হত্যা মামলার আসামি যখন প্রধান শিক্ষক!

অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক বেলায়েত হোসেন বাদল

ছবি : সংগৃহীত

সারা দেশ

হত্যা মামলার আসামি যখন প্রধান শিক্ষক!

  • অনলাইন ডেস্ক
  • প্রকাশিত ৪ জুলাই, ২০১৯

কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলা জারইতলা উচ্চ বিদ্যালয়ের অনিয়ম আর দুর্নীতির শেষ নাই। এবছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে মোট এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল ২৫০জন। এর মধ্যে কৃতকার্য হয়েছে ১৫১জন। পাশের হার ছিলো ৬১%। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্র-ছাত্রীদের প্রশংসাপত্র দেওয়ার ব্যপারেও উঠেছে সমালোচনার ঝড়। ৫০০ টাকার বিনিময়ে প্রশংসাপত্র নিতে ছাত্র-ছাত্রীদের বাধ্য করছেন প্রধান শিক্ষক। বেশ কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী টাকা দেওয়ার বিষয়ে কোন নিয়ম আছে কি না জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক অশ্রাব্য ভাষায় গালমন্দ করতেও দ্বিধা করেননি। এমনকি কলেজে ভর্তি হলে পরীক্ষার কেন্দ্রে দেখে নেবেন বলেও হুঁশিয়ারি দেন। সেই সঙ্গে ফেল করিয়ে দেওয়ার হুমকিও দেন।

জারইতলা উচ্চ বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক বেলায়েত হোসেন বাদল হত্যা মামলার ১নং আসামি হিসাবে ২৩/০৫/১৯৯৬ তারিখে কটিয়াদী থানার এক মামলায় প্রধান আসামি হিসেবে অভিযুক্ত হয়ে দীর্ঘদিন হাজতবাসও করেন। যার মামলা নং-১৫।

এছাড়া দুর্নীতির দায়ে সাবেক সভাপতি বাবুল খাঁন সভাপতি থাকা অবস্থায় ২০০০ সালে দীর্ঘ একবছরের বেশী সময় বেলায়েত হোসেন বাদল সাময়িক বরখাস্তও ছিলেন। এমনকি কমিটির অনুমতি ছাড়া নিয়মবহির্ভূত কিশোরগঞ্জ বেসরকারী প্রাইম ইউনিভার্সিটি হতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। এ নিয়েও সমালোচনা রয়েছে। তার বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর অভিযোগের শেষ নাই। কিন্তু প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলার সাহস দেখায় না।

জানা যায়, ২ এপ্রিলের ২০১১ তারিখে ধারীশ্বর গ্রামের একটি মেয়েকে বোরখা পরিধান করে স্কুলে আসায় স্পর্শকাতর স্থানে বেত্রাঘাত করায় শতশত ছেলে-মেয়েরা ক্লাস পর্যন্ত বর্জন করে। এ বিষয়ে মেয়েটির বাবা সুরুজ আলী অভিযোগ করেও নানান কারণে ব্যর্থ হয়েছে। তার বিভিন্ন অনিয়ম আর দুর্নীতির তদন্ত বহুবার হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি।

এলাকায় বেলায়েত হোসেন বাদলের অগোচরে প্রতিবাদের ঝড় উঠলেও একের পর এক অপকর্ম করে পার পেয়ে যাচ্ছেন। বেলায়েত হোসেন বাদলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খোলার কারো সাহস নাই। তিনি এখন শিক্ষক ও রাজনৈতিক নেতা। আর তার নেপথ্যে রয়েছেন অত্র বিদ্যালয়ের বর্তমান সভাপতি জাকির হোসেন বাতেন।

এলাকায় আলোচনায় আছে, ঋণের দায়ে পাওনাদারের চাপে নিয়মিত ক্লাস পর্যন্ত করতে পারতেন না, ক্লাস পরিত্যাগ করারও গুঞ্জন আছে। পাওনাদার ব্যক্তিরা বাড়িতে, রাস্তাঘাটে এমনকি স্কুলে পর্যন্ত গিয়ে অশ্রাব্য বাক্যে লাঞ্ছিত করার ঘটনার কথাও জানা গেছে। প্রধান শিক্ষক হওয়ার পূর্বে কৌশলে তিনি ছাত্রদের নিকট হতেও টাকা ধার দেনা করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। প্রধান শিক্ষক হওয়ার পর একেবারে ভিন্ন রূপ! তিনি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জাঁকজমকভাবে প্রচুর অর্থ ব্যয়ে নির্বাচন করেও ব্যর্থ হয়েছেন।

এলাকাবাসী জানান, তার উস্কানিতেই জারইতলা উচ্চ বিদ্যালয় ২১মার্চ ২০১৩ সন্ধ্যালগ্নে বিদ্যালয় প্রাঙ্গন রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। ৩জন পুলিশ কর্মকর্তাসহ ১২জন পুলিশ সদস্য আহত হন এবং পুলিশের দুইটি গাড়িও ভাংচুর হয়। পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ২২ রাউণ্ড গুলি ছোড়ে এবং বেশ কয়েকজন নিরপরাধ ব্যক্তিও গুলিতে আহত হন। অথচ প্রধান শিক্ষক উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে প্রতিবাদ থামানোর জন্য ঘটনার সাথে জড়িত নয় এমন ব্যক্তিদের নামে একটি সাজানো মামলা দায়ের করেন, যার মামলা নং- ৯(৩)১৩। মামলার বাদীকে ভুল পরামর্শ দিয়ে হাজতে অবস্থানরত ব্যক্তি এবং দুবাই অবস্থানরত যুবককেও এই সাজানো মামলায় ফাঁসানো হয়।

এই মামলার ১নং আসামি কামরুল হাসান (রিগেন) বলেন, প্রধান শিক্ষক হিসেবে সরাসরি একটি কমিটির পক্ষ নেওয়া অযৌক্তিক এবং তার উস্কানিতেই সংঘর্ষ এমনকি তার উদ্দেশ্য পূরনের লক্ষ্যে সাজানো মামলায় বিনা অপরাধে একজন সাবেক ছাত্র হিসাবে হয়রানি করার বিষয়টি আমাকে হতাশ করেছে।

অপকৌশলে থাকা সভাপতি জাকির হোসেন বাতেন এবং প্রধান শিক্ষক বেলায়েত হোসেন বাদল ক্ষমতার দাপটে মনগড়া মতে স্কুল পরিচালনা করে আসছেন। কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না। প্রধান শিক্ষকের ব্যবহারে অধিকাংশ অভিভাবক অতিষ্ঠ কিন্তু ক্ষমতার নিকট অসহায় এই সকল মানুষগুলো।

জানা যায়, ২০১৯ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফরম ফিলাপ বাবদ বোর্ডের নির্দেশ ১৪৫০ টাকার স্থলে তিনি পাঁচ হাজার টাকা করে নিয়েছেন। এই বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য মো সবুজ মিয়া জানান, আমার মেয়ে মেধা তালিকায় পাশ করার পরও গত এসএসসি পরীক্ষার ফরম ফিলাপ বাবদ পুরো ৫০০০ টাকা দিয়েছি। তিনি আরো বলেন সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকের ক্ষমতার ভয়ে কেউ মুখ খুলেনি।

সাজনপুর মধ্যপাড়া গ্রামের লাল মিয়া পিতা মৃত রবিউল্লাহ ৮ম শ্রেণীর এক মেধাবী ছাত্রীর বাবা বলেন, আমি ২০ জুন লগ্নি করে টাকা এনে ২২০০ টাকা দিয়েছি। দিনমজুর বাবা হিসাবে মেয়েটির নাম বলতেও ভয় পাচ্ছেন কারণ প্রতিবাদ করতে মেয়েটি তাকে ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে নিষেধ করেছেন।

আঠারবাড়ীয়া গ্রামের একজন ক্ষুদ্র হোটেল ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বলেন, অভাব অনটনে আমার কোন রকম সংসার চলে। আমার মেয়ে বৃষ্টি আক্তার ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় জন্য ১৩১৪ টাকা দিতে না পারলে পরীক্ষা দিতে নিষেধ করেছেন বেলায়েত হোসেন বাদল। তাই টাকা যোগাড় করতে না পেরে পড়াশুনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন শিক্ষক বলেন, ঐ স্কুলে মোট ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যাঃ ৬ষ্ঠ শ্রেষ্ঠ ক, খ ও গ শাখায় যথাক্রমে ১১৯, ১১৯ ও ১০৫জন। ৭ম শ্রেণী যথাক্রমে ক, খ ও গ ১৩০, ১১৪ ও ৯০জন। ৮ম শ্রেণী ক ও খ ১২৬ ও ১২৪ জন। ৯ম শ্রেণী ক ও খ যথাক্রমে ১২৫ ও ৯৫ জন এবং ১০ম শ্রেণী যথাক্রমে ৩৭ ও ৮৯ জন। অত্র বিদ্যালয়ে মোট নিয়মিত ছাত্রীর সংখ্যা ১২৬৩।

অত্র বিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র হিসাবে নজরুল ইসলাম অভিমত প্রকাশ করে বলেন তুলনামুলকভাবে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হচ্ছে অথচ হিসাব অনুযায়ী বাৎসরিক লক্ষ লক্ষ টাকা আয় থাকার কথা কিন্তু শোনা যায় উল্টো চিত্র। দুদক চাইলে ম্যানেজিং কমিটি ও প্রধান শিক্ষকের যৌথ একাউন্ট তলবের মাধ্যমে সকল তথ্য বেরিয়ে আসতে বাধ্য, সাধারণ জনগণও অতিরিক্ত খরচ দেওয়া হতে পাবে স্বস্তি।

প্রধান শিক্ষক বেলায়েত হোসেন (বাদল) ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট হতে অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছেন এর জবাবে বলেন, এইতা সব রেজুলেশন অনুযায়ী নিকলী থানার অন্যান্য স্কুলের মতোই নিচ্ছি। আর ফরম ফিলাপ বাবদ ৫০০০ টাকা নেওয়ার বিষয়ে বলেন, যারা এই কথা কইছে “তারা চোর, বাটপার” পরবর্তীতে ফোন ব্যাক করে দম্ভের সাথে আবারো স্বীকারোক্তিমূলক ভাবে বলেন অভিভাবক সবাইকে নিয়ে অভিযোগ করুক, এই সব আমি কাউন্ট করি না। আর অতীতের অভিযোগের বিষয়কে তিনি পাত্তা দেননি এমনকি অতীতে বহু অভিযোগ হয়েছে বলে স্বীকার করে বলেন, এই সব নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নাই।

জারইতলা ইউনিয়নের অন্তর্গত রসুলপুর হানিফ ভুঁইয়া উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আসাদুজ্জামান বলেন, প্রশংসাপত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে টাকা নেওয়ার বিষয়ে কোন বাধ্যতামূলক নয়। কেউ মন চাইলে দেয় আর না দিলে টাকা নেওয়ার কোন নিয়ম নাই।

জারইতলা উচ্চবিদ্যালয়ের বর্তমান সভাপতি জাকির হোসেন (বাতেন)কে প্রশংসাপত্র বাবদ ৫০০টাকা করে বাধ্যতামূলক নেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে এই প্রসঙ্গে প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা বলার জন্য বলেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads