ঢাকাসহ দেশের ১১টি সিটি করপোরেশন ও ১১টি পৌরসভা মিলে ‘নগর দরিদ্র সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়ন’ প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এই প্রকল্পে দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যয় করা হবে ৮২৬ কোটি টাকা। ওই প্রকল্পের নগর ব্যবস্থাপক সোহেল ইকবাল এ তথ্য জানিয়েছেন।
জানা গেছে, ‘শহরে দরিদ্র সম্প্রদায়ের জীবিকা নির্বাহ’ প্রকল্পটি ২০১৬ সালে যাত্রা শুরু করলেও ডিপিপির বিলম্বের কারণে ২০১৮ সালের ১৪ আগস্টে অনুমোদন করা হয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে এই প্রকল্পের মেয়াদ ৫ বছর ধরা হয়েছে। এ প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকারের ১০৭ কোটি টাকা, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) ১০০ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যের দাতাসংস্থার ইউকে এইডের ৬১৯ কোটি টাকাসহ মোট ৮২৬ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে কড়াইল বস্তিতে বেশ কিছু হতদরিদ্র মানুষ বসবাস করছে। তাদের একজন রংপুরের সালেহা বেগম। তিনি বসতির একটি ঘরে গত ৭ বছর বাস করছেন। পেশায় গৃহকর্মী। তার স্বামী আনছার আলী দিনমজুর। যেদিন তার কাজ থাকে না সেদিন সালেহা বেগমের একবেলার খাবার জোগানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তার ওপর শরীরে রোগ লেগেই আছে।
সালেহা বেগম ছাড়াও বস্তিবাসীর যাদের সঙ্গেই কথা বলা হয়েছে তাদের বেশিরভাগই শারীরিকভাবে অসুস্থ। তারা প্রতি সপ্তাহে অন্তত দুদিন শারীরিক দুর্বলতা ও জ্বর-সর্দির কারণে কাজে যেতে পারেন না। বস্তির অধিকাংশ মানুষ দিনমজুর, ফেরিওয়ালা, হোটেলকর্মী, চা দোকানদার, রিকশাচালক, ভিক্ষাসহ বিভিন্ন পেশায় কাজ করেন। এ ছাড়া অভাবের কারণে তাদের অধিকাংশের ছেলেমেয়েরাই স্কুল বন্ধ করে শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়েছে। এখানে বসবাসকারী শতকরা ৯০ জন মানুষই উপকূলীয় এলাকা থেকে এসেছেন। তাদের ঢাকায় আসার প্রধান কারণ, গ্রামে কর্মসংস্থানের অভাব। নদীভাঙনের কবলে পড়ে ভিটা-মাটি হারানো, কৃষি ফসলের দাম না পাওয়া, নদীতে মাছ কম পাওয়াসহ বিভিন্ন কারণকে দায়ী করেছেন তারা। উন্নত জীবনের আশায় ঢাকায় এলেও গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে তুলনা করে হতাশায় ভুগছেন বেশিরভাগ মানুষ।
ঢাকার শুধু কড়াইল বস্তিতে বসবাস করেন প্রায় আড়াই লাখ মানুষ। এই বস্তির শতাধিক মানুষের ব্যবহারের জন্য মাত্র দুটি টয়লেট রয়েছে। সেগুলোর বেহাল অবস্থা। মলমূত্র পড়ছে ঘরের নিচের খালে। এ পরিস্থিতিতে বছরজুড়েই শিশু-বৃদ্ধ সবার জ্বর, সর্দি, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগ লেগেই থাকে। আর সামান্য রোগব্যাধিতেও ঋণের জন্য হাত পাততে হয় বস্তিবাসীকে।
অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন গবেষকরা বলছেন, অভিন্ন চিত্র ঢাকার ৪০ লাখ বস্তিবাসীর। অভাবে পড়ে দলে দলে ঢাকায় আসছে তারা। তবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের পরিবেশ, মানবিক সুরক্ষাসহ বিভিন্ন সূচকে নগর দারিদ্র্যের অবস্থা অনেক খারাপ হচ্ছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ও বেসরকারি কয়েকটি উন্নয়ন সংস্থার জাতীয় ও শহরের দারিদ্র্য নিয়ে করা জরিপ ও শুমারি বিশ্লেষণ করে এর সত্যতা মিলেছে। এসব দরিদ্র মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে ‘নগর দরিদ্র সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়ন’ প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগরের বস্তিতে যারা বসবাস করেন তাদের বেশিরভাগ দিনমজুর, রিকশা চালান, ফুটপাতে বোতল সংগ্রহ কিংবা ছোটখাটো দোকানে ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এতে তাদের সন্তানদের লেখাপড়া ও পরিবার চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এসব সমস্যা দূর করতে এ ধরনের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। গ্রামে সরকারের অন্তত ১৪০টি সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প আছে, যা শহরে নেই। সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামের অনেক মানুষ ঘর পেয়েছে। কিন্তু শহরে বস্তিবাসীকে বেশি ভাড়ায় থাকতে হচ্ছে।
জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্টাসের গত বছরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকা শহরের বাসিন্দা ১ কোটি ৭০ লাখ। ২০৩০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা বেড়ে ২ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে আভাস দেওয়া হয়েছে। আগামী ১০ বছরে আরো প্রায় এক কোটির বেশি মানুষ ঢাকায় প্রবেশ করবে।
বিশ্বব্যাংকের করা আরেক জরিপে দেখা গেছে, প্রতি বছর ঢাকায় প্রবেশ করছে অন্তত ৭ লাখ মানুষ। ১৯৯১ থেকে ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে নগর দরিদ্রের সংখ্যা ৬০ লাখ থেকে বেড়ে ৮০ লাখ হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৪০ লাখ বাস করছে ঢাকায়। আর এসময়ে গ্রামীণ দরিদ্রের সংখ্যা ৫ কোটি ৫০ লাখ থেকে কমে ৪ কোটি ৬০ লাখ হয়েছে। ২০১৬ সালে বিশ্বব্যাংক পরিচালিত আরবান স্ল্যাম সার্ভের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরে বস্তিবাসীর প্রতি ১০ জনে ৯ জনের জন্ম ঢাকার বাইরে, এর মধ্যে এক-পঞ্চমাংশ দরিদ্র।
‘নগর দরিদ্র সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়ন’ প্রকল্পের নগর ব্যবস্থাপক সোহেল ইকবাল বলেন, প্রকল্পের সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দরিদ্র মানুষদের বাছাই করে এলাকাভিত্তিক ইউনিট গঠন করা হবে। ইউনিটের সদস্যরা নিজেরাই যেন নিজেদের অর্থ সঞ্চয় করেন সে ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়া হবে। এ হিসেবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৩০০ ইউনিটের টার্গেট করা হয়েছে। বর্তমানে ৬০ ইউনিট হয়েছে। একটি ইউনিটে আড়াইশ থেকে তিনশ হাউজ হোল্ড থাকবে। ইউনিট অনুসারে প্রকল্প থেকে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হবে।
তিনি আরো বলেন, দেশের ১২টি সিটি করপোরেশন ২৩টি পৌরসভা মিলে প্রকল্পের কাজ চলবে। এরই মধ্যে ২২টি নগরে প্রকল্পের কাজ চলমান। সেখানে মেয়েদের পড়াশোনা যেন বন্ধ না হয়, সেজন্য স্কুল চলাকালে প্রতি বছরে ৯ হাজার টাকা পাবেন শিক্ষার্থীরা।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, নগরীতে যে মাত্রায় দরিদ্রের সংখ্যা বাড়ছে তা ভয়াবহ। মূলত দুটি কারণে এটি হচ্ছে। গ্রামের বিভিন্ন সংকট মানুষকে শহরে ঠেলে দিচ্ছে। আরেকটি কারণ শহরের কাজের আকর্ষণ। শহুরে দরিদ্রদের আয় বেশি। তবে অধিকারের বিভিন্ন সূচকে তারা গ্রামের চেয়ে পিছিয়ে।