জাতীয়

স্বস্তিতে ঘরে ফিরছে মানুষ

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ৩০ এপ্রিল, ২০২২

করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসায় দুই বছর পর এবার ঈদুল ফিতর হতে যাচ্ছে অনেকটাই মুক্ত পরিবেশে। এর মধ্যে ঈদের ছুটিও তুলনামূলক দীর্ঘ। আর যানবাহন চলাচলে বিধিনিষেধ না থাকায় এবার রেকর্ডসংখ্যক মানুষ আগে থেকেই রাজধানী ছেড়েছেন। ফলে ঈদযাত্রার তৃতীয় দিনে গতকাল শুক্রবার নির্বিঘ্নে রাজধানী ছাড়েন তারা। বাড়ি ফেরাকে ঘিরে ব্যাপক উচ্ছ্বাস দেখা গেছে শিশুদের মাঝেও। তবে তীব্র গরমে যাত্রাপথে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন ঘরমুখো অনেকেই।

চাপে চিড়েচ্যাপটা হওয়া সাধারণ মানুষের কাছে ঈদে বাড়ি ফেরা যেন মুক্তি ও প্রশান্তির ছোঁয়া। এ স্রোতে নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত কোনো ভেদাভেদ নেই। কিন্তু করোনার কারণে গেল দুই বছর বাড়ি যেতে পারেননি অনেকে। মহামারি পরিস্থিতির উন্নতিতে বিধি-নিষেধহীন প্রথম ঈদ হচ্ছে এবার। সেই সঙ্গে দীর্ঘ ছুটি। দুই মিলিয়ে এবার ঈদযাত্রার স্বস্তি এনে দিয়েছে অনেকটা।

তাছাড়া ঈদের আগে অধিকাংশ অফিস-আদালতে বৃহস্পতিবার ছিল শেষ কার্যদিবস, ফলে অনেকে এদিন বিকালেই বাড়ির পথ ধরেন। গতকাল শুক্রবারও সকাল থেকে নাড়ির টানে বাড়ি ফিরছেন অনেকে। এতে দুপুরের পর রাজধানীর রেলস্টেশন এবং বাস ও লঞ্চ টার্মিনালমুখে ভিড় বাড়তে থাকে। সরেজমিনে লঞ্চ ও ট্রেনে যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। বিমানযাত্রীর সংখ্যাও নেহাত কম নয়। কিন্তু তার ঠিক বিপরীত দিকে অবস্থান করছে বাস। ঈদযাত্রার জন্য বাস প্রস্তুত থাকলেও যাত্রী নেই। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, আজ শনিবার বাসে যাত্রীর চাপ বাড়তে পারে।

ঈদযাত্রার জন্য ট্রেনের অগ্রিম টিকিট যারা কেটেছিলেন তাদের যাত্রা শুরু হয়েছে দুদিন আগে থেকে। আর এখন ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে মানুষের সামান্য ভিড় থাকলেও ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি ঈদে ঘরমুখো উচ্ছ্বসিত মানুষের। গতকাল দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত প্রায় সবগুলো ট্রেন যথাসময়ে কমলাপুর থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে গেছে। এতে বেশ স্বস্তিতে ট্রেন ভ্রমণ করছেন যাত্রীরা।

দুপুর ১টার দিকে বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেনে বসে ছিলেন খাইরুজ্জামান। তিনি বলেন, করোনার কারণে গত দুই বছর ঈদে তিনি বাড়িতে যাননি। এবার মা-বাবার সঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করতে বাড়িতে যাচ্ছেন। ট্রেনে টিকিট কাটা নিয়ে কিছুটা সমস্যা হয়েছিল। কিন্তু আজকের ব্যবস্থাপনায় তিনি সন্তুষ্ট।

শিডিউল অনুযায়ী বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেনটির বেলা ১টা ৩০ মিনিটে ছাড়ার কথা। নির্দিষ্ট সময়ের আগে থেকেই প্লাটফর্মে ছিল ট্রেনটি। সিলেটগামী জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসের যাত্রী মো. আসাদ বলেন, ট্রেনের টিকিট পেতে একটু ঝামেলা হয়েছিল। আমি অনলাইনে টিকিট করেছিলাম। আমার এবং আমার স্ত্রীর মোবাইলফোন থেকে ট্রাই করি, কিন্তু পাইনি। পরে অফিসের কম্পিউটার থেকে চেষ্টা করে পেয়েছি। দুই বছর পর বাড়িতে ঈদ করতে পারবো, এটা স্বস্তির। আর ট্রেন ঠিক সময়ের আগেই প্লাটফরমে এসেছে এবং আশা করছি ছাড়বেও সঠিক সময়ে।

এদিকে যানজটের ভয়ে ট্রেন ছাড়ার অনেক আগেই স্টেশনে এসে বসে ছিলেন অনেকে। দুপুরে পুরো প্ল্যাটফরমে মানুষের সরব উপস্থিতি ছিল। তবে ট্রেন ছাড়লেই প্ল্যাটফরম শূন্য। হুইসেল বাজিয়ে একেকটি ট্রেন গন্তব্যের উদ্দেশে প্ল্যাটফরম ছাড়ে, আরেকটি ট্রেন এসে প্ল্যাটফরমে দাঁড়াচ্ছে। ঠিক সময়মতো ট্রেন ছাড়ায় সন্তুষ্ট হয়েছেন যাত্রীরাও।

কমলাপুর স্টেশনে অপেক্ষার পুরো সময়টাই উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে কাটতে দেখা গেছে শিশুদের। কেউ মা বাবার সাথে বসে আছে, কেউ ছোটাছুটি করছে। তাদের বাড়ি যাওয়ার অপেক্ষার যেন তর সইছে না। স্টেশনে ছোটাছুটি করা শিশু রিফাত বলেন, দাদু বাড়িতে ঈদ করার জন্য যাচ্ছি, অনেক মজা হবে। আরেক শিশু তানহার বলেন, বাবা মায়ের সাথে গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছি ঈদ করতে, আমার গ্রামে যেতে অনেক ভালো লাগে। এসময় তার বাবা বলেন, ঈদে বাচ্চাদের আনন্দটাই বেশি। ওদের জন্যই তো বাড়ি যাওয়া।

সার্বিক বিষয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনের ভারপ্রাপ্ত স্টেশন ম্যানেজার মো. আমিনুল হক বলেছেন, দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে শুক্রবার সারাদিনে ১২২টি ট্রেন কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ছেড়ে যায়। এর মধ্যে ৪টি স্পেশাল ট্রেন রয়েছে। সকাল ১১টা পর্যন্ত দুটি ট্রেন স্টেশনে আসতে বিলম্ব করলেও আমরা দ্রুত চেষ্টায় আধা ঘন্টার মধ্যেই সেগুলোকে গন্তব্যে যেতে ছেড়ে দিতে পেরেছি। বঙ্গবন্ধু সেতু এক লেন হওয়ায় সেখানে অপেক্ষা করতে গিয়ে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। তাছাড়া সবাইকে নিরাপদে নামিয়ে দিতে প্রতিটি স্টেশনে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে কিছু সময় বেশি থামানো হবে। ফলে সময় মেনে চলা কঠিন হবে। তবে কোনো দুর্ঘটনা না হলে সময়সূচিতে বড় ধরনের বিপর্যয় হবে না। আমরা চেষ্টা করেছি দ্রুত ঢাকা থেকে ট্রেনগুলোকে ছেড়ে দিতে। 

এদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঘরমুখো মানুষের ঢল নামে শিমুলিয়া, পাটুরিয়া ও দৌলতদিয়া ঘাটে। গতকাল ভোরে ঢাকা ও আশপাশের এলাকা থেকে বাস, ছোট যানবহন, প্রাইভেটকার বা মোটরসাইকেলে করে এ দুই ঘাটে ভিড় জমান ঈদে বাড়িফেরা মানুষেরা। বেলা বাড়লে ভিড়ও বাড়তে থাকে। কিন্তু ঘাটগুলোতে যাত্রীদের তেমন ভোগান্তি ছিল না।

মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গরমে গাড়ির লম্বা সারি আর মানুষের হুড়োহুড়ি ঠেলাঠেলি অতিক্রম করে যাত্রীরা ফেরি, লঞ্চ বা স্পিডবোটে পাড়ি দেন পদ্মা। অনেকেই শিমুলিয়া পর্যন্ত গাড়িতে এসে লঞ্চ বা স্পিডবোটে পদ্মা পাড়ি দিয়ে ওপর প্রান্তে গিয়ে আবার গাড়িতে উঠছেন। লঞ্চ এবং স্পিডবোটগুলো অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই করে ঘাট থেকে ছেড়ে যান।

শিমুলিয়া ও মাদারীপুরের বাংলাবাজার এবং শরীয়তপুরের মাঝিরকান্দি নৌপথে ভোর সাড়ে ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ৮৫টি লঞ্চ এবং ভোর ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১৫৫টি স্পিডবোট চলাচল করছে। স্পিডবোটে ১৫০ টাকা ও লঞ্চে ৪৫ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে যাত্রীরা এবার যাত্রায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। 

মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, শুক্রবার সকাল থেকেই যাত্রী ও যানবাহনের চাপ বাড়ে পাটুরিয়া লঞ্চ ঘাটে। তবে বেলা বাড়ার পর সেই চাপ কিছুটা কমতে থাকে বলে জানিয়েছেন ঘাট সংশ্লিষ্টরা।

গতকাল পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটে ২১টি ফেরি দিয়ে যানবাহন পারাপার হচ্ছে। তবে ছোট গাড়ির চাপ বেশি দেখা গেছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) ডিজিএম খালেদ নেওয়াজ জানান, যাত্রী ও যানবাহন পারাপারের জন্য পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটে ছোট, বড় মোট ২১টি ফেরি নিয়োজিত রয়েছে। এছাড়া পাটুরিয়ায় ৫টি ঘাট সচল থাকায় যত যাত্রী আসুক কোনো ভোগান্তি পোহাতে হবে না।

শুক্রবার দুপুর থেকেই সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে নামে ঘরমুখো মানুষের ঢল। তীব্র গরম আর ভোগান্তি সত্ত্বেও শেষ মুহূর্তে পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদযাপনের আশায় সন্তুষ্ট ঘরমুখো যাত্রীরা।

অন্যদিকে রাজধানীর বাস টার্মিনালগুলোতে পর্যাপ্ত বাস-টিকিট থাকলেও যাত্রী সংকট ছিল। পরিবহন সংশ্লিষ্টদের দাবি, বাসের আগাম টিকিট বিক্রির ক্ষেত্রেও ছিল মন্দা। তারা আশা করেছিলেন, বাস ছেড়ে যাওয়ার সময় যাত্রী পাবেন। তবে সে প্রত্যাশাও পূরণ হচ্ছে না।

গাবতলী বাস টার্মিনালের পরিবহন শ্রমিক মো. শফিক বলেন, পুরো টার্মিনালে সাংবাদিক আর আমরা আছি। আর কেউ নাই। যাত্রী নাই। আরেক পরিবহন শ্রমিক মো. শহিদ বলেন, সকালে যাত্রী থাকলেও কিছু সময় পর যাত্রী কমে গেছে। দুই-একজন করে আসে। যাত্রীর কোনো চাপ নাই। গাড়ি যে কয়টা ছাড়ছি অর্ধেক খালি।

গাবতলী বাস টার্মিনালের কাউন্টার ঘুরে দেখা যায়, গতকাল ও আজ শনিবারসহ প্রতিদিনেরই টিকিট রয়েছে। দুপুর পর্যন্ত একেকটি কাউন্টার থেকে ২০ থেকে ৪০টি করে টিকিট বিক্রি হয়েছে। যা ঈদের সময় অনুযায়ী একেবারেই সামান্য। তবে যাত্রী চাপ কম থাকায় অনেকটাই স্বস্তি বিরাজ করছে রাজধানীর অন্যতম বড় এই বাস টার্মিনালে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, সড়কের যাত্রী এখনো কম দেখা যাচ্ছে। তবে শনিবার থেকে কিছু যাত্রী হবে। এখনো গার্মেন্টগুলোর ছুটি হয়নি। ছুটি হলে যাত্রী চাপ বাড়বে। আর যদি শনিবারও যাত্রী না হয়, সে ক্ষেত্রে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা লোকসানের মুখোমুখি হবেন। কারন পুরো রোজার মাসটা যাত্রী ছিল না। এখনো যদি না হয়, তাহলে লোকসান হবে। ট্রেনে ও লঞ্চে যাত্রী আছে। কিন্তু বাসে সেভাবে নেই। এর কারণ জানতে চাইলে এই পরিবহন মালিক বলেন, যাত্রীরা হয়তো ভয় পাচ্ছেন, সড়কে যানজট হতে পারে। তাই অনেকে বাসে যেতে চাইছেন না।

টাঙ্গাইল প্রতিনিধি জানায়, গতকাল ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে ১৫ কিলোমিটার এলাকায় ধীরগতির সৃষ্টি হয়েছে। ভোর থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপ্রান্ত থেকে কালীহাতির পৌলি পর্যন্ত এলাকায় যানবাহনের ধীরগতি থাকে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে যানবাহনের চাপ আরও বাড়লেও যানজট তীব্র হয়নি। এখানে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ পরিদর্শক (টিআই) এশরাজুল হক বলেন, মহাসড়কে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ বেড়েছে। তবে কোথাও কোনো জট নেই। পুলিশ সড়কে দায়িত্ব পালন করছে।

সাভার প্রতিনিধি জানায়, গতকাল সকাল থেকেই ঢাকা-আরিচা, নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কসহ সাভার অংশের সড়কগুলোতে গাড়ির চাপ কম ছিল। প্রতিদিনের তুলনায় সড়কগুলো একটু বেশি ফাঁকা দেখা গেছে। রাজধানী থেকে ছেড়ে যাওয়া উত্তরবঙ্গগামী একটি পরিবহনের চালক জলিল মিয়া বলেন, যাত্রীর চাপ কম থাকায় আজ সড়কে গাড়ির সংখ্যাও কম। এ ছাড়া ঈদ উপলক্ষে সড়কে পুলিশি নজরদারি বাড়ার কারণে কোনো পরিবহন অবৈধ পার্কিং করতে পারছে না। বিধায় সড়ক অনেকাংশেই ফাঁকা মনে হচ্ছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads