সম্পাদকীয়

৩ নভেম্বর জাতির ইতিহাসে কলঙ্কযুক্ত একটি দিন

  • প্রকাশিত ৩ নভেম্বর, ২০২০

মো. জোবায়ের আলী জুয়েল

 

 

কীভাবে তাজউদ্দীনসহ চার জাতীয় নেতার হত্যাকাণ্ড ঘটে, দীর্ঘদিন তা মানুষের জানা ছিল না। কিন্তু পাপ কখনো চাপা থাকে না। আর তাই মানুষ ধীরে ধীরে সবই জানতে পারে।

১৯৭৫ সালের ২২ আগস্ট সকালে তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্যকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে জড়ো করা হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কন্ট্রোল রুমে। খানিক পরেই সেখানে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে এসে হাজির হন মেজর ডালিম ও রশীদ। সকাল সাড়ে এগারোটার দিকে নেতাদের সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। সেখানে নিউ জেলে পাশাপাশি তিনটি রুমে রাখা হয় এই রাজনীতিকদের। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম কামারুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও আবদুস সামাদ আজাদকে। জেলহত্যার অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল রাত ২টায় ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর। ফারুক আর রশীদের ট্যাংকবাহিনী থাকায় তাদের এই জেলহত্যার অভ্যুত্থান শুরু করতে বেশি বেগ পেতে হয়নি। মোশতাক জেলহত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন কেবল ফারুক আর রশীদকে নিয়ে। মোশতাক ঠিক করেছিলেন যে, কোনো পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটলে কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক চার নেতা তাজউদ্দীন, নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী আর কামারুজ্জামানকে হত্যা করা হবে।

ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢোকার পথে জেল কর্তৃপক্ষ তাদের বাধা দেয়। কারণ বাইরের অস্ত্রধারীদের জেলে প্রবেশ পুরোপুরি বেআইনি। এ নিয়ে সেখানে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের বচসা হয়। তারপর ঘাতক বাহিনী তাদের নির্দেশদাতাদের সঙ্গে বঙ্গভবনে টেলিফোনে যোগাযোগ করে। এরপর রাত ৩টার দিকে বঙ্গভবন থেকে সে সময়ের আইজি প্রিজন নূরুজ্জামানের কাছে টেলিফোন করেন মেজর রশীদ।

নূরুজ্জামানকে তিনি বলেন, ‘কয়েকজন আর্মি কিছু বন্দিকে জোর করে নিয়ে যাওয়ার জন্য জেল গেটে যেতে পারে, আপনি জেল গার্ডদের সতর্ক করে দিন।’ কয়েক মিনিট পর তিনি আবারো টেলিফোন পান এক আর্মি অফিসারের কাছ থেকে। তিনি নূরুজ্জামানকে বলেন, ‘নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে কি না তা আপনি নিজের চোখে দেখে আসুন।’ আসলে এসব টেলিফোন করা হয়েছিল হত্যার পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করতে। জেলগেটে আইজি প্রিজন, ডিআইজি প্রিজন আর জেলার এক হওয়ার কিছুক্ষণ পর মেজর রশীদ আবারো টেলিফোন করেন আইজি প্রিজনকে। তিনি বলেন, ‘রিসালদার মোসলেম জেলগেটে আছেন। তিনি আপনাকে বিশেষ একটি কথা বলবেন। আপনি রিসালদার মোসলেমের জন্য জেলগেট ছেড়ে দিতে বলবেন ও তাকে অফিসে নিয়ে যাবেন এবং তাজউদ্দীন, মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও কামারুজ্জামান এই চার বন্দিকে তার সামনে হাজির করবেন।’ হতচকিত আইজি প্রিজন তখন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলতে চান। মেজর রশীদ টেলিফোনটি রাষ্ট্রপতি মোশতাক আহমদের হাতে দেন এবং নূরুজ্জামান কিছু বলার আগেই রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আপনি বুঝতে পেরেছেন মেজর রশীদ আপনাকে কী নির্দেশ দিয়েছেন?’ নূরুজ্জামান বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি বুঝতে পেরেছি। রিসালদার মোসলেমের কাছে চারজন বন্দিকে নিয়ে আসতে হবে।’ মোশতাক তখন বলেন, ‘আপনাকে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আপনি তা পালন করুন।’ এভাবেই তাদের ঢুকতে দেওয়ার নির্দেশ আসে সর্বোচ্চ মহল থেকে।

