ফাইনালে ওঠার স্বপ্নটা প্রথম উঁকি দিয়েছিল ২০১৬ সালে। বর্তমান জাতীয় দলের তারকা মেহেদী হাসান মিরাজের নেতৃত্বে ঘরের মাঠে সেবার হট ফেবারিট ছিল বাংলাদেশই। কিন্তু সেমিতে এসেই আটকে গিয়েছিল যুবাদের বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন। চার বছর পর এবার দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে আবারো উঁকি দিচ্ছিল সেই স্বপ্ন। আকবর আলীর নেতৃত্বে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠার স্বপ্ন পূরণ হলো জুনিয়র টাইগারদের। আজ বৃহস্পতিবার পচেফস্ট্রুমে দ্বিতীয় সেমিফাইনালে মাহমুদুল হাসান জয়ের সেঞ্চুরিতে শক্তিশালী নিউজিল্যান্ডকে ৬ উইকেটে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো ফাইনালে উঠেছে বাংলাদেশের যুবারা। ম্যাচে কিউইদের ৮ উইকেটে ২১১ রানের জবাবে বাংলাদেশ ৪৪.১ ওভারে ৪ উইকেট ২১৫ রান করে। ম্যাচ সেরা হন মাহমুদুল হাসান জয়।
আগামী রোববার একই ভেন্যুতে ফাইনালে বাংলাদেশ খেলবে সাবেক চ্যাম্পিয়ন ভারতের বিপক্ষে। ইতিহাস গড়ল সাকিব-মাশরাফি-মুশফিক-তামিমদের উত্তরসূরি আকবর-মাহমুদুল-হূদয়-শরিফুল-শামিমরা। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ শুরুর পর থেকে ১৯৯৮ সালে একবারই ফাইনাল খেলেছিল নিউজিল্যান্ড। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত তারা ফাইনালে উঠতে পারেনি। অন্যদিকে বাংলাদেশ তো এবারের আগে সেমিফাইনালের গণ্ডিই পার হতে পারেনি। এবার দর্শকদের সে আশা পূরণ করল। আর ফাইনালে ভারতকে পরাজিত করে আরেকটি ইতিহাস গড়বে, সেটার জন্য অপেক্ষায় রয়েছে গোটা বাংলাদেশ।
মাঝারি ধরনের টার্গেট নিয়ে ব্যাট করতে নামে বাংলাদেশ দল। দুই ওপেনারের শুরুটা মন্দ ছিল না। স্ট্রোকের পসরা সাজিয়ে খেলতে থাকেন পারভেজ হোসেন ইমন। তানজিদ হাসান অবশ্য ধীরস্থির ছিলেন। দলীয় ২৩ রানে আচমকা ক্রিস্টিয়ান ক্লার্কের বাড়তি বাউন্সের বল খেলতে গিয়ে বিপদে পড়েন। ব্যাটের বাইরের কানায় বল লেগে জমা পড়ে থার্ড ম্যানে থাকা ফিল্ডারের হাতে। ৯ বলে মাত্র ৩ রানে ফেরেন তানজিদ। সঙ্গী হারিয়ে ইমনও থিতু হতে পারলেন না। ব্যক্তিগত ১৪ রানে ডেভিড হ্যানককের বলে আগ বাড়িয়ে খেলতে গিয়ে উইকেটকিপারের গ্লাভসবন্দি হয়ে ফেরেন ইমন।
নবম ওভারে হূদয় রান আউট হতে হতে বেঁচেছেন। রিপ্লেতে অবশ্য দেখা যায় আগেই ঢুকেছেন তিনি। এর পর সতর্কভাবে এগিয়ে যেতে থাকেন তৌহিদ হূদয়, সঙ্গ দেন মাহমুদুল হাসান জয়। ৬৮ রানের জুটি গড়ে দলকে এগিয়ে নিতে থাকেন স্বপ্নের ফাইনালে দিকেই। কিন্তু আকস্মিক ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন ২৩তম ওভারে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত আদিত্য অশোকের ঘূর্ণি বল বুঝে উঠতে পারেননি। কিপার উইকেট ভেঙে দিলে ৪০ রানের ফিরে যেতে হয় হূদয়কে। তার ৪৭ বলের ইনিংসে ছিল ৪টি চার। চতুর্থ জুটিতে মাহমুদুল হাসান জয় ও শাহাদাত হোসেন দারুণ খেলে বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত করেন। মাহমুদুল ১০০ রান করেন ১২৬ বলে ১৩টি চারের সাহায্যে। শাহাদাত অপরাজিত ৪০ রান করেন ৫১ বলে ৪টি চারে। শামিম অপরাজিত থাকেন ৫ রান নিয়ে।
