এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকির বিশালতার প্রবাদ আছে বেটা কইলে মামদ মনসুর, আর সব পুয়া (ছেলে) হাওর কইলে হাকালুকি আর সব কুয়া (কূপ)...। বছরের পুরোটা সময়ই এ হাওরের বিশালতা ও সুন্দর্য্য উপভোগ করতে হাজার হাজার পর্যটক ভিড় জমান মিঠাপানির এ হাওরে। বর্ষায় থৈ থৈ করা পানির ছলাত ছলাত শব্দে আকৃষ্ট হয়ে ভির করেন পর্যটকরা। এমনকি শীতেও হাওরের ঘাসের শিশির বিন্দু পায়েং মাখতে হাজারো মানুষ ভির জমান। আর এ হাজার হাজার মানুষের আগমন উদ্বেগেরও কারণ। বিশেষজ্ঞদের মতে ‘প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা’ (ইসিএ) হিসেবে ঘোষিত হাওরে ইকো ট্যুারজম গড়ে তুলতে হবে। নয়তো ভয়াবহ সঙ্কটে পড়বে দেশের একমাত্র মিঠাপানির এই মৎস্য প্রজনন কেন্দ্রটি।
হাকালুকি হাওরের আয়তন ১৮হাজার ১১৫ হেক্টর, তন্মধ্যে শুধুমাত্র বিলের আয়তন ৪ হাজার ৪০০ হেক্টর। হাওরটি মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া, বড়লেখা ও জুড়ী এবং সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ উপজেলার ১১ টি ইউনিয়ন জুড়ে বিস্তৃত।
বর্ষা এবং শীত উভয় ঋতুতে হাওরে ঘুরে বেড়ানোর জন্য উপযোগী। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের অপূর্ব লীলাভূমি হাওরটি বছরের বিভিন্ন মৌসুমে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে। ছোট-বড় ২৩৪ টি বিল ও ছোট-বড় ১০ টি নদীর মিলে হাকালুকি হাওর বর্ষাকালে এর আয় ১৮ হাজার হেক্টরের বেশি। এই হাওরে বাংলাদেশের মোট জলজ উদ্ভিদের অর্ধেকের বেশি এবং সঙ্কটাপন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি পাওয়া যায়।
শীতকালে হাওরের দিগন্ত বিস্তৃত প্রাকৃতিক দৃশ্য ও বিলের কান্দিগুলো সত্যিই দৃষ্টিনন্দন। চারিধারে জেগে থাকা সবুজ ঘাসের গালিচায় মোড়া কিঞ্চিত উঁচুভূমি বিলের পানিতে প্রতিচ্ছবি ফেলে সৃষ্টি করে অপরূপ দৃশ্যের। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় হাওরের জলরাশির মাঝে সূর্যের প্রতিচ্ছবি বেশ মনোমুগ্ধকর।
সারাবছরই পাখির দেখা মেলে হাকালুকি হাওরে। তবে শীতকালে অতিথি পাখিদের সমাগমে গোটা হাওর জুড়ে পাখির কলকাকলীতে মুখরিত থাকে হাওর। বর্ষাকালেও পাখির জলকেলি নজর কাড়ে পর্যটকদের।
হাওরের উল্লেখযোগ্য ও বিশাল আকারের বিলের মধ্যে যেগুলোর নাম লোকমুখে শুনা যায় তাহলো- চাতলা, চকিয়া, ফুটবিল, তেকুনি বিল, পিংলা, তুরল, তেকুনি বিল, জল্লা, ফুয়ালা, কৈয়ারকোনা, বালিজুড়ি, কুকুরডুবি, দুধাই, হাল্লা, উজান তুরণ, চিকনউটি, ধলিয়া প্রভৃতি। এসব বিলগুলোতে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। হাওরের স্বাদু ও মিঠাপানির বিভিন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে রুই, বাউশ, আইড়, চিতল, পাবদা, মাগুর, শিং, কৈসহ আরও নানা প্রজাতির মাছ।
হাকালুকি হাওর বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন রূপ ধারন করে। বর্ষাকালে এই হাওরে ধারণ করে এক অনবদ্য রূপ। চারদিকে শুধু পানি আর পানির খেলা। সে এক অপরূপ দৃশ্য। পুরো হাওরটি যেন এক অথৈ সাগরে পরিণত হয়। সমুদ্রের মতো বিশাল ঢেউ, চারদিকে পানি আর পানি। অনেক দূরে দূরে গ্রাম।
পুরো হাওর দর্শনের জন্য রয়েছে একাধিক ওয়াচ টাওয়ার। সেইসব ওয়াচ টাওয়ারে চড়ে হাওরের রূপ লাবন্য দর্শণ করতে পারেন অনায়াসে। অথবা হাওরের বুকে জেগে উঠা জলাবন বা সোয়াম ফরেস্টে নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন।
হাকালুকি হাওরে বিভিন্ন জাতের উদ্ভিদ জন্মে। এরমধ্যে ৫২৬ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪১৭ প্রজাতির পাখি, এরমধ্যে ৫০-৫৫ প্রজাতির লাখ লাখ অতিথি পাখি ও দেশীয় প্রজাতির পাখির সমাগম ঘটে। ১৪১ প্রজাতির অনান্য বন্যপ্রাণী, ১০৭ প্রজাতির মাছ। ১২০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, বিলুপ্ত প্রায় ২০ প্রজাতির সরীসৃপ। এছাড়াও রয়েছে নানা ধরনের কীট-পতঙ্গ, জলজ ও স্থলজ ক্ষুদ্র অনুজীব।
হাকালুকি হাওরের বিশাল প্রান্তরে শুষ্ক মৌসুমে অবাধে বিচরণ করে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা গরু-মহিষ, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি। হাওর তীরবর্তী এলাকার লোকজন, ফসল উঠে গেলে বছরের শুষ্ক মৌসুমের নির্দিষ্ট কয়েক মাস তাদের গৃহপালিত গবাদি পশু পাঠিয়ে দেন হাওরে বসবাসরত একশ্রেণির মানুষের কাছে, যারা এগুলোর তত্ত্বাবধান করে। এই কাজের বিনিময়ে এরা দুধ পায়। বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে প্রকৃত মালিক এসে গরু-বাছুর ফেরত নেয়। এই পুরো ব্যবস্থাকে হাওর এলাকায় "বাথান" বলা হয়। বাথানের মালিকেরা এসকল গবাদি পশুর দুধ বিক্রি করে প্রচুর উপার্জন করে থাকেন। একারণে হাকালুকি হাওর এলাকা স্থানীয়ভাবে দুধ ও দইয়ের জন্য বিখ্যাত।
উপরোক্ত প্রাকৃতিক উপাদান ছাড়াও রয়েছে স্থানীয় পেশাজীবি মানুষের ইতিহাস, সামাজিক আচার, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ। হাকালুকি হাওর টেকসই উন্নয়ন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, ইকো টুরিজ্যম শিল্প বিকাশের এক অসাধারণ স্থান।
প্রতিনিয়ত হাকালুকি হাওরে পর্যটকদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠে। বিচ্ছিন্নভাবে এসব পর্যটকরা উল্টো হাকালুকি হাওরের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছেন। প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে এই হাওরে ইকো ট্যুরিজম গড়ে তোলাই সময়ের প্রধান দাবি হয়ে উঠেছে।
হাকালুকি হাওরের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার ঘিলাছড়া ইউনিয়নের জিরো পয়েন্ট, কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল ইউনিয়নের পালের মোরা, জয়চন্ডী ইউনিয়নের আছুরীঘাট ও সবক’টি ওয়াচ টাওয়ারকে ঘিরে পর্যটকদের বেশি ভীড় পরিলক্ষিত হয়।
এব্যাপারে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন জানান, হাওরকে ঘিরে পর্যটন শিল্পকে আরও প্রসার ঘটানোর পরিকল্পনা রয়েছে। অবশ্যই ইকো ট্যুরিজমের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। ইতোমধ্যে হাওরে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অবশ্যই এমন কোন কাজ হবে না, যাতে হাওরের জীববৈচিত্র্য কিংবা ইকো সিস্টেমের উপর প্রভাব পড়ে।