এর কয়েক মিনিট আগেই জেলখানার ভেতরে সেনাবাহিনীর ৩ সিপাই আর ১২ জন সুবাদারসহ কালো পোশাক পরা রিসালদার মোসলেম এসে পৌঁছান। তারা সবাই ছিলেন পুরো মাতাল, সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। নিয়ম অনুযায়ী জেলগেটে স্বাক্ষর করে ভেতরে ঢোকার কথা থাকলেও প্রথমে তারা চেষ্টা চালান নাম না লিখেই জেলের ভেতরে ঢোকার। গেট ওয়ার্ডার ও জেলার তাদের বাধা দিলে এবং স্বাক্ষরের জন্যে জোরাজুরি করলে একপর্যায়ে বাধ্য হন তারা নাম লিখতে। চার নেতার নাম দিয়ে রিসালদার মোসলেম তাকে বলেন, ‘এদের একসঙ্গে করে সেখানে আমাদের নিয়ে চলেন। আমি এ চারজনকে গুলি করে মারব।’ শুনে নূরুজ্জামানসহ সবাই হতভম্ব হয়ে যান। এরকম ভয়াবহ কথা শুনে কেউ পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে দেন। মেজর রশীদ সেখানে ফোন করে জানতে চান রিসালদার মোসলেম জেলের ভেতরে গিয়ে পৌঁছেছেন কিনা? নূরুজ্জামান বলেন, ‘হ্যাঁ পৌঁছেছেন।’ মেজর রশীদ বলেন, ‘আপনি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলেন’, এই বলে তিনি ফোনটি মোশতাকের হাতে তুলে দেন। নূরুজ্জামান বলেন, ‘স্যার, ওরা তো বন্দিকে গুলি করে মেরে ফেলতে চাইছেন।’ শুনে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘ওরা যা বলছে সেটাই হবে।’ একথা শোনার পর রিসালদার মোসলেমের সেনাদল নিয়ে আইজি রওনা হন কারাগারের ভেতরের দিকে। কিছুদূর যাওয়ার পর বামদিকে মোড় নিতেই ডিআইজি আউয়াল প্রচণ্ড অস্থির হয়ে ওঠেন। জেলের ভেতরে কেউ অস্ত্র নিয়ে ঢুকবে, এটা তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারছিলেন না। জেলের মধ্যে কাউকে খুন করা হবে এটাও সভ্যজগতের রীতি নয়। কিন্তু সামরিক শাসনের সময় সেটি হয়ে উঠল খুব স্বাভাবিক ঘটনা। শেষবারের মতো তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন ডিআইজি আউয়াল। তিনি জেলার সাহেবকে বলেন, ‘জেলার সাহেব, কাজটা তো বেআইনি হচ্ছে।

অস্ত্র নিয়ে ভেতরে ঢোকা নিষেধ, বেআইনি।’ সেনাদল প্রচণ্ড গালিগালাজ করে একথা শুনে। সবাই যদি সেদিন ডিআইজি আউয়ালের মতো সামান্য একটু প্রতিবাদের চেষ্টা করতেন, তাহলে সে রাতটি হয়তো অন্যরকম হতে পারত। কিন্তু অস্ত্রের মুখে জেলরক্ষকরাও সেদিন ভীত হয়ে পড়েন। তারা সেনাদলটিকে লকআপের ভেতর পৌঁছে দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন। ঘাতকরা জাতীয় চার নেতাকে তাজউদ্দীনের কক্ষে একত্র করেন। তারপর সেখানেই তাদের গুলি করেন এবং বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেন। জেলের সব বন্দি কেঁপে ওঠেন কান ফাটা ব্রাশফায়ারের শব্দে। হঠাৎই জেলের ভেতরে নেমে আসে ভয়াবহ নীরবতা। সেই নীরবতা ভেঙে ভেসে আসে কাছেই চকবাজারের বড় মসজিদ থেকে ফজরের আজানের ধ্বনি। কিন্তু জেলে বন্দি চার নেতাকে হত্যার খবর সেদিন সম্ভবত বাইরে প্রকাশ পায়নি। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বিশেষ ব্যবস্থাধীনে ময়নাতদন্তের পর এই চার নেতার লাশ ৪ নভেম্বর দুপুর ২টার সময় নিয়ে যাওয়া হয় প্রত্যেকের বাসায় এবং তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। 

হত্যাকাণ্ডের পর ডিআইজি প্রিজন আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় বাদী হয়ে লিখিতভাবে এজাহার দেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্পেশাল ব্রাঞ্চ, সিআইডি, ডিজিএফআইসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে এ ঘটনার পরদিনই জেলে সে সময় উপস্থিত কর্মকর্তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়।

ডিআইজি প্রিজন আবদুল আউয়াল ৪ নভেম্বর কেস করার কয়েকদিন পর পুলিশ এসে তদন্ত করে যায়। আরো কয়েকদিন পর গঠিত হয় একটি তদন্ত কমিটি, যার চেয়ারম্যান করা হয় বিচারপতি আহসান উদ্দীনকে এবং সেক্রেটারি হন আবদুল আউয়াল। তদন্ত কমিটির সামনে কেউ সাক্ষ্য দিতে না এলেও তাকে যেন আসতে বাধ্য করা যায়, সে ব্যাপারে নোটিফিকেশনের মাধ্যমে একটি ডিমান্ড নোটিশ করা হয়েছিল। ব্যাপারটি তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও জানিয়েছিলেন। সেখান থেকে বিষয়টির আইনগত দিক খতিয়ে দেখার জন্য বলা হয়েছিল আইন মন্ত্রণালয়কে। কিন্তু তারপরই তা রাজনৈতিক কারণে ধামাচাপা পড়ে যায়।

দীর্ঘ একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালে জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জেলহত্যার মতো নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বিচার পুনরায় শুরু করেন এবং বিচারের রায়ও কার্যকর করেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু হত্যা ও পরে জেলহত্যার বিচারের ব্যবস্থা করে বাংলাদেশের ইতিহাসকে বিচার ও আইনের পূর্ণতা দিয়েছেন। অন্যথায় বাঙালি জাতির ইতিহাস কলঙ্কিত থেকে যেত।

 

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads