‘সহ্যের মাত্রা পেরিয়ে যাচ্ছে। তবু কিছুই করার নেই। এত খরচ, অল্প আয়ে আর চলছে না। মাঝে মাঝে মনে হয় সংসার ছেড়ে পালিয়ে যাই’— গতকাল শুক্রবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর টাউনহল এলাকায় পরিচিত মুদি দোকানির কাছে এভাবেই নিজের অসহায়ত্ব ও ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন পরাগ আহম্মেদ নামের এক ব্যক্তি। ওই সময় পরিবারের জন্য বেশকিছুু নিত্যপণ্য কিনছিলেন তিনি, যেগুলোর বেশির ভাগেরই দাম গত মাসে বেড়েছে। আর ওইসব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ভীষণ ক্ষিপ্ত বেসরকারি কোম্পানির সীমিত আয়ের এ চাকরিজীবী।
পুরো মাস ওই দোকানেই বাকিতে সদাই কেনেন পরাগ। তিনি বলেন, মাস শেষ হতে এখনো এক সপ্তাহ বাকি। কিন্তু এ মাসে বাকি হয়েছে গত মাসের তুলনায় দেড় হাজার টাকার বেশি। এই পরিমাণ অর্থ আমি পুরো মাসে সঞ্চয়ও করতে পারছি না। কিন্তু সেই টাকা আমার পকেট কেটে ব্যবসায়ীরা নিয়ে নিচ্ছে। আমি অসহায়।
এদিকে সুপ্রিয়া স্টোর নামের ওই দোকানের মালিক এমদাদ মিয়া বলেন, তার দোকানের প্রতিটি বাকির ক্রেতারই এ মাসে খরচ বেড়েছে। এর প্রধান কারণ ছিল পেঁয়াজ ও চালের দাম বৃদ্ধি। এ ছাড়া এখন তেল, আটা, ডাল ও ডিমের দাম বেড়েছে। আর বাড়তি পণ্যগুলো প্রতিটি পরিবারো জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয়। এসবই বিক্রি বেশি হয় তার দোকানে।
সংসার চালাতে হিমগিম খাচ্ছেন স্বল্প আয়ের মানুষ পরাগ আহম্মেদ। নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় এখন তার করুণ দশা। তার থেকেও বেশি বিপদে রয়েছে দরিদ্র মানুষরা। তারা বাজারে পুরোদমে নাকানি-চুবানি খাচ্ছে। চাল ও পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি, এরপর লবণকাণ্ড পকেট কেটেছে তাদের।
অন্যদিকে বাজারে আলু ও পেঁপে ছাড়া সব সবজির কেজিই ৫০ থেকে ৭০ টাকা। নতুন করে কয়েকদিনে বেড়েছে তেল, আটা, ময়দা, ডাল ও ডিমের দাম। এর মধ্যে প্রতি লিটার তেলে ৩ টাকা, ময়দা কেজিতে ৮ টাকা, আটা ২ টাকা এবং মসুর ডাল মানভেদে ১৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে কেজিপ্রতি। আর গত কয়েক দিনে নতুন করে বেড়েছে ডিমের দাম, প্রতি ডজন ডিম ১০ টাকা বেড়ে আবারো ১০৫ টাকায় উঠেছে।
এদিকে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ১৫ প্রকারের নিত্যপণ্যের বাজারদরের হিসাব রাখে প্রতিদিন। এর মধ্যে চাল, আটা, ময়দা, তেল, লবণ, চিনি, ডাল, মসলা, মাছ, মাংস, গুঁড়াদুধসহ আরো কিছু পণ্যের বিভিন্ন প্রকারের দাম রয়েছে। সর্বমোট টিসিবির তালিকায় থাকা ৩৬ ধরনের পণ্যের মূল্যতালিকা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এর মধ্যে এক মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ৩২টি পণ্যের দামই। কমেছে শুধু ৪ ধরনের পণ্যের দাম। অর্থাৎ বাজারে প্রায় ৭৫ শতাংশ পণ্যই ঊর্ধ্বমুখী।
তথ্য আরো বলছে, তালিকায় থাকা নিত্যপণ্যগুলোর মধ্যে একমাসের ব্যবধানে চালের দাম ১১ শতাংশ, খোলা আটা ৭ শতাংশ, খোলা ময়দা ৭ শতাংশ, সয়াবিন ৩ শতাংশ, পাম তেল ৮ শতাংশ, ডাল ৪ শতাংশ, পেঁয়াজের দাম ৯০ শতাংশ বেড়েছে। অর্থাৎ অপরিবর্তিত রয়েছে শুধু চিনির দাম।
গতকাল সরেজমিনে রাজধানীর একাধিক বাজার ঘুরে দেখা গেছে, কিছুটা কমলেও এখনো খোলাবাজারে পেঁয়াজের দাম দেড়শ টাকার নিচে নামেনি। ঢাকার খুচরা বাজারে বাছাই করা দেশি পেঁয়াজ এখনো ১৮০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে মিয়ানমার ও মিসরের পেঁয়াজ ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা কেজির মধ্যে মিলছে।
অন্যদিকে অধিকাংশ সবজির দাম বেশ দীর্ঘ সময় ধরেই নাগালের বাইরে। শীতের সবজির প্রচুর সরবরাহ থাকার পরও দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই। গত দেড় মাস ধরে শিম, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলাসহ শীতের আগাম সবজি বাজারে বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে।
কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গতকাল প্রতি কেজি বেগুন ৬০, কাঁচা টমেটো ৮০-১০০, নতুন আলু ১০০-১২০, ধনেপাতা ১৮০-২০০, মুলার কেজি ৫০-৬০, গাজর ৮০-১২০ ও শালগম ৬০-৮০, বরবটি ৬০, করলা ৮০-১০০, চিচিঙ্গা ৬০-৮০, ঢ্যাঁড়শ ৬০ টাকা, কচুর লতি ৫০-৬০, ধুন্দল ৬০ ও কচুরমুখি ৮০-১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া আদা ১৬০-১৮০, রসুন ১৬০-১৮০ এবং আলু কেজিতে বিক্রি হচ্ছে ২৪-২৫ টাকায়।
তালতলা বাজারে নতুন ঢাকায় আসা মোর্শেদ নামের এক রিকশাচালক বলেন, ‘গিরাম-শহর কুন্টিও (কোথাও) শান্তি নাই। গিরামত একমণ ধানের ট্যাক্যা দিয়্যা এক ব্যাগ সদাই হছে না (হচ্ছে না)। আর শহরত আসি দেখি দুই-তিন পদ সবজি কিনতেই আদবেলার ইনকাম শ্যাষ।’