উপস্থাপক আপনার নাম ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চে পদার্পণ করতে হবে। মিটমিটিয়ে হেসে সবার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি বিনিময় করতে হবে। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে হবে। মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি, খুচরা কাশি দেওয়া চলবে না। মাইক্রোফোনে কখনো ফুঁ দেবেন না। প্রয়োজনে আঙুলের ডগা (তর্জনী) দ্বারা টোকা দিয়ে দেখতে পারেন মাইক ঠিক আছে কি-না। নিজেকে তখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মনে করতে হবে। কারণ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি না হলে আপনাকে এখানে কেন ডাকা হলো? আপনার হাত-পা কাঁপবে কেন? মনে রাখতে হবে অতীতে মঞ্চে উঠতে পারেননি বলে আপনার অনেক হিরণ্ময় সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে। আপনার বন্ধু-বান্ধবরা দিব্যি সভা-সমিতিতে বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছে অথচ আপনি মঞ্চেই উঠতে পারছেন না। দশজনের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে না পারলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যায় না, সত্য ঘটনা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে না পারলে সালিশির রায় বিপক্ষে চলে যায়। বিভিন্ন সভা-সমিতিতে আপনাকে প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি কিংবা সভাপতিত্ব করার জন্য প্রস্তাব দিলে, আপনি সুকৌশলে শরীর অসুস্থ, কাজে ব্যস্ত কিংবা বিয়ের দাওয়াত আছে- এসব অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে যান। এগুলো আপনার মনের কথা নয়। ভেতরে ভেতরে আপনি কষ্ট পাচ্ছেন। যশ-খ্যাতি ও সুনাম কে না চায়? আপনি চান অথচ জড়তার জন্য পারছেন না। অর্থযুক্ত কথা সুশৃঙ্খলভাবে উপস্থাপন করার নামই বক্তৃতা।
যাহোক, এবার শুরু করুন— শ্রদ্ধেয় সভাপতি (যদি তিনি শ্রদ্ধার ব্যক্তি হন