মুক্তমত

স্বাধীনতার উপলব্ধি : প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

  • প্রকাশিত ১৭ এপ্রিল, ২০২১

সানজিদা ইয়াসমিন লিজা

 

 

বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। কিন্তু এই স্বাধীনতা একদিনে অর্জিত হয়নি। স্বাধীনতা কথাটি অনেক ছোট্ট হলেও এই স্বাধীনতা অর্জন করতে আমাদের ৩০ লাখ প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে, সম্ভ্রম হারিয়েছে ২ লাখ মা-বোন। সময়ের পরিক্রমায় আজ আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পার হয়ে এসেছি। আজ আমরা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন, সর্বশেষ ১৯৭১ সালের  রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছি। স্বাধীনতা কথাটি অনেক ক্ষুদ্র হলেও জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আমরা এর স্বাদ অনুভব করতে পারি। স্বাধীনতার তাৎপর্য আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক না বুঝলেও যখন আমরা পরাধীন ছিলাম এবং অন্য দেশ থেকে এসে এ দেশ শাসন ও শোষণ করেছে, যারা অনেক অত্যাচার, নির্যাতন ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে তারা ঠিকই বুঝতে পেরেছে। যার ফলে তারা তাদের জীবনের বিনিময়ে আমাদের উপহার দিয়ে গেছে লাল-সবুজের পতাকা, একটি স্বাধীন ভূখণ্ড। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও সামরিক ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি না থাকলেও স্বাধীনতার ৫০ বছরের ব্যবধানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন লক্ষণীয়। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলার মানুষ যাতে অনাহারে-অর্ধাহারে না থাকে, আজ আমরা সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি। আর পদ্মা সেতু আমাদের কত বড় অর্জন তা বলার চেয়ে অনুভব করা বেশি যুক্তিযুক্ত।

সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে আমরা এমন একটা দেশ চাই যেখানে থাকবে না কোনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, লাগামহীন দুর্নীতি, রাহাজানি, সন্ত্রাসী, অরাজকতা। এমন একটি দেশ প্রত্যাশা করি যেখানে নারী-পুরুষে থাকবে না কোনো বিভেদ, যেখানে নারীরা ঘরে ও ঘরের বাইরে নিরাপদে চলাফেরা করতে পারবে। প্রতিদিন যেখানে পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়বে না সড়ক দুর্ঘটনার মতো মর্মান্তিক ঘটনা, ধর্ষণের মতো নিকৃষ্ট ও জঘন্যতম সংবাদ। যেসব স্বপ্ন চোখেমুখে মেখে মুক্তিকামী বীর বাঙালিরা নিজের জীবন অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে আমরা আজ সব মিলিয়ে দেখতে লাগলে দেখব যে, আমাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে অনেক বিচ্যুতি বিদ্যমান। বেশ কিছু ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন অকল্পনীয় হলেও দেশটা যতটুকু এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, সেই মাত্রায় এখনো যাওয়া সম্ভব হয়নি। এর কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে দুর্নীতি, ঘুষ ও কিছু ক্ষমতালোভী  স্বার্থপর মানুষের স্বার্থান্বেষী মনোভাব। আমাদের কাঙ্ক্ষিত  লক্ষ্যমাত্রায় এগিয়ে না যাওয়ার জন্য দুর্নীতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। সিপিআই ২০২০ অনুযায়ী ১৮০টি দেশের মধ্যে তালিকার নিচের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। প্রতিবছর দুর্নীতিতে আমাদের সাফল্য অসামান্য যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অপমানজনক। দুর্নীতি রোধের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি। কারণ এভাবে লাগামহীনভাবে দুর্নীতি চলতে থাকলে দেশের উন্নয়ন বর্তমানের থেকে আরো মারাত্মক পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই স্বাধীন দেশে পথশিশু, বৃদ্ধাশ্রম ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কারো কাম্য হতে পারে না। পথশিশুরা যাতে তাদের অধিকার ফিরে পায়, পিতা-মাতার স্থান যেন বৃদ্ধাশ্রমে না হয়ে হয় সন্তানের হূদয়ে। হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ সবাই সাম্প্রদায়িকতা ভুলে গিয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় নিজেদের উজ্জীবিত করে রাখুক। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ভুলে সব ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মনুষ্য ধর্মের জয়জয়কার থাকবে সুবর্ণজয়ন্তীতে এমন বাংলাদেশই প্রত্যাশা করি।

আমরা জানি, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। বাস্তবিক অর্থে আজ আমাদের দেশ  মাতৃকার জন্যেই সেটা প্রযোজ্য। তাই দেশের উন্নয়নের  জন্য দেশের সচেতন নাগরিক ও তরুণ সমাজকে সদা সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। বহু কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতা যাতে কোনো অশুভ শক্তির হাতে চলে না যায় বা অন্যায়ভাবে কেউ আমাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে না পারে। তবে আশার কথা হচ্ছে, স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে আমার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে খুব বেশি বিচ্যুতি নেই। দেশের সচেতন নাগরিক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সেই বিচ্যুতি বের করে সমাধান করতে আমাদের সবাইকে নিজ নিজ স্থান থেকে সোচ্চার ও সচেতন হতে হবে। যেদিন এসবই সম্ভব হবে সেদিনই আমাদের বহু কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতা ফলপ্রসূ হবে বলে আশা করা যায়।

 

 

লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads