আজহার মাহমুদ
বর্তমান সময়টা পৃথিবীর জন্য খারাপ সময়। এটা আমরা সকলেই অনুধাবন করছি। কিন্তু আমরা এটাও বিশ্বাস করি পৃথিবীটা একদিন সুস্থ হবে। আমরা আবারো আগের মতোই আমাদের প্রিয় পৃথিবীকে ফিরে পাব। করোনাভাইরাস একদিন আমাদের কাছে ভাবনার বিষয় থাকবে না। ভ্যাকসিন বের হলেই সব ভয়ের সমাপ্তি ঘটবে। সব মিলিয়ে বলা যায় এই দুর্যোগ থেকে পুরো পৃথিবীই মুক্তি পাবে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়।
কিন্তু বাংলাদেশে যে বিষয়টি মানুষকে বেশি ভাবায়, তা হচ্ছে নিরাপদ সড়ক। আমরা হয়তো ভুলে যাইনি ছাত্রদের রাস্তায় নেমে পড়ার সেই দিনগুলোর কথা। আমরা ভুলিনি সড়কে কীভাবে আমার ভাইবোন অকাতরে প্রাণ হারিয়েছে। আন্দোলন থেমেছে, মানুষের আওয়াজ বন্ধ হয়েছে। কিন্তু সড়কে দুর্ঘটনা বন্ধ হয়নি।
আমি শুধু চলতি বছরের পরিসংখ্যান তুলে ধরছি। যাত্রী কল্যাণ সমিতি এবং রোড সেফটি ফাউন্ডেশন— এই দুই সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট- এই আট মাসে সড়কে দুর্ঘটনা ঘটে ২ হাজার ৩৬১টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয় ২ হাজার ৯০৫ জন এবং আহত হয় ৫ হাজার ৮৭৯ জন। এসব তথ্য পত্রিকার হিসেবে। বাস্তবে এর চাইতে আরো বেশি মানুষ সড়কে প্রাণ হারাচ্ছে প্রতিদিন। প্রতি বছর যে নিরাপদ সড়ক দিবস পালিত হয়, সেখানে সড়ক দুর্ঘটনা আরো কীভাবে কমিয়ে আনা যায় সেটা নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। এত আলোচনা, এত টকশো— তবুও যেন এই দুর্ঘটনার মাত্রা কমানো যাচ্ছে না।
এতে করে স্পষ্ট ভাষায় বলতে পারি, এই সেক্টরের দুর্নীতিই সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান এবং অন্যতম কারণ। আমরা এই সেক্টরের কাজ দেখি শুধু লোক দেখানো। আসলে এই সেক্টরে চলছে দুর্নীতির মহা উৎসব, যা হয়তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিগোচর হয় না। এ সেক্টরের প্রধান বাণিজ্য লাইসেন্স। যত বেশি টাকা, তত আগে লাইসেন্স। সঙ্গে আছে দালাল। এসব দালালের ভিড়ে বিআরটিএ অফিসে নিজেকেই খুঁজে পেতে কষ্ট হবে।
কেউ গাড়ি চালাতে জানুক আর না জানুক, টাকা ঢাললে নাকি লাইসেন্স ২ মিনিটের বিষয়। এমন যদি হয়, তবে সড়কের মৃত্যু অস্বাভাবিক কিছু নয়। সরকারের উচিত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই সেক্টরের প্রতি নজর দিয়ে দেশ এবং দেশের মানুষকে রক্ষা করা। দুদকের উচিত হবে দ্রুত এই সেক্টরের দিকে নজর দেওয়া। তবেই কিছুটা হলেও এই সেক্টর প্রাণ ফিরে পাবে। সড়কে দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করার জন্য সরকারের বেতনভুকদ্ধ অনেক কর্মকর্তা রয়েছেন। যাদের এই বিষয় নিয়ে কাজ করার কথা। অথচ তারা সরকার থেকে জনগণের সেবা করার জন্য পারিশ্রমিক নিয়ে জনগণকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছেন। সড়কে রোজ মৃত্যু হচ্ছে। তবু এই সেক্টরের কারো কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। আইন থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই। কারণ আইনেও চলছে প্রতিনিয়ত অঙ্কের হিসাব।
এখন প্রয়োজন সুশাসন এবং ন্যায়বিচার। এ দুটি প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে ঘটবে জনগণ তথা রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়ন। মনে রাখতে হবে, জনগণের উন্নয়ন মানেই দেশের উন্নয়ন। বিচারের আওতায় আনতে হবে সরকারি-বেসরকারি সব দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাকে, যারা পরিবহন সেক্টরে অনিয়ম এবং দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে সড়ক ও সেতুমন্ত্রীকে আরো কড়া অবস্থানে থাকতে হবে। কারণ তিনি আবারো এই সেক্টরের দায়িত্ব নিয়েছেন। তাই সড়ক ও সেতুমন্ত্রীর কাছে দেশের মানুষের প্রত্যাশা এখন ‘নিরাপদ সড়ক’। শুধু কাগজে-কলমে নিরাপদ সড়ক দিবস পালন করলেই চলবে না, তার সুষ্ঠু ও যথাযথ বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।
সবশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আবেদন, দেশের উন্নয়ন করছেন দেশের মানুষের জন্য। কিন্তু দেশের মানুষ যদি বেঁচে না থাকে, তবে দেশের উন্নয়ন করাটা বৃথা হয়ে যাবে। তাই শ্রদ্ধার সঙ্গে আবেদন এই যে, আগে দেশের মানুষ বাঁচান, তারপর দেশ সাজান। সব মিলিয়ে আমরা চাই, যাতে সড়ক-মহাসড়কে আর কোনো প্রাণবিনাশী দুর্ঘটনা না ঘটে। সড়ক হোক সবার জন্য নিরাপদ।
লেখক : প্রাবন্ধিক