হাজী শরীয়ত উল্লাহর নামানুসারে শরীয়তপুর

ছবি : বাংলাদেশের খবর

ফিচার

হাজী শরীয়ত উল্লাহর নামানুসারে শরীয়তপুর

  • আবুল হোসেন সরদার, শরীয়তপুর
  • প্রকাশিত ২৭ নভেম্বর, ২০১৮

শরীয়তপুর জেলা গঠনের ইতিহাস বেশি দিনের নয়। এ অঞ্চলের জনগণের কৃতিত্ব সেই প্রাচীনকাল থেকেই দীপ্যমান। বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাসের মতো এ অঞ্চলের ইতিহাসও সুপ্রাচীন। উপমহাদেশের ফরায়েজী আন্দোলনের বিখ্যাত নেতা হাজী শরীয়ত উল্লাহর নামানুসারে ১৯৭৭ সালে মাদারীপুর মহকুমার পূর্বাঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় শরীয়তপুর মহকুমা। ১৯৮৪ সালে গঠিত হয় শরীয়তপুর জেলা। শরীয়তপুর গৌরবময় ঐতিহ্যমণ্ডিত বর্ধিষ্ণু জেলা। এ জেলার জনগণ আদিযুগ, মুগল যুগ, ব্রিটিশ, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলের সব অধ্যায়েই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। যা দেশের অন্যান্য জেলার চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে বেশি। এ অঞ্চলটি একদা ঢাকা, বাকেরগঞ্জ ও ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত ছিল। ইতিহাসে এ অঞ্চল দক্ষিণ বিক্রমপুর নামে খ্যাত। মুঘল আমলে এ অঞ্চলটির উল্লেখযোগ্য ইতিহাস রয়েছে। ইতিহাসে বিখ্যাত বার ভুঁইয়া চাঁদ রায়-কেদার রায়ের রাজধানী শ্রীপুর, রাজা রাজবল্লবের রাজনগর, সুরম্য অট্টালিকা, মসজিদ, মন্দির, দীঘি পুকুরের অনেক কিছু প্রমত্তা পদ্মা গ্রাস করেছে। এককালীন প্রমত্তা পদ্মা শ্রীপুর, রাজনগর, জপসা, কাউলীপাড়া প্রভৃতি স্থানের ঐতিহাসিক কীর্তিসমূহ গ্রাস করে নয়া ভাঙ্গনী-নয়া নদী রথখোলা-ব্রহ্মবাধিয়া এবং সর্বশেষ কীর্তিনাশা নামে পরিচিত হয়। তার গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাস অনেকেরই জানা নেই। এ নদী আজ একটি অতিকায় দীর্ঘ মৃত সাপের আকার ধারণ করেছে। যেসব পুরাকীর্তি ও ঐতিহাসিক নিদর্শন আজো দেখতে পাওয়া যায়। তা প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য অর্থাৎ তৎকালীন স্থাপত্যশৈলীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এখানকার তালুকদার, ভুঁইয়া ও জমিদারদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জীবন সংগ্রামের কাহিনীও কম চমকপ্রদ নয়। পদ্মা-মেঘনা অববাহিকা অঞ্চলের এ জেলার জনগণের জীবনের সব অধ্যায়েই রয়েছে সক্রিয়ও বলিষ্ঠ অংশগ্রহণ। যা বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে স্বাতন্ত্র্যের দাবিদার। বিভিন্ন সামন্ত প্রভু, রাজা দ্বারা এ অঞ্চল শাসিত ছিল। বঙ্গ পদ্মা নদীর দক্ষিণে বদ্বীপ অঞ্চলে বিস্তৃত তৎকালীন রাজ্যের নাম। এটি তৎকালীন ভাগীরথী এবং পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের দক্ষিণ অঞ্চল নিয়ে বিস্তৃত। কালিদাসের রঘু ভানসা গ্রন্থে তিনি এ অঞ্চলকে গঙ্গা নদীর প্রবাহের দ্বীপদেশ বলে আখ্যায়িত করেন। যার অধিবাসীরা জীবনের সব কর্মকাণ্ডে নৌকা ব্যবহার করত। এমনকি যুদ্ধেও নৌকা ব্যবহার করত। এ অঞ্চলের জনসাধারণ নৌবিদ্যায় পারদর্শী ছিল। পরবর্তী সময়ে বদ্বীপ অঞ্চল ক্রমে দক্ষিণে সরে যায় এবং ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা ও অন্যান্য নদীবাহিত পলি দ্বারা এ অঞ্চল গঠিত হয়। এ জেলার মানুষ অনেকটা স্বাধীনচেতা। ১৮৬৯ সালের পূর্বাবধি এ অঞ্চল বিক্রমপুরের অংশ হিসেবে শাসিত ছিল। পদ্মার গতি পরিবর্তনের ফলে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ব্রিটিশ সরকার পদ্মার দক্ষিণাঞ্চলকে বাকেরগঞ্জ জেলার অন্তর্গত করেছিল। ১৮৬৯-১৮৭৩ সাল পর্যন্ত মাত্র চার বছর এটি বাকেরগঞ্জ জেলার অন্তর্গত ছিল। এ অঞ্চলের জনগণের বিরোধিতার প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার এ অঞ্চলসহ মাদারীপুর মহকুমাকে ১৮৭৩ সালে ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত করে দেয়। ১৯৭৭ সালে শরীয়তপুরকে মহকুমা হিসেবে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা আবদুল মোমেন খান। প্রথম মহকুমা প্রশাসক ছিলেন আমিনুর রহমান। তখন শরীয়তপুরের রাস্তাঘাট ছিল কাঁচা। একটি থানা সদরকে ধীরে ধীরে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে জীপ চালানোর ব্যবস্থা গড়ে তোলেন তিনি। ১৯৮৩ সালের ৭ মার্চ জেলা ঘোষণা করা হলেও ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ শরীয়তপুর জেলার উদ্বোধন ঘোষণা করেন তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী নাজিম উদ্দিন হাসিম। এ জেলার আয়তন প্রায় ৪৫৫ বর্গমাইল। এ জেলার উত্তরে মুন্সীগঞ্জ, দক্ষিণে বরিশাল, পশ্চিমে মাদারীপুর, পূর্বে চাঁদপুর জেলা। এ জেলায় লোকসংখ্যা ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ১০ লাখ ৮ হাজার (বর্তমানে অনেক বেশি)। এ জেলার শিক্ষার হার প্রায় ৫৩ শতাংশ। এ জলায় ৭টি থানা ও ৬টি উপজেলা ৫টি পৌরসভা, ৬৪টি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। উপজেলাগুলো হচ্ছে শরীয়তপুর সদর, জাজিরা, নড়িয়া, ভেদরগঞ্জ, ডামুড্যা ও গোসাইরহাট। এ জেলায় রয়েছে তিনটি সংসদীয় আসন। পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনেও এ দেশের মুসলিম জনগণের ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ। খান সাহেব আ. আজিজ মুন্সি, নয়ন সরকার, আ. রশিদ সরকার, মেজবাহ উদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরী, আলহাজ গিয়াস উদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরী, খান বাহাদুর খলিলুর রহমান শিকদার প্রমুখ তখন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক, সাবেক ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলী, শহীদ সিরাজ উদ্দিন আহম্মেদ সিরাজ সরদার, কমরেড সিরাজ সিকদার, ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান বিশিষ্ট সমাজসেবক জয়নুল হক সিকদার, সরদার একেএম নাসির উদ্দিন কালু, কেএম হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গসহ বহু লোক অংশগ্রহণ করেন। এ জেলা সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও পিছিয়ে নেই। বাংলা ভাষার অন্যতম সেরা গীতিকার ব্যারিস্টার অতুল প্রসাদ সেনের বাড়ি এ জেলার নড়িয়া উপজেলার মগর গ্রামে। সুসাহিত্যিক কবি ইসহাকের বাড়ি এ জেলার নড়িয়া উপজেলার শিরংগল গ্রামে। সাহিত্যিক অমলেন্দু দে একই উপজেলার ভোজেশ্বরে জন্মগ্রহণ করেন। এ ছাড়া সাহিত্যিক দেবদাস গুপ্ত, লায়লা রশিদ, সাবিত্রি রায়, ড. সুনীল মুখোপাধ্যায়, সুরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, রথীন্দ্র কান্ত ঘটক চৌধুরী, খোরশেদ আলম, ডা. মোসলেহ উদ্দিন খান, এমএ আজিজ মিয়া, আ. রব সিকদারের বাড়ি এ জেলায়। দেশখ্যাত ভাস্কর শিল্পী আবদুর রাজ্জাক ও শামীম শিকদারের বাড়ি এ জেলায়। ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলার বাড়ি নড়িয়া উপজেলার পোড়াগাছা গ্রামে। এ জেলায় কীর্তিসমূহের মধ্যে রয়েছে ধানুকার মনসা বাড়ি, ফতেজংপুর দুর্গ, কেদারপুর কেদার রায়ের বাড়ি, হাটুরিয়া জমিদার বাড়ি, কার্তিকপুর জমিদার বাড়ি মহিষারের দীঘি, বুড়িরহাট জামে মসজিদ, রামভদ্রপুরের কোকোলা মসজিদ ও রামঠাকুরের মন্দির, সুরেশ্বর দরবার শরীফ, রুদ্রকরের মঠ, ভোজেশ্বরের শিবমন্দির প্রভৃতি। এ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় পদ্মা, মেঘনা, কীর্তিনাশা ও আড়িয়াল খাঁর কিয়দংশ। এ জেলার মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মিত হচ্ছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি মানুষ জীবন-জীবিকার তাগিদে ইতালি, আমেরিকা, গ্রিস, কানাডা, দুবাই, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, জার্মান, স্পেনসহ বিভিন্ন দেশে বসবাস করছে। এ জেলার পদ্মার ইলিশ, নড়িয়ার সন্দেশ, পালংয়ের কাঁসা-পিতল খুবই খ্যাত।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads