হঠাৎ-উন্নতরা এদেশের কোনো ভবিষ্যৎ আছে বলে বিশ্বাস করে না, তারা তাই মহাব্যস্ত দেশের সম্পদ লুণ্ঠনে ও পাচারে। সম্পদ মোগলরা নিয়ে যেত দিল্লিতে, ইংরেজরা নিয়ে গেছে লন্ডনে, পাকিস্তানিরা নিত রাওয়ালপিন্ডিতে; এখন আমাদের বাঙালি ভাইরা পাঠাচ্ছে সুইজারল্যান্ডে, কানাডায়, সিঙ্গাপুরে, মালয়েশিয়ায়। এদের কারো জবাবদিহিতার সামান্যতম দায় নেই। কার কাছে দায় থাকবে? রাষ্ট্র তো এদেরই করতলগত।
উন্নতি কাদের শ্রমে ও ঘামে সম্ভব হচ্ছে তাও আমরা জানি। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ছোট্ট একটি কবিতা লিখেছিলেন ‘কুলি-মজুর’ নামে। ওই কবিতায় পুঁজিবাদী উন্নতির ভেতরকার খবরটা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়ে গেছেন তিনি। ওটি লেখা হয়েছিল আজ থেকে ৯৫ বছর আগে। তিনি জিজ্ঞেস করেছেন রাজপথের মোটর, সাগরের জাহাজ, রেললাইনের রেলগাড়ি, জমিতে অট্টালিকা, এসব কাদের দান, এগুলো কার খুনে রাঙা? জবাবটা তাঁর ওই প্রশ্নের ভেতরেই বসে আছে। সকল উন্নতিই শ্রমিকের শ্রম দিয়ে দিয়ে তৈরি, উন্নতি মাত্রেই শ্রমিকের খুনে রাঙা। বিনিময়ে শ্রমিক কী পেয়েছে? বেতন? কত টাকা? নজরুলের ভাষায় :
বেতন দিয়েছ? চুপ্ রও যত মিথ্যাবাদীর দল্
কত পাই দিয়ে কুলিরে তুই কত ক্রোর পেলি বল্।
কত দিলেন আর কত পেলেন, এ প্রশ্নের জবাবে আমাদের গার্মেন্টস শিল্পের মালিকরা কী বলবেন? কত দিচ্ছেন? বিনিময়ে কত আদায় করে নিচ্ছেন? গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর সারা বিশ্বে আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়েছে। বাংলাদেশে আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সব খবর যে পাওয়া যায় তা নয়, তবু গড়পড়তা হিসাবে দিনে এখন ৩০ জন আত্মহত্যা করছে। খবরটা সংবাদপত্রগুলো জানিয়েছে। মানুষ তো আর শখ করে আত্মহত্যা করে না, বাধ্য হয়েই ওই পথে যায়। নিজের হাতে নিজেকে বধ করার এই প্রবণতা সাক্ষী দিচ্ছে বিজ্ঞাপিত সুখের নিচে মানুষের জীবনে কী ভীষণ অশান্তি চলছে। সড়কে প্রতিদিন গড়পড়তা হত্যা করা হয় দশজনকে, ঘরে ফিরে নিজেই নিজেকে হত্যা করে ত্রিশজন; যেন প্রতিযোগিতা দু’য়ের ভেতর। একটি পত্রিকা বলছে, ‘বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে পুরুষের আত্মহত্যার হার বেশি হলেও বাংলাদেশে এই চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। এখানে নারীরা বেশি আত্মহত্যা করেন’ (ভোরের কাগজ, ১০ সেপ্টেম্বর)। এই বিশেষ ক্ষেত্রে মেয়েরা কেন অগ্রগামী, তার ব্যাখ্যা রয়েছে মেয়েদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ভেতরেই। যে কারণে মেয়েরা পথে-ঘাটে ধর্ষিত হয়, গার্মেন্টসে মানবেতর কাজ খোঁজে, ভাসতে ভাসতে চলে যায় সুদূর সৌদি আরবে, পাচার হয় মধ্যপ্রাচ্যে, ঠিক সে কারণেই মেয়েরা এখানে অধিকসংখ্যায় আত্মহত্যা করে।
জীবনের নিরাপত্তা নেই, কোনো আলো নেই সামনে। ব্যবস্থাটা পুঁজিবাদী। পুঁজিবাদ পিতৃতান্ত্রিক, বাংলাদেশে পুঁজিবাদ সবিশেষরূপে পিতৃতান্ত্রিক। এই ব্যবস্থা মনুষ্যত্বকে তো মারেই, মারে মানুষকেও। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক উন্নতির নামে সাহায্য করার আড়ালে আমাদের অবনতিই ঘটিয়ে চলেছে। একদিকে তারা ঠগ, অন্যদিকে তারা মাসি; ঠগ হিসেবে আসে, আবার মাসি হিসেবেও দরদ দেখায়। দরদের কারণ প্রতি বছরই তারা দেশের ঋণগ্রস্ত দুর্দশার ছবি তুলে ধরে; উদ্দেশ্য দুর্দশাগ্রস্তরা যাতে আরো বেশি ঋণ চায়; নিজেদের দুর্দশা নিয়ে কান্নাকাটি করতে থাকে; এবং কান্নাকাটির তোড়ে দাঁড়ানোর জন্য অত্যাবশ্যক যে আত্মবিশ্বাস সেটা খুইয়ে ফেলে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের অতিসাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে ২০১৫ সালে বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণের কারণে এক বছরেই দুই লাখ চৌত্রিশ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে (ডেইলি স্টার, ১৭ সেপ্টেম্বর)। উন্নতির কড়ি এভাবেই গুনতে হচ্ছে
এদেশের মানুষকে।
এ নিয়ে দেশের মানুষ যে চিন্তা করেন না তা নয়। করেন। চিন্তার ভারে দেশের অধিকাংশ মানুষই ভারাক্রান্ত, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত; যদিও বাইরে তারা ভাবটা করেন হাসিখুশির। ওই ভাবটা আসলে কান্না চেপে রাখার চেষ্টারই নামান্তর।
নীরব অশ্রুপাতও ঘটে। চোখ ঝাপসা হয়ে যায়, পথ দেখতে পান না।
প্রফেসর আজহার হোসেন ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক; বছর দশেক হলো প্রয়াত হয়েছেন। একুশ বছর আগে, ১৯৯৭ সালে ‘বন্ধনহীন গ্রন্থি’ নামে তিনি একটি বই লিখেছিলেন, প্রবন্ধের। বইয়ের প্রবন্ধগুলোর সাহিত্যিক মূল্য তেমন নেই, কিন্তু প্রতিনিধিত্ব মূল্য আছে। বোঝা যায় তাঁর দুশ্চিন্তা তাঁর একার নয়, দেশের অনেকেরই। প্রবন্ধগুলোর একটির নাম ‘সোনার বাংলা’। তাতে তিনি আতঙ্ক প্রকাশ করেছেন জনসংখ্যার বৃদ্ধি দেখে। সে সময়ে দেশের জনসংখ্যা ছিল ১১ কোটি, ভূমি সেই ৫৬ হাজার বর্গমাইল। তাঁর সরল মন্তব্য, ‘সহজেই অনুমান করা যায় আগামী ৫-৭ বছরের মধ্যে আমাদের দেশে কী বিভীষিকাময় অবস্থা হবে।’ এখন জনসংখ্যা কিন্তু অধ্যাপক হোসেন যে সংখ্যাটি দেখে আতঙ্কিত ছিলেন সেই ১১ কোটিতে থেমে নেই, চুপি চুপি ১৮ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এসেছে রোহিঙ্গারাও। জনসংখ্যা ১১ কোটি ছাড়িয়ে গেলে অবস্থা কেমন দাঁড়াবে, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত শিক্ষাবিদ সেটা ভাবতে চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর ধারণা হয়েছিল, ‘লোক গিজগিজ করবে। এ নিয়ে নিজের ভাগ্যকে গালাগালি দেবে যে, এরকম দেশে তার জন্ম হয়েছিল।... এদের মধ্যে যারা ভাগ্যবান, তারা হয়তো কোনো রকমে বিদেশে যেতে পারবে। বাকি সব তো এই সোনার বাংলাতেই থাকবে।’
তা থাকবে। থাকতে বাধ্য হবে। এর বাইরে আর করবেটাই বা কী? কাঁদবে? কপাল চাপড়াবে? সেটা যে চলছে না তা তো নয়। সুযোগ ও ফাঁকফোকর খুঁজবে পালানোর? সে চেষ্টারও অবধি নেই। ভরসা করা যাবে কি সড়কে মানুষ হত্যা ও গৃহে আত্মহত্যার ক্রমবর্ধমান প্রবণতার ওপর? কে জানে! ‘সোনার বাংলা’ কথাটা অধ্যাপক হোসেন পরিহাস করেই ব্যবহার করেছেন। তবে সোনার বাংলার কথা অন্যরাও বলেছেন বৈকি এবং সোনার বাংলা শ্মশান কেন এই প্রশ্ন তুলে যুগপৎ ক্রোধ ও হতাশা ব্যক্ত করেছেন। ব্রিটিশ শাসনের কালে আমরা বলতাম সোনার বাংলা শ্মশান হয়েছে ব্রিটিশদের শোষণের কারণে, পাকিস্তান আমলে বলতাম ঘটনার কারণ পাকিস্তানিদের শোষণ। কিন্তু এখন? এখন তো ব্রিটিশ নেই, পাকিস্তানিরাও বিদায় হয়েছে, তাহলে এখনো সোনার বাংলার এমন দুর্দশা কেন? জবাবটা তো আমাদের অজানা নয়। সেটা এই যে, শাসক বদলেছে কিন্তু শোষণের অবসান হয়নি। এই শোষণ পুঁজিবাদী, অধিকাংশ মানুষের ওপর অল্পকিছু লোকের নিষ্পেষণ কমেনি, উল্টো উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের মানুষের ভেতর যে কর্মশক্তি ও উদ্ভাবনক্ষমতা আছে তা চাপা পড়ে গেছে। জরিপ খবর দিচ্ছে, উদ্ভাবনশক্তিতে বাংলাদেশ এখন এশিয়ার ভেতর সর্বনিম্নে (প্রথম আলো, ১৭ সেপ্টেম্বর)। কর্মদক্ষতা ও উদ্ভাবনশক্তির মুক্তি ঘটলে দেশের অবস্থা পাল্টে যেত, আমরা স্থলে, জলে, মাটির নিচে যত সম্পদ আছে তার সদ্ব্যবহার করতে পারতাম, জীবনযাত্রার সাধারণ মান উন্নত হতো এবং সেই উন্নতির আনুকূল্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিভীষিকাও কমে আসত।
জীবনমানের নিম্নগমন ও জনসংখ্যাবৃদ্ধি যে পরস্পর নির্ভরশীল, সেটা তো বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সত্য। মানুষের ভেতর কী যে অসামান্য শক্তি ও ক্ষমতা রয়েছে, তার প্রমাণ বিশেষভাবেই পাওয়া গেছে একাত্তরে গণহত্যার সময়ে নব্বই হাজার হানাদার পাকিস্তানি সেনার অস্ত্রশস্ত্র ফেলে আত্মসমর্পণ করার ঘটনার ভেতরেই। সে ঘটনা এমনি এমনি ঘটেনি। ঘটেছে জনগণের ভেতরে নিহিত ক্ষমতার কারণে। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাষ্ট্রক্ষমতা চলে গেছে পুঁজিবাদে দীক্ষিত বাংলাদেশিদের হাতে। উন্নতি চলেছে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি ধারাতেই। মানুষ প্রাণ দিল, কিন্তু প্রাণঘাতী পুঁজিবাদী শাসন-শোষণের অবসান ঘটাতে পারল না। সোনার বাংলার এ দুর্দশা হবে না তো কী হবে? তারপরও সোনার বাংলার বাঙালিরা আশাবাদী।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়