ফিচার

স্বর্গরাজ্য দেবতাখুম

  • প্রকাশিত ২৫ জানুয়ারি, ২০২০

শাহ রাজন

 

 

নৈসর্গিক বান্দরবানকে বলা হয় খুমের স্বর্গরাজ্য। এই রাজ্যের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট নিঃসন্দেহে দেবতাখুমের কাছেই যাবে। স্থানীয়দের মতে, প্রায় ৫০-৭০ ফুট গভীর এই খুমের দৈর্ঘ্য ৬০০ ফুট যা ভেলাখুম থেকে অনেক বড় এবং অনেক বেশি বন্য। স্থানীয়দের কাছে এটা হল সোনাখুম। অনেকে আবার মারমা ভাষায় থংচিখুম নামেও ডাকেন।

অসম্ভব রকমের অ্যাডভেঞ্চার, একেবারে মনকে ভয়ার্ত করে দিতে পারে যাকে বলে তার জন্য পারফেক্ট দেবতাখুম। ট্রেকিং, অ্যাডভেঞ্চার, রিস্ক, ভেলার কায়াকিং সবকিছুর কম্বো এই দেবতাখুম। একেবারে নেটওয়ার্কের বাইরে এক ভিন্ন পরিবেশ। আশপাশে সব সুনসান। শব্দ হিসেবে থাকবে উপর থেকে পানির ফোঁটা পড়ার শব্দ, নিজেদের ভেলার আওয়াজ আর আপনার কথারই প্রতিধ্বনি। পানি এতটাই ঠান্ডা যে, আপনার হিমশীতল শরীরকে আরো ভয়ার্ত করে তুলবে। পানির টেম্পারেচার মোটামুটি ১০ ডিগ্রির মধ্যে। আশপাশের পরিবেশটা এত ভূতুড়ে আর নীরবতার যে এটা আপনাকে সত্যি সত্যিই রিয়্যাল অ্যাডভেঞ্চারে নিয়ে যাবে।

এটা আমাদের গ্রুপের অনেকের কাছেই এখন পর্যন্ত লাইফের ওয়ান অব দ্যা বেস্ট অ্যাডভেঞ্চার। বড় বড় দুই পাহাড়ের মাঝখানের এই খুম (গর্ত/যেখানে পানি জমে) ভেতরের দিকে একদমই অন্ধকার। সূর্যের আলো খুবই সংকীর্ণ। শীতে অবশ্য পানি কম থাকে।

এই ইট-পাথরের শহর যদি আপনার কাছে রীতিমতো বিরক্ত হয়ে উঠে, জীবন একঘেয়ে লাগে তাহলে আপনি এখনই বের হয়ে পড়ুন বাসা থেকে কোনো অভিযানের জন্যে। কোনো অভিযানে গেলে আপনি বুঝতে পারবেন যে আমাদের জীবনটা আসলে খারাপ নয়; বরং অনেক বেশি সুন্দর। আর আপনি যদি একদিনেই পাহাড়, ঝিরিপথ, খুম, ট্রেকিং, সবকিছুর ফিলিংস চান, জীবনে অ্যাডভেঞ্চারের একটা আলাদা মাত্রা চান, একদম নিস্তব্ধ, নিরিবিলি, শান্ত একটা পরিবেশে খুমের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভেলায় ভাসতে চান, তাহলে বান্দরবানের দেবতাখুম আপনার জন্যে এক কথায় পারফেক্ট একটা জায়গা।

দুই পাশে বিশাল বিশাল পাহাড়, সব কিছু নিস্তব্ধ, এর মধ্যে দিয়ে ভেলায় ভাসা!

দেবতাখুমের সৌন্দর্য বড়ই মনোমুগ্ধকর এবং রহস্যময়। পানি বেশ স্বচ্ছ, রং সবুজ। দুই পাহাড়ের পুরো পাথর ছোটবড় শ্যওলা এবং লতাপাতা দ্বারা আবৃত। খুমের কোথাও কোথাও একটু অন্ধকার আর একেবারেই সুনসান এই খুম।

দেবতাখুম আসলে কতগুলো স্টেপে পার হতে হয়। আপনাকে ভেলা পাড়িয়ে স্টেপগুলো এগুতে হবে। স্টেপগুলো ভেতরের দিকে আর বেশি ভয়াবহ। স্থানীয়রাও এখনো দেবতাখুমের সম্পূর্ণ ভেতরে প্রবেশ করেননি। ইভেন অনেকেই এখনো দেবতাখুম চেনেনও না। দেবতাখুম বর্ষাকাল আর শীতকালে আলাদা। বর্ষায় প্রচুর পানি থাকে। তখন একেবারে কচ্ছপতলী থেকে বোট নেওয়া যায়। শীতকালে হেঁটে যেতে হয় শীলবান্ধা পাড়া পর্যন্ত, শীলবান্ধা পাড়া কচ্ছপতলী থেকে ৮ কিমি দূরে। এখানে আপনাকে প্রথমে হেঁটে যেতে হবে। পুরো পথটাই অ্যাডভেঞ্চারে পূর্ণ, ৩/৪টি পাহাড় পাড়ি দিতে হয় শীলবান্ধা পাড়া যাওয়ার জন্য।

দেবতাখুমের বেলায়ও স্থানীয়দের মুখ থেকে এরকম শুনা যায়। একসময় নাকি দেবতাখুম পুরোটাই শ্বাপদসংকুল ছিল। স্থানীয়রা এগুলো মেরে ফেলেছে। এখন সবই বিলুপ্তপ্রায়। দেবতাখুম নামের কারণ হলো কোনো এক বৃদ্ধা নাকি একবার বিশালাকৃতির এক মাছ দেখছিলেন এই খুমে। বৃদ্ধা এই বিশালাকৃতির মাছকে দেবতানামে আখ্যায়িত করেছিলেন। তখন থেকে এর নাম দেবতাখুম।

 

কীভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে বাসে বান্দরবান। বান্দরবান শহর থেকে ‘দেবতাখুম’ যাওয়ার জন্য আপনাকে প্রথমে পৌঁছাতে হবে রোয়াংছড়িতে। বান্দরবান শহর থেকেই রোয়াংছড়ির সরাসরি বাস পাওয়া যায়। বান্দরবানের রোয়াংছড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে রোয়াংছড়ির বাস পাওয়া যায়। বান্দরবান থেকে রোয়াংছড়ির দূরত্ব ২০ কিমি। সময় লাগবে মোটামুটি এক ঘণ্টা। রোয়াংছড়ি থেকে অটো/সিএনজিতে যেতে হবে কচ্ছপতলী। রোয়াংছড়ি থেকে কচ্ছপতলীর দূরত্ব ১০ কিমি।

আমরা চান্দের গাড়ি ভাড়া করেছিলাম, যা সরাসরি কচ্ছপতলী বাজার পর্যন্ত এবং আমরা ঢাকা থেকেই গাড়ি ভাড়া করে রেখেছিলাম। আপনারা যারা যাবেন, যাওয়ার আগে অবশ্যই গাড়ি ঠিক করে রাখবেন।

আপনাকে বান্দরবান শহর থেকে প্রথম পৌঁছাতে হবে রোয়াংছড়ি থানায়, ছবিযুক্ত ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি আর একটা ফর্ম এ নাম এন্ট্রি করতে হবে। আপনার সঙ্গে গাইড থাকতে হবে অবশ্যই, কারণ গাইডের নামও ফর্মে উল্লেখ করতে হয়। তবে গাইড ঢাকা থেকে ঠিক করে যাওয়াটাই শ্রেয়।

আমার বন্ধু পাভেল ঢাকা থেকেই গাইড আর গাড়ি ঠিক করে রেখেছিল। সুতরাং আমাদের এসব কোনো ঝামেলা হয়নি।

রোয়াংছড়ি থানায় এন্ট্রি হয়ে গেলে আপনাকে যেতে হবে কচ্ছপতলী (লিরাগাও আর্মি ক্যাম্প)-এ, আপনাদের গ্রুপের সবাইকে যেতে হবে আর্মি ক্যাম্পে (গাইডসহ)। তারা অনুমতি দেবে এবং শর্ত দেবে বিকাল ৫টার আগে অবশ্যই ফিরে আসতে হবে।

আর্মি ক্যাম্পে পারমিশন হয়ে গেলে ট্রেকিং শুরু। কচ্ছপতলী থেকে শীলবান্ধা পাড়ার দূরত্ব ৮ কিমি। এই পথ সম্পূর্ণটাই হেঁটে যেতে হবে। সময় লাগবে প্রায় ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট (সময় নির্ভর করে আপনার হাঁটার গতির ওপর)। সঙ্গে অবশ্যই খাবার পানি এবং শুকনো খাবার নিয়ে নেবেন। কারণ এই পথে দোকানের দেখা পাবেন না। একদম শীলবান্ধা পাড়ায় দোকান পাবেন। এই পথটা অসম্ভব রকমের অ্যাডভেঞ্চারপূনর্ণ। অনেক উঁচুতে উঠবেন আবার নামবেন। এভাবেই ৩/৪টি পাহাড় পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যাবেন শীলবান্ধা পাড়ায়।

ছবির মতো সুন্দর একটি মারমা পাড়া। কয়েকটি পরিবারের বসবাস, এখানে একটি দোকান পাবেন, চাইলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নিতে পারেন। সবচেয়ে ভালো হয় এখানে ক্যাম্প করা; কিন্তু অনুমতি দেবে না। শীলবান্ধা পাড়া থেকে সামনে গেলে একটি হোটেল। এখান থেকেই ভেলা নিতে হবে এবং টাকাও এখানে দিতে হবে এবং দুপুরের খাবার তৈরি করার জন্য বলে দেবেন। তা না হলে আপনাকে কচ্ছপতলী গিয়ে খেতে হবে। এবার তৈরি হওয়ার পালা। ব্যাগ রেখে দিন ওই হোটেলে (আপনার গাইড ব্যাগ রাখার ব্যবস্থা করে দিবে)। মোবাইল পলিথিন কাগজে পেঁচিয়ে নিন, যাতে কোনোভাবেই পানি না ঢোকে, আর যারা ভালো ক্যামেরা নেবেন তারা অবশ্যই সেরকম ক্যামেরার সুরক্ষার ব্যবস্থা করেই আনবেন, কারণ ভেলায় আপনার শরীরের নিম্নাংশ ভিজে যাবে।

সবাই রেডি হয়ে বের হলাম, শীতকাল তাই নৌকা করে ভেলা পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে। বর্ষাকালে তা করতে হয় না এবং কি কচ্ছপতলী থেকেই নাকি বোট পাওয়া যায়।

আমাদের টিম মেম্বার ১০ জন ছিল (গাইডসহ)। এক ভেলায় ২ জন করে, আমরা ৫টা ভেলায় উঠে পরলাম,স্বচ্ছ সবুজ পানি, চারদিক নীরবতা, দুপাশে পাহাড়, স্তব্ধ একটা প্রকৃতি, মনে হয় সবকিছু থমকে গেছে। এটাই দেবতাখুমের নীরব সৌন্দর্য।

আমরা চলতে শুরু করলাম, স্তব্ধ চারপাশ। যারা গান করেন অথবা বাঁশি বাজাতে পারেন তারা চাইলে একটা ভিডিও করে নিতে পারেন।

মনে করেন আপনি বাঁশি বাজাচ্ছেন, আর তা চারদিকে ছড়িয়ে প্রতিধ্বনি হিসেবে ফিরে আসছে, বিষয়টি একেবারেই অন্যরকম। ভেলা নিয়ে গহিনে দেবতাখুমের, আপনার কথার প্রতিধ্বনি আপনিই শুনতে পাবেন এবং এক ফোঁটা পানির শব্দও।

ভেতরে পৌঁছানোর পর অন্যরকম একটা পরিবেশ, যেটা আপনি নিজে না গিয়ে দেখলে বুঝতে পারবেন না।

দেবতাখুম সত্যিই নৈসর্গিক। বেশি বেশি ভ্রমণ করুন আর নিজের দেশকে জানুন। আমার দেশ অনেক সুন্দর। আর পাহাড়কন্যা বান্দরবান সত্যিই অপূর্ব।

 

ভ্রমণের সময় যা যা দরকার

অবশ্যই ছবিযুক্ত ভোটার আইডি/পাসপোর্টের দুই কপি সঙ্গে নিন। আপনাকে অবশ্যই বিকাল ৫টার আগে ফিরে আসতে হবে। এবং আর্মি ক্যাম্পে দেখা করতে হবে। ভেলায় কায়াকিং করে যখন খুমের ভেতরে পৌঁছাবেন তখন আপনার শরীরের নিচের অর্ধাংশ পানিতে ভিজে যাবে। মোবাইল নিতে চাইলে পলিথিন ব্যবহার করতে পারেন। খুম যেরকম গভীর তেমন শ্যাওলা দ্বারা পূর্ণ, পানিও ঠান্ডা। সাঁতার জানা থাকলে বেশি ভালো। আর সাঁতার না জানলে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট পরে খুমে প্রবেশ করবেন। বান্দরবান শহরে সকল সিমের নেটওয়ার্ক পাবেন কিন্তু রোয়াংছড়িতে শুধু রবি এবং এয়ারটেলের নেট পাবেন। যত ভেতরে যাবেন, নেটওয়ার্ক পাবেন না।

দেবতাখুম এখনো তার চিরসবুজ মনোমুগ্ধকর রূপ ধরে আছে, আপনার অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি/প্লাস্টিক এখানে ফেলে পরিবেশ নষ্ট করবেন না।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads