ধর্ম

হাদিয়া সুন্নত আর ঘুষ হারাম

  • প্রকাশিত ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

রাশেদ নাইব

 

 

 

মানুষের জীবন চলার ক্ষেত্রে অন্যের সাথে সম্পর্ক তৈরি হয়। কোনো সম্পর্ক রক্তের। কোনো সম্পর্ক আত্মার। এ সম্পর্কগুলো কখনো ভাঙে কখনো বা মজবুত হয়। দৃঢ় থেকে দৃঢ় হয়। সম্পর্ক ভাঙা যাবে না। যত সম্পর্ক হয় তা আরো মজবুত করতে হবে। সম্পর্কগুলো টিকিয়ে রাখতে বা আরো মজবুত করতে নিজেদের মধ্যে কিছুর আদান-প্রদান হওয়া জরুরি। দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমে সম্পর্ক সুন্দর হয়। মহব্বত বাড়ে। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমরা পরস্পর হাদিয়ার আদান-প্রদান করো, তাহলে মহব্বত বৃদ্ধি পাবে।’ (ইমাম বুখারি রচিত আদাবুল মুফরাদ, হাদিস নং-৫৯৪) অন্যত্র রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমরা পরস্পরে হাদিয়া বিনিয়ম করো এর দ্বারা অন্তরের সঙ্কীর্ণতা ও হিংসা-বিদ্বেষ দূর হয়ে যায়।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং-৯২৫০) নিস্বার্থভাবে, বিনিময় ছাড়া, চাওয়া ব্যতীত ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেদের মধ্যে যে আদান-প্রদান হয় তাই হাদিয়া। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা যদি খুশি হয়ে তোমাদেরকে দিয়ে দেয়, তাহলে তোমরা তা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ করো।’ (সুরা নিসা, আয়াত-৪) হাদিয়া অল্প হলেও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গ্রহণ করার জন্য বলেছেন। নবীজি বলেন, ‘হে মুসলিম রমণীগণ! তোমাদের প্রতিবেশীর জন্যে সামান্য উপহার বা হাদিয়াও তুচ্ছজ্ঞান করো না। যদিও তা বকরির পায়ের খুর হয়।’ (বুখারি, হাদিস নং-২৪২৭)

ইসলামে হাদিয়া বৈধ। শুধু বৈধ নয়, বরং তাতে রয়েছে সাওয়াব বা পুণ্য। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদিয়া দিয়েছেন ও নিয়েছেন। হাদিয়া দেওয়া-নেওয়া উভয়টি মুস্তাহাব বা সুন্নত। তবে হাদিয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য দুটি শর্ত রয়েছে। ১. যা হাদিয়া দেবে ওই জিনিস হালাল হতে হবে। ২. হাদিয়া সম্পূর্ণ নিজের সম্মতিতে দিতে হবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কোনো মুসলিমের সম্মতি ব্যতীত সম্পদ ব্যবহার করা হালাল হবে না।’ (সুনানে বায়হাকি, হাদিস নং-১১৩২৫) এ শর্তদ্বয়ের প্রতি লক্ষ রেখে আমরা হাদিয়া দেব ও নেব। সুন্নত জিন্দা হবে। এর দ্বারা সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনও আরো সৌহার্দ্যপূর্ণ হবে।

হাদিয়াতে উপরিউক্ত শর্তদ্বয় না থাকলে হারাম হবে। শর্তগুলো যদি থাকে তবে উভয়ের জন্য হালাল আর যদি না থাকে উভয়ের জন্য হারাম। যদি দাতা বাধ্য হয়, জীবন সঙ্কট মুহূর্ত বা ক্ষতি হয় তবে তখন তা দাতার জন্য জায়েজ হবে আর গ্রহীতার জন্য হারাম হবে। তার জন্য এটা ঘুষের নামান্তর। ঘুষ হারাম। সরকারি বা বেসরকারি কোনো কর্মকর্তা জনগণের টাকায় বেতনভাতা গ্রহণ করে থাকেন তখন তাদের কাজের জন্য জনগণ থেকে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া ঘুষ। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘প্রশাসনের ব্যক্তিবর্গ হাদিয়া কবুল করলে চুরি বলে গণ্য হবে (অর্থাৎ হারাম হবে)।’ (মুসনাদে আহমাদ, খণ্ড ৫; পৃষ্ঠা-৪২৪) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, ‘রাজা-বাদশাদের হাদিয়া গ্রহণ করা ঘুষের অন্তর্ভুক্ত।’ (খতিবে বাগদাদী রচিত তালখিসুল মুতাশাবিহ খণ্ড-১ পৃষ্ঠা-৩৩১)

আসাদ গোত্রের এক ব্যক্তিকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জাকাতের কাজে নিয়োগ দেন। তার নাম ছিল ইবনুল লুতাবিয়্যাহ। কাজ থেকে ফেরার পর বলল এ হচ্ছে জাকাতের সম্পদ আর এগুলো আমাকে হাদিয়া দেওয়া হয়েছে। তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিম্বারের উপর দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তণের পর বললেন, ‘আমার প্রেরিত কর্মচারীর কী হলো, সে বলে এটা জাকাতের সম্পদ আর ওটা আমি হাদিয়াস্বরূপ পেয়েছি। সে তার বাপ-মার ঘরে বসে দেখতে পারে না তাকে হাদিয়া দেওয়া হয় কিনা? আল্লাহর কসম করে বলছি তোমাদের কেউ খেয়ানত করলে তা নিজের কাঁধে নিয়েই কেয়ামতের ময়দানে উপস্থিত হবে। উট, গরু, বা ছাগল যাই হোক সেগুলো আওয়াজ করতে থাকবে। এরপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উভয় হাত উত্তোলন করে দুবার বললেন, হে আল্লাহ! আমি পৌঁছে দিয়েছি।’ (বুখারি, হাদিস নং-৬৫৭৮, ৮৮৩) সুতরাং সরকারি বা বেসরকারি কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী তার দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়মিত বেতন-ভাতা পাওয়া সত্ত্বেও যদি বাড়তি কিছু অবৈধ পন্থায় গ্রহণ করে তাহলে তা ঘুষ হবে। তখন বিনা সাওয়ালে দেওয়া হোক বা খুশি মনে দেওয়া হোক। সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল পদে থেকে হারাম অর্থ গ্রহণ করা হচ্ছে ঘুষ। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ঘুষ প্রদানকারী ও গ্রহণকারী উভয়ের ওপরই আল্লাহর লানত।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-২৩১৩)

এ ব্যাধি সংক্রমিতভাবে দিন দিন বাড়ছেই। ঘুষ দানকারী-প্রদানকারী এবং সহযোগীরাও সমান অপরাধী। এর জন্য সবাই সমানভাবে লানতের কবলে পড়বে। এ ঘুষ লালিত দেহের ইবাদত আল্লাহ কবুল তো করবেনই না বরং তাদের জন্য লাঞ্ছনা, আখিরাতের আগুন অপেক্ষা করছে। ইহুদিদের দুর্গতির কারণ হিসেবে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা মিথ্যা শ্রবণে অত্যন্ত আগ্রহশীল এবং অবৈধ (ঘুষ-সুদ) ভক্ষণে অত্যন্ত আসক্ত।’ (সুরা মায়েদা. আয়াত-৪২) আল্লাহতায়ালা অপর আয়াতে বলেন, ‘হে নবী আপনি (আহলে কিতাবদের) অনকেকেই দেখবেন পাপে সীমালঙ্ঘনে ও অবৈধ (ঘুষ-সুদ ইত্যাদি) ভক্ষণে তৎপর। তারা যা করে নিশ্চয় তা নিকৃষ্ট।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত-৬২) সুতরাং জীবনের যে কোনো ক্ষেত্রে, যে কোনো প্রকারেই হোক, ঘুষ নেওয়া ও দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে এবং অপরকেও রাখতে হবে।

বর্তমানে আরেক মহাদুর্যোগ শুরু হয়েছে যে, ঘুষকে আর এখন ঘুষ বলে না। কেউ তাকে হাদিয়া বলে। কেউ তাকে উপহার, উপটৌকন, সম্মানীসহ বিভিন্ন নামে গ্রহণ করছে। কেউ যুক্তি দাঁড় করাচ্ছে আমিতো তার কাছে চাই না। তাই হাদিয়া হবে। জলজ্যান্ত একটি হারামকে এখন হারামও মনে করছে না মুসলমান; বরং তাকে হালাল করার জন্য কোরআন-হাদিস এবং দেশের আইনের অপব্যাখ্যা করছে ও বোল পাল্টাচ্ছে। ঘুষ হারাম শব্দ পরিবর্তন করে তাকে হালাল করা যাবে না; বরং শব্দ পরিবর্তনের জন্যও রয়েছে শাস্তির ব্যবস্থা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এরপর জালিমরা বদলে দিল যা তাদের বলা হয়েছিল। তার পরিবর্তে অন্য কথা। এ কারণে যারা জুলুম করল তাদের ওপর নাজিল করালাম আকাশ হতে এক মহাশাস্তি। কারণ তারা অধর্ম-অন্যায় কাজ করেছিল।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত-৫৯) যদি কেউ ঘুষকে হাদিয়া বা উপটৌকন, সম্মানী ইত্যাদি নাম দিয়ে ভক্ষণ করার ফন্দি-ফিকিরে লিপ্ত থাকে, তাদের সাবধান হওয়া চাই! ইসলামে মন্দকে মন্দ বলা যথার্থ, যদিও সে মন্দে লিপ্ত। যদি হারামকে হালাল মনে করা হয় এবং হারামকে হালাল শব্দ দিয়ে নিশ্চিন্তে গ্রহণ করে তবে ঈমানের সমস্যা হয়ে যাবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা নিজ হাতে কিতাব রচনা করে এবং তুচ্ছমূল্য প্রাপ্তির জন্য বলে এটি আল্লাহর নিকট হতে এসেছে। তাদের হাত যা রচনা করেছে তার জন্য শাস্তি তাদের এবং যা তারা উপার্জন করে তার জন্যও শাস্তি তাদের।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত-৭৯)

ঘুষ এখন সামাজিক একটি বড় ধরনের ব্যাধিতে রূপান্তরিত হয়েছে। বর্তমানে এটা দেশে বড় মহামারী আকার ধারণ করেছে। সরকার শত চেষ্টা করেও তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। অধিদপ্তর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, স্কুল পরিদর্শনে গেলে খাম রেডি থাকে। তারা যেয়ে খেয়ে-দেয়ে খাম নিয়ে এসে রিপোর্ট করে দেন। তিনি আরো বলেন, আমার বলার সাহস নেই যে, ঘুষ খাবেন না; তা অর্থহীন হবে। একজন দেশের পদস্থ ব্যক্তি এ ঘুষখোরদের কাছে কত অসহায় বোধ করলে এমন কথা বলতে পারে। দেশের যেখানে রন্দ্রে রন্দ্রে এখন ঘুষ সেখানে এক দুজনের কিইবা করার আছে? এ ঘুষের প্রচলন শুধু বর্তমানে নয় হাজার বছর আগেও ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের এক রাজ উপদেষ্টা বলেছিলেন, জিহ্বার ডগায় বিষ বা মধু থাকলে তার স্বাদ না নিয়ে নির্লিপ্ত থাকা অবাস্তব, তেমনি অসম্ভব হলো সরকারের তহবিল নিয়ে যারা লেনদেন করেন, তাদের একটুকুও সরকারের সম্পদ চেখে না দেখা। ঘুষ দুর্নীতি যদিও হাজার বছর ধরে চলে আসছে কিন্তু ইসলাম ধর্মে এ ঘুষকে হারাম ঘোষণা করেছে। তখন থেকে মুসলিমগণ ঘুষ গ্রহণ করতেন না।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, দারুল ইসলাম ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা, সাভার, ঢাকা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads