অনলাইনে জুয়া খেলার অ্যাপস স্ট্রিমকারে (StreamKar) প্রতি বছর পাচার হচ্ছে হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশে এই অ্যাপসটি নিষিদ্ধ হলেও ভিপিএনের (ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক) মাধ্যমে ব্যবহার করছে কয়েক লাখ মানুষ। আর তারা না জেনেই জড়িয়ে পড়ছে নিষিদ্ধ জুয়া খেলায়। স্ট্রিমকারে জুয়া খেলতে প্রয়োজন হয় ডিজিটাল কারেন্সি বিন্স ও জেমস। এই কারেন্সি কিনতে গিয়েই প্রতি মাসে কয়েকটি চক্রের মাধ্যমে বিদেশে পাচার হচ্ছে শত কোটি টাকা।
গতকাল বুধবার রাজধানীর বারিধারায় অ্যান্টি টেরোরিজম মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার (মিডিয়া অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস) মোহাম্মদ আসলাম খান জানান, সামাজিক যোগাযোগের এই অ্যাপটিতে দুই ধরনের আইডি রয়েছে। একটি ইউজার আইডি, অপরটি হোস্ট আইডি। ইউজাররা সাধারণত সুন্দরী ও সেলিব্রেটিদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার জন্য এই অ্যাপটি ব্যবহার করে। আর হোস্টরা একটি হোস্ট এজেন্সির মাধ্যমে এই অ্যাপে হোস্টিং করেন। সুন্দরী এবং সেলিব্রেটিরাই সাধারণত এজেন্সির মাধ্যমে হোস্ট আইডি খোলেন। তিনি জানান, স্টিমকারে দুই ধরনের এজেন্সি রয়েছে, বিন্স এজেন্সি, হোস্ট এজেন্সি। বিন্স এজেন্সিগুলো বিদেশি এই অ্যাপটির অ্যাডমিনদের কাছ থেকে বিন্স কিনে ইউজারদের কাছে বিক্রি করে। আর ইউজাররা হোস্টদের সঙ্গে লাইভ স্ট্রিমিং-এ আড্ডা দেওয়ার জন্য গিফট দেয় বিনস। এটি এক ধরনের ডিজিটাল কারেন্সি। প্রতি এক লাখ বিন্সের দাম এক হাজার আশি টাকা এবং প্রতি এক লাখ জেমসের দাম ৬০০ টাকা বা তার কম। কিন্তু এক বিন্স সমান এক জেমস। কিন্তু এই বিন্স হোস্টদের কাছে এলেই তা জেমস-এ পরিণত হয়। সঞ্চিত জেমসের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে হোস্টদের আয়। তবে হোস্টদের মাস শেষে বেতন পাওয়ার জন্য শুধু জমা করা জেমস যথেষ্ট নয়। তাকে প্রতি দিন এবং প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য লাইভ স্ট্রিমিংয়ে থাকতে হয়। এসপি আসলাম বলেন, এই বিন্স এবং জেমস নামের ডিজিটাল কারেন্সিই আমেরিকান অ্যাপস স্ট্রিমকারের একমাত্র উপার্জনের পথ। এদিকে দেশীয় বিন্স এজেন্সিগুলো সাব-এজেন্সি নিয়োগসহ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সুন্দরীদের বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লোভনীয় অফার দিয়ে লাইভ স্ট্রিমিংয়ে এনে ইউজারদের সঙ্গে প্রতারণা করে।
অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের সাইবার অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের পুলিশ সুপার মাহিদুজ্জামান জানান, বাংলাদেশে এই অ্যাপসের ১১ জন এজেন্ট রয়েছে। তারাই ডিজিটাল বা
ভার্চুয়াল কারেন্সি কেনাবেচা করেন। এক লাখেরও বাংলাদেশি ইউজার বিকাশ, রকেট, নগদসহ বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে, হুন্ডি, হাওয়ালা, ক্রিপ্টো কারেন্সি এবং বিদেশি একটি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে ডিজিটাল বা ভার্চুয়াল কারেন্সি কেনেন। যার মাধ্যমে প্রতি মাসে শত কোটির বেশি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরো জানান, স্ট্রিমকার ইউজারের অধিকাংশই জানেন না এটা জুয়া। এই খেলা বা বিন্স বা জেমস নামের ডিজিটাল কারেন্সি কিনতে দেশীয় টাকা লেনদেন যে মুদ্রাপাচার কিংবা মানি লন্ডারিংয়ের মতো অপরাধ। তাই অধিকাংশ ইউজারই না বুঝে খেলছেন ও মুদ্রাপাচার করছেন।
সংবাদ সম্মেলনে রাজধানীর বনশ্রী, নোয়াখালীর সুধারামপুর, সাভার থেকে এমন একটি চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলেও জানানো হয়। গ্রেপ্তারকৃরা হলেন-কুমিল্লার জমির উদ্দিন (৩৫), নোয়াখালীর হোসেন রুবেল (৩৯) ও মনজুরুল ইসলাম হূদয় (২৬) এবং নাটোরের অনামিকা সরকার (২৪)।
এ সময় পুলিশ সুপার আসলাম খান জানান, স্ট্রিমকার অ্যাপসে গ্রুপ চ্যাট, লিপসিং, ড্যান্স, গল্প, কবিতা আবৃত্তিসহ বিভিন্ন অনলাইন জুয়া খেলার অপশন রয়েছে। বাংলাদেশে এই অ্যাপসটিসহ যে-কোনো জুয়া, অনলাইন প্রতারণা আইনগতভাবে নিষিদ্ধ।
তিনি বলেন, অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট দীর্ঘদিন ধরে অনলাইনে এসব প্রতারণা ও ডিজিটাল মুদ্রাপাচার রোধে গোয়েন্দা নজরদারি ও তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করছে। স্ট্রিমকারের মাধ্যমে যারা সাধারণ মানুষকে প্রতারণা ও ডিজিটাল মাধ্যমে মুদ্রাপাচার করছে তাদের চার মাস্টারমাইন্ডকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তিনি আরো জানান, গ্রেপ্তারদের মধ্যে নাটোরের অনামিকা সরকার পড়াশোনা করেন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে। সেখানে থাকতেই এই স্ট্রিমকার জুয়া খেলার অন্যতম প্রধান স্বামী রোকন উদ্দিন সিদ্দিকীর সঙ্গে পরিচয়। এরপর তারা নিজেরা পরিবারের অজান্তে বিয়ে করেন। রাজধানীর বনশ্রীর একটি বাসা ভাড়া নিয়ে এই স্ট্রিমকার খেলা পরিচালনা করে আসছিল। দেড় বছরে তাদের বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। অনামিকাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হলেও পালিয়ে যায় স্বামী রোকন।