কিশোরগঞ্জ হলো হাওর-বাঁওড় ও সমতলভূমির বৈচিত্র্যময় ভূ-প্রকৃতির একটি বিস্তীর্ণ জনপদ। লোকজ সাহিত্য-সংস্কৃতিতে এ জেলার রয়েছে বিশাল ঐতিহ্য। কেবল ভূ-প্রকৃতিগত বৈচিত্র্যের কারণে নয়- অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দৃষ্টিকোণ থেকেও এক বিরাট স্থান জুড়ে আছে হাওর। কিশোরগঞ্জ জেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, মাটি ও মানুষের তথ্য নিয়ে আজকের আয়োজন গ্রন্থনা ও সম্পাদনা করেছেন সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
কিশোরগঞ্জ জেলা হলো হাওর-বাঁওড় ও সমতলভূমির বৈচিত্র্যময় ভূ-প্রকৃতির একটি বিস্তীর্ণ জনপদ। ২৪ ডিগ্রি ০২ মিনিট থেকে ২৪ ডিগ্রি ৩৮ মিনিট উত্তর অক্ষাংশ নরসুন্দা নদী বিধৌত এ জেলার উত্তরে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জ; দক্ষিণে নরসিংদী, পূর্বে হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং পশ্চিমে গাজীপুর ও ময়মনসিংহ জেলা অবস্থিত। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাহিত্যিক নিরোদচন্দ্র চৌধুরী তার ‘ঞযব অঁঃড়নরড়মৎধঢ়যু ড়ভ ধহ ঁহশহড়হি ওহফরধহ’ গ্রন্থের শুরুতেই গর্ব করে লিখেছেন, করংযড়ৎবমধহল রং সু নরৎঃয ঢ়ষধপব. লোকজ সাহিত্য-সংস্কৃতিতে এ জেলার রয়েছে বিশাল ঐতিহ্য।
কিশোরগঞ্জ জেলার ইতিহাস সুদীর্ঘ এবং তার ঐতিহ্য ব্যাপকভাবে প্রসারিত। প্রশাসনিক পরিসরে এটি দেশের অন্যতম বৃহত্তম জেলা হিসেবে পরিচিত। গ্রামবাংলার শাশ্বত রূপ-বৈচিত্র্য ও সোনালি ঐতিহ্যের ধারায় কিশোরগঞ্জের রয়েছে একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস। ১৭৮৭ সালের ১ মে ভারতীয় উপমহাদেশের একসময়কার বৃহত্তম জেলা ময়মনসিংহ প্রতিষ্ঠিত হয়। আজকের কিশোরগঞ্জ জেলা তখনকার ময়মনসিংহের অন্তর্গত ছিল। ঐতিহ্যবাহী জেলা হিসেবে কিশোরগঞ্জ আজ সর্বমহলে স্বীকৃত; কেননা প্রাচীন ইতিহাসসমৃদ্ধ উপরেল্লিখিত অঞ্চলগুলো বর্তমান কিশোরগঞ্জেরই অন্তর্গত। বিচ্ছিন্নভাবে প্রাপ্ত ইতিহাসের উপাদান বিশ্লেষণ করে জানা যায় মহাকাব্যের যুগে এ অঞ্চল কামরূপ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। তারপরে গুপ্ত, বর্মণ, পাল ও সেন বংশ রাজত্ব করে এ অঞ্চলে। তবে কোনো বংশই এ অঞ্চল পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। তৎকালে এ অঞ্চলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্যের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ী ছিল স্বাধীন ক্ষুদ্র রাজ্যের পীঠস্থান। মধ্যযুগে আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে (১৪৯৩-১৫১৯) খ্রিস্টাব্দে বৃহত্তর ময়মনসিংহে মুসলিম শাসন বিস্তৃত হয়। কোচ অধ্যুষিত সমগ্র কিশোরগঞ্জ অঞ্চল মুসলিম শাসনের অধীনে আসে সম্রাট আকবরের সময়।
১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে কিশোরগঞ্জ মহকুমার জš§ হয়। মহকুমার প্রথম প্রশাসক ছিলেন মি. বকসেল। বর্তমান কিশোরগঞ্জ তৎকালীন জোয়ার হোসেনপুর পরগণার অন্তর্গত ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তেও কিশোরগঞ্জ এলাকাটি ‘কাটখালী’ নামে সমধিক পরিচিত ছিল। জনশ্রুতি থেকে অনুমান করা হয়, এ জেলার জমিদার ব্রজকিশোর মতান্তরে নন্দকিশোর প্রামাণিকের ‘কিশোর’ এবং তার প্রতিষ্ঠিত হাট বা গঞ্জের ‘গঞ্জ’ যোগ করে ‘কিশোরগঞ্জে’র নামকরণ করা হয়েছে। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে মহকুমা হওয়ার সময় থানা ছিল ৩টি। যথা- নিকলী, বাজিতপুর ও কিশোরগঞ্জ। পরবর্তীকালে ১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ১৩টি থানা নিয়ে জেলা ঘোষণা করা হয়।
যে কয়েকজন সূর্যসন্তান দেশসহ বিশ্বের বুকে কিশোরগঞ্জের নাম ছড়িয়েছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেনÑ মনসামঙ্গলের কবি দ্বিজ বংশীদাস, বাংলাদেশের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী, সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম কৃষিমন্ত্রী মরহুম হামিউদ্দিন আহমেদ (খানসাহেব), ইতিহাসবেত্তা নীহাররঞ্জন রায়, লেখক ও গবেষক কেদারনাথ মজুমদার, বাংলার বারোভুঁইয়া বা প্রতাপশালী বারোজন জমিদারের প্রধান ঈশা খাঁ, শিক্ষাবিদ প্রবোধ চন্দ্র গোস্বামী, কূটনীতিক ও রাজনীতিবিদ আবুল ফতেহ, চিকিৎসক ও বুদ্ধিজীবী শহীদ ডা. এ এফ এম আবদুল আলীম চৌধুরী, অগ্নিযুগের বিপ্লবী মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক ও বাংলা মুদ্রণশিল্পের অন্যতম পথিকৃৎ উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী, শিক্ষাবিদ আনন্দমোহন বসু, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাস, পণ্ডিত ও লেখক নীরোদচন্দ্র চৌধুরী, অবিভক্ত ভারতের ছাত্র আন্দোলনের জনক রেবতী মোহন বর্মণ, বিখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়, শিশুসাহিত্যিক সুকুমার রায়, বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, বরেণ্য রাজনীতিবিদ আইভী রহমান, আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী মরহুম সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, শিল্পপতি জহুরুল ইসলাম, বীরপ্রতীক মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন ডা. সেতারা বেগম, প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ আবুল কাসেম ফজলুল হক, ব্যারিস্টার ভূপেশগুপ্ত এবং চলচ্চিত্র অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন।
খেলাধুলা ও বিনোদন
প্রাচীনকাল থেকেই কিশোরগঞ্জ জেলায় নানা ধরনের ক্রীড়ানুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে থাকে। বর্তমানেও এ জেলা খেলাধুলার ঐতিহ্যগত ভাবমূর্তি অক্ষুণœ রেখে স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্রীড়াক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখছে। প্রাচীনকাল থেকেই এ জেলার খেলাধুলাকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়ে আসছে নানা বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান। বিয়ে কিংবা সুন্নতে খাৎনা অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে জমজমাট লাঠিখেলার আয়োজনের রীতি এখনো এ অঞ্চলের মানুষকে আমোদিত করে। একদল লোক পায়ে ঘুঙুর পরে বিচিত্র পোশাকে ঢোল-বাদ্যযন্ত্রের তালে একজন দুটি লাঠি হাতে পরস্পরের সঙ্গে লাঠালাঠি করতো। এ ছাড়া এ জেলায় অঞ্চলভিত্তিক বেশকিছু জনপ্রিয় খেলাধুলা ছিল। তার মধ্যে তাড়াইল উপজেলার জাওয়ার এলাকার ষাঁড়ের লড়াই, ঘোড়া দৌড়, সদর উপজেলার বৌলাই ও বিন্নাটি গ্রামের লাঠিখেলা। একসময় কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর অঞ্চলে একচইল্ল্যা বা হুমলি খেলা অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। রাখাল ছেলেদের মধ্যে জনপ্রিয় খেলা ছিল ভাইয়া ডুকু বা গোল্লাছুট খেলা, মনগুডা খেলা। এ ছাড়া লাটিম, ডাংগুটি, হাড়াইয়া ইত্যাদি খেলা প্রচলিত ছিল। মেয়েদের খেলাধুলার মধ্যে ছিল পলাপলি কানামাছি, গুটি লুকানো, তোপাভাতি ইত্যাদি। পাকিস্তান আমল থেকেই এ অঞ্চলে ফুটবল ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয় খেলা। এ জেলার অনেক কৃতী ফুটবলার জাতীয় পর্যায়ে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুনাম বয়ে আনেন। কিশোরগঞ্জ সদরে দুটি স্টেডিয়াম রয়েছে, পাশাপাশি বিভিন্ন উপজেলায়ও বেশ কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী খেলার মাঠ রয়েছে, যেখানে নিয়মিত ক্রীড়াচর্চা হয়ে থাকে। গুরুদয়াল সরকারি কলেজ মাঠ, বাজিতপুর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ডাকবাংলোর মাঠ, কটিয়াদীর বোয়ালিয়ার মাঠ, ভৈরবের স্টেডিয়াম উল্লেখযোগ্য। এসব মাঠে কাবাডি, দাঁড়িয়াবান্দা, ফুটবল, ক্রিকেট ইত্যাদি খেলা নিয়মিত আয়োজন করা হয়। এ জেলার বিস্তীর্ণ জনপদ হাওর অঞ্চলের অন্যতম জনপ্রিয় ক্রীড়া সাঁতার। দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা সাফ গেমসে সাঁতারে স্বর্ণপদক জয় করে এ জেলাকে গর্বিত করেছেন নিকলী উপজেলার সোনার ছেলে কারার মিজান।
কিশোরগঞ্জে প্রচলিত পালাগান, যাত্রা, মেলা, বাউলগান, পুঁথি, জারি- এগুলো আজ আমাদের দেশে লোকসাহিত্যের মর্যাদা লাভ করেছে। প্রাচীন ময়মনসিংহের বর্ধিষ্ণু জনপদ এই কিশোরগঞ্জ জেলার আদি বাঙালি মহিলা কবি চন্দ্রাবতী কিংবা তার পিতা দ্বিজ বংশীদাস যেসব পালাসাহিত্য রচনা করেছেন, তা কিশোরগঞ্জের লোকজ ভান্ডারকে সমৃদ্ধ ও পরিচিত করেছে। একইসঙ্গে বৈষ্ণব পদাবলীসহ পালাগান, মলুয়া-চাঁদ বণিকের কাব্য, মলুয়া এবং দেওয়ানা পালা গানের পাশাপাশি কারবালার মর্মন্তুদ কাহিনী নিয়ে মর্মস্পর্শী জারিগান, ঘাটুগান, নৌকাবাইচের গান, সারিগান, কবিগান, পুঁথি পাঠ এবং বিয়ের রকমারি গান এখানে খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। শুধু গান কেন- যাত্রাপালা, নাটক ও নাট্যপালা মঞ্চায়নেও এ জেলার রয়েছে গর্ব করার মতো সমৃদ্ধ ইতিহাস। এছাড়া বিনোদনের জন্য এ জেলায় রয়েছে ২০টি সিনেমা হল এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ভৈরব ও আশুগঞ্জের মধ্যে মেঘনা নদীর ওপর স্থাপিত বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য মৈত্রী সেতু। আধুনিক স্থাপত্যকলার কারণে সেটি বর্তমানে অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র তথা দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
তথ্যসূত্র : জেলা তথ্যবাতায়ন ও ইন্টারনেট