নিউজিল্যান্ডের ক্লার্ক, হ্যানকক, অশোক ও তাশকফ ১টি করে উইকেট লাভ করেন।
এর আগে টস জিতে নিউজিল্যান্ডকে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানান বাংলাদেশ অধিনায়ক আকবর আলী। অধিনায়কের এমন সিদ্ধান্ত যথার্থ প্রমাণ করতে শুরু থেকেই কিউইদের চাপে রাখেন বাংলাদেশের বোলাররা। নিউজিল্যান্ডের দুর্বলতার দিকটি মাথায় রেখে ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই স্পিন আক্রমণ নিয়ে আসেন আকবর। অফস্পিনার শামিম হোসেন বল হাতে নিয়েই পান সাফল্য। তার ওভারের পঞ্চম ডেলিভারিতে প্রথম স্লিপে তানজিদ হাসানের ক্যাচ হন ওপেনার রিস মারিও (১)। এরপর কিছুটা সময় স্বস্তিতে ছিল নিউজিল্যান্ড। যদিও রান তুলতে পারেনি সেভাবে।
প্রথম ১০ ওভারে ১ উইকেট হারিয়ে কিউই যুবারা তুলে মাত্র ২৬ রান। তারা দ্বিতীয় উইকেটটিও হারায় বাংলাদেশের ঘূর্ণি ফাঁদে পড়ে। এবার ওলি হোয়াইটকে (১৮) উইকেটরক্ষক আকবরের ক্যাচ বানান টুর্নামেন্ট জুড়েই দুর্দান্ত বোলিং করা বাঁহাতি স্পিনার রকিবুল হাসান। বিপদে পড়া কিউইরা ধীরগতিতে ওভার পার করতে থাকে। বাংলাদেশের বোলাররাও চেপে ধরে রাখেন রানের গতি। ২১তম ওভারে এসে আরো একটি উইকেট তুলে নেন শামিম। দেখেশুনে খেলতে থাকা ফারগুস লেলম্যানকে (২৪) বোকা বানিয়ে শর্ট মিডউইকেটে দুর্দান্ত এক ক্যাচ নেন মাহমুদুল হাসান জয়। অধিনায়ক জেসে তাশকফ উইকেটে আসার পর থেকেই স্পিনের বিপক্ষে তেমন স্বাচ্ছন্দ্য ছিলেন না। ১০ রান করা কিউই দলপতিকে দারুণ এক ডেলিভারিতে বোল্ড করেন হাসান মুরাদ। তাতে ৭৪ রানের মধ্যেই ৪ উইকেট হারিয়ে বসে নিউজিল্যান্ড। তবে পঞ্চম উইকেটে দলকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন নিকোল লিডস্টোন আর বেকহ্যাম হুইলার গ্রিনল।
১৫ ওভার ব্যাট করে ৬৭ রান যোগ করেন তারা। কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। উইকেট কামড়ে পড়ে ছিলেন এই যুগল। শেষ পর্যন্ত এই জুটিটি ভাঙেন শরিফুল। তার ফুলটস গতিময় এক ডেলিভারি পায়ে লেগে যায় লিডস্টোনের, আবেদনে আম্পায়ার আঙুল তুলে দিতে দেরি করেননি। ৪৪ রান করা এই ব্যাটসম্যান ফেরার পরের ওভারে আরো একটি উইকেট তুলে নেয় বাংলাদেশ। কুইন সানডেকে (১) বোল্ড করেন হাসান মুরাদ। এরপর শরিফুলের কাটারে বোল্ড ক্রিশ্চিয়ান ক্লার্ক (৭)। তবে একটা প্রান্ত ধরে ঠিকই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন বেকহ্যাম হুইলার। দারুণ খেলে হাফসেঞ্চুরিও তুলে নেন। কিউইদের এই ব্যাটিং ভরসা ইনিংসের শেষ পর্যন্ত দলকে টেনে নিয়ে গেছেন। ৮৩ বলে ৫ বাউন্ডারি আর ২ ছক্কায় তিনি অপরাজিত থাকেন ৭৫ রানে।
বাংলাদেশের পক্ষে ৩টি উইকেট নেন পেসার শরিফুল। দুটি করে উইকেট শিকার দুই স্পিনার-হাসান মুরাদ আর শামিম হোসেনের।