বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতায় অবৈধভাবে দখল হয়ে গেছে রাজধানীর ৪৩টি খাল। এবার দখল ও দূষণ থেকে বাঁচাতে চলতি মাসেই এ খালগুলোকে হস্তান্তর করা হচ্ছে সিটি করপোরেশনের কাছে। এরপর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নেতৃত্বে আগামী জানুয়ারি থেকেই শুরু হবে খালগুলো উদ্ধারের যৌথ অভিযান।
স্বপ্নের শহর রাজধানী ঢাকা। প্রায় দুই কোটি মানুষের কর্মচঞ্চল রাজধানী অল্প বৃষ্টিতেই বদলে যায় দুঃস্বপ্নের নগরীতে। অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মুখে পড়ে ২৭০ বর্গকিলোমিটারের এই মেগা সিটি। আর এই জলাবদ্ধতার মূল কারণ—দখলে রুদ্ধ রাজধানীর প্রায় সব খাল। ২০০৫ সাল থেকে এসব খালের পানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখার দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু দীর্ঘ এই এক যুগ ধরে এক সংস্থা অন্য সংস্থাকে শুধু দোষারোপই করে যাচ্ছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রাজধানীর খালগুলোর মধ্যে টিকে আছে ৪৩টি খাল, যার মালিকানা এখনো ঢাকা জেলা প্রশাসনের। এর মধ্যে ঢাকা ওয়াসা তদারকি করে ২৬টি খালের এবং ঢাকা জেলা প্রশাসন তদারকি করে ৮টি খাল। আর ৯টি খালের জায়গায় রয়েছে বক্স কালভার্ট, ব্রিক সুয়্যার
লাইন। বাকি ৩৪টি দখল-দূষণে নিশ্চিহ্ন প্রায়। দখলে বদলে গেছে খালগুলোর গতিপথ। ষাট ফুট চওড়া খাল হয়ে গেছে এখন পাঁচ ফুটেরও নিচে। কোথাও কোথাও খালের জায়গা পরিণত হয়েছে এখন ভাগাড়ে।
এদিকে প্রভাবশালী দখলদারদের রক্তচুক্ষু উপেক্ষা করে এবার খাল অবৈধ দখলমুক্ত করতে মাঠে নামছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস। এনিয়ে সম্প্রতি স্থানীয় মন্ত্রণালয়ে কয়েক দফায় বৈঠকও হয়েছে। বৈঠকে প্রাথমিকভাবে খালগুলোর প্রকৃত সীমানা চিহ্নিতকরণ, দুই পাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও নাব্য নিশ্চিতে জোর দিচ্ছেন দুই মেয়র।
অন্যদিকে সম্প্রতি স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয় সভায় জলাবদ্ধতা নিরসন নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়। এতে রাজধানীর কয়েকটি খালের বাস্তব অবস্থা তুলে ধরা হয়। যেমন, মিরপুরের বাউনিয়া খালটি ওই এলাকার পানি নিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম। কিন্তু অবৈধ দখলদারদের সাইনবোর্ডের ভিড়ে এর দেখা পাওয়াই মুশকিল। খালটির গতিপথ বদলে স্থবির হয়েছে পানিপ্রবাহ। এছাড়া রাজধানীর জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী খালগুলো হলো মিরপুরের বাইশটেকি খাল, বাউনিয়া খাল, রূপনগর খাল, সাংবাদিক কলোনি খাল, কালশী খাল, কল্যাণপুর খাল, পাগলার পুল খাল, ইব্রাহিমপুর খাল, হাজারীবাগ খাল, কাটাসুর খাল ও রামচন্দ্রপুর খালের বাস্তব অবস্থা তুলে ধরা হয়।
বাইশটেকি খালের মিরপুর ১১ নম্বরের প্যারিস রোড ডিসিসি মার্কেট থেকে পলাশনগর হয়ে বাউনিয়া খাল পর্যন্ত অংশ অবৈধ দখলে রয়েছে। বহুতল ভবনের দেয়াল চেপে ধরে আছে খালটিকে। সাংবাদিক খাল ভরাট হয়ে গেছে বর্জ্যে। পাড় দখল করে উঠেছে কারখানা। একইভাবে যাত্রাবাড়ী কুতুবখালী খাল দখল করে সিঙ্গাপুর ট্রেনিং সেন্টার ও সিএনজি গ্যারেজ করা হয়েছে। খিলগাঁও-বাসাবো খালের খিলগাঁও অংশ থেকে তিলপাপাড়া পর্যন্ত খালের কোনো চিহ্ন চোখে পড়ে না। খাল ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে বেশ কিছু দোকান। এটি খিলগাঁওয়ের ভেতর দিয়ে বাসাবো হয়ে মান্ডা খালে গিয়ে মিশেছে। রামপুরা-বনশ্রী খালের অবস্থা আরো নাজুক। যদিও বছরখানেক আগে খালটি খনন করা হয়েছ। কিন্তু তাতেও তেমন সফলতা আসেনি। এ খালে অবৈধ দখল তুলনামূলক কম থাকলেও দূষণের ফলে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। খালটির মেরাদিয়া বাজার অংশে বিশাল ময়লার ভাগাড় রয়েছে। নন্দীপাড়া খালটি ময়লা আর দখলের কবলে মৃতপ্রায়। পরিষ্কার না করায় খালটিতে পানির প্রবাহ নেই।
এবিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মনে করেন, রাজধানীর জলাবদ্ধতা দূর করতে হলে প্রথমেই খালগুলো উদ্ধার করে এর সংস্কার ও খনন করা প্রয়োজন। এ জন্য সংশ্লিষ্টদের আগে খালের প্রকৃত সীমানা চিহ্নিত করতে হবে। ওই সীমানার মধ্যে কোনো অবৈধ দখলদার বা কোনো অবৈধ স্থাপনা থাকলে সেগুলো উচ্ছেদ করে খালকে প্রকৃত চেহারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। খালের পানিপ্রবাহ ঠিক রাখতে খালের যেসব এলাকা ভরাট হয়েছে, সেখানে খনন করে গভীরতা বাড়াতে হবে।
জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকার দুই মেয়র কী করছেন এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, খালের জায়গা ভরাট করে সেখানে চার-পাঁচতলা ভবন করা হয়েছে। পানি যাবে কোথায়। তবে এর জন্য সিটি করপোরেশন কোনোভাবেই দায়ী না। খালের মালিক জেলা প্রশাসন, আর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। তারা ২৫ বছরে এই খাল পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ করেনি। যার ফলে একটু বৃষ্টিতে জলাবদ্ধাতা সৃষ্টি হয়। তবে চলতি মাসে ডিএনসিসির এলাকার খালগুলো পূর্ণ মালিকানা সংস্থার আয়ত্তে চলে আসবে। এরপর আমরা টাস্কফোর্সের মাধ্যমে খাল উদ্ধারে অভিযান চালাব। এ ক্ষেত্রে কারো সঙ্গে কোনো ধরনের আপস হবে না।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, খালগুলো দখলমুক্ত করতে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম নিয়েছি। আমরা আশাবাদী যে, আগামী বর্ষার আগেই ঢাকাবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করতে পারব। চলতি মাসের মধ্যেই ডিএসসিসির আওতার খালগুলো পরিপূর্ণ মালিকানা চলে আসবে সংস্থার উপরে। এরপর স্বল্পমেয়াদি কার্যক্রমে নিজ অর্থায়নে আমরা খালগুলো উদ্ধারে অভিযান শুরু করব। এ কাজে কোনো রক্তচক্ষুর কাছে আপস করবে না ডিএসসিসি। প্রথম আমাদের কাজ হচ্ছে খালগুলো দখলমুক্ত করা। আর সিএস খতিয়ান দেখে আমরা ১১টি খাল দখলমুক্ত করব।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, এক সময় খালের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের হাতেই ছিল এবং আইনেও তাই আছে। পরে কোনো এক সময়ে রাষ্ট্রপতির আদেশে সেটি ঢাকা ওয়াসার হাতে দেওয়া হয়। এখন দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র খালের দায়িত্ব নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। সবাই মিলে আলোচনায় বসে আমরা ওয়াসা থেকে দুই সিটি করপোরেশনের কাছে খালগুলো হস্তান্তরের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছি।