একাডেমিক ভবন নির্মাণ, আধুনিক মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ স্থাপন, তথ্যপ্রযুক্তিতে শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিতে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন, এনটিআরসির মাধ্যমে মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ। গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত উদ্যোগে শিক্ষা সহায়তা তহবিল গঠন করে সহায়তা প্রদান। পিতার পরে কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে এক ঘোষণায় ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ করেন, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। দেশের প্রতিটি উপজেলায় একটি করে ডিগ্রি কলেজ ও একটি করে হাইস্কুল জাতীয়করণ করেছেন। এছাড়াও বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের মাসিক বেতন দ্বিগুণ করা, বার্ষিক ৫ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধি, মূল বেতনের ২০ শতাংশ বৈশাখী ভাতা চালুসহ শিক্ষকদের মঙ্গলের জন্য যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।

২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যমআয়ের দেশে রূপান্তরিত করার যে স্বপ্ন তিনি জাতিকে দেখিয়েছেন, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করার ঘোষণার মধ্য দিয়ে তার সেই স্বপ্ন ষোলোকলা পূর্ণ হবে।

জাতির পিতার সেই বক্তব্যের মতোই বলতে হয়, ‘আগামী প্রজন্মের ভাগ্য শিক্ষকদের ওপর নির্ভর করছে।’

 

 

লেখক : লেখক ও প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads