হাঁড়িচাঁচা। স্থানীয়দের কাছে তারুয়া নামেও পরিচিত। কালো ধূসর রঙের ঝগড়াটে পাখি। ইংরেজি নাম- Rufous TreePie| Corvidae (crow family) গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম- উবহফৎড়পরঃঃধ ঠধমধনঁহফধ। ঘন পাতার বড় গাছে বেশি বিচরণ এদের। ঘন পাতার আড়ালে থাকতে ভালোবাসলেও খাবারের অভাবে কখনো কখনো বাড়ির পেঁপে, আতা কিংবা ঘরের আঙিনায় শসা, ঝিঙে ও চিচিঙ্গার মাচাতে কিংবা গ্রামীণ মেঠোপথের পাশের খেজুর গাছে রসের হাঁড়িতেও দেখা মেলে বৃক্ষচারী এই পাখিটির। মানুষের রূঢ় আচরণে পরিবেশ প্রকৃতির বিপর্যয়, বিষ প্রয়োগ ও বনভূমি উজাড় হয়ে কমে যাচ্ছে হাঁড়িচাঁচার মতো সুন্দর সব পাখি।
লেজ লম্বা। দেহের দৈর্ঘ্য ৪৫ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার। ওজন ১২৫-১৩০ গ্রাম। ঠোঁট কাকের মতো ও মজবুত। লম্বা হয়ে নেমে যাওয়া লেজের সাদা পালকের অগ্রভাগ গাঢ় কালো রঙা। স্বাভাবিক অবস্থায় থাকলে লেজের অর্ধেক দৈর্ঘ্য বরাবর চোখে পড়ে দু’পাশে কয়েকটি কালো পালক। বিপরীত দিক থেকে দেখলে ১০ জোড়া পালক ডোরাকাটা মনে হবে। সাহসী ও জেদি পাখি হাঁড়িচাঁচা কখনো ঝগড়া কিংবা লেজ উঁচিয়ে তুললে মায়াময় দৃষ্টিনন্দন শোভা ছড়ায়। দেহতল, পিঠ ও লেজের গোড়া পর্যন্ত তামাটে থেকে গাঢ়-ধূসরে ছাওয়া। চোখ থেকে ঘাড় পর্যন্ত চওড়া কালো পালক। চোখ কালো। গাঢ়-ধূসর থেকে বের হওয়া পা ও পায়ের নখরও কালো। ডানার প্রান্ত ও মধ্য পালক কালোর ওপর স্পষ্ট সাদা। স্ত্রী-পুরুষ প্রায় একই রকম। চিচিঙ্গা, ঝিঙে, শসার মতো সবজি ও ফল-ফলাদির সঙ্গে টিকটিকি, গিরগিটি, ছোট ব্যাঙ, কীটপতঙ্গ, পাখির ডিম-বাচ্চা খায় এরা। টাটকা হলে মৃত ছোটখাটো প্রাণীর মাংসও খায়। অন্যের খাবার ছিনিয়েও নেয় এরা। জোড়া বেঁধে চলে এই পাখি। কখনো কখনো মিষ্টি স্বরে পিপ-পিপ ডাকে। তবে সচরাচর উচ্চৈস্বরে ডাকে ও চেঁচামেচি করে। স্বরে আছে বৈচিত্র্য। মার্চ-জুন এদের প্রজননকাল। এ মেয়াদ কখনো কখনো জুলাইতেও গড়ায়। গাছের শিকড়-বাকড়, শ্যাওলা, শুকনো কাঠি ও পাতা দিয়ে ঘন পাতার আড়ালে পেয়ালার মতো বাসা বানায় এরা। ডিম পাড়ে চার থেকে ছয়টি।
‘সেভ দ্য বার্ড অ্যান্ড বি’ নামে স্থানীয় পরিবেশবিষয়ক সংগঠনের পরিচালক মণ্ডলীর একজন প্রবাসী কামরুজ্জামান শিমুল বলেন, আকাশে পাখি উড়লে প্রকৃতি পায় নতুন দিগন্ত। বনভূমি, বুনোফল-ফলাদি কমে যাওয়াসহ বাসস্থান, প্রজননে বাসা তৈরি, ফুল-ফসলে বিষ প্রয়োগ আর খাবারের সঙ্কটে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে এই হাঁড়িচাঁচা পাখি। পরিবেশবান্ধব দেশি প্রজাতির ফলদ গাছের পরিকল্পিত বনায়নের মাধ্যমে প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশ বাঁচিয়ে হাঁড়িচাঁচার মতো বিপন্ন প্রাণীদের রক্ষায় সবার এগিয়ে আসা উচিত।
খুলনা বিভাগীয় মৎস্য বিশেষজ্ঞ এবং বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের মফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও চীন হাঁড়িচাঁচার মূল আবাসস্থল। সহজে চোখে না পড়লেও চট্টগ্রাম, সিলেট, জামালপুর ও শেরপুর সীমান্তবর্তী পাহাড়ি ছড়ায় গ্রিন ম্যাগাপি নামে অপরূপ সুন্দর সবুজ হাঁড়িচাঁচা পাখিরও দেখা মেলে। পরিবেশের জন্য ভালো ভূমিকা রাখলেও বৈশ্বিক আবহাওয়ার পরিবর্তন, মানুষের রূঢ় আচরণে পরিবেশ-প্রকৃতির বিপর্যয়, বিষ প্রয়োগ ও বনভূমি উজাড় হয়ে কমে যাচ্ছে হাঁড়িচাঁচার মতো সুন্দর সব পাখি।’ গাজীপুরের শেখ কামাল ওয়াইল্ড লাইফ সেন্টারের পাখিবিদ আল্লামা শিবলী সাদিক বলেন, ‘বিপন্ন তালিকায় নাম না উঠলেও দিন দিন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী হাঁড়িচাঁচা পাখিগুলো কমে যাচ্ছে। এদের প্রতি সবার অনুকূল দৃষ্টিভঙ্গি ও যত্নবান হওয়া উচিত।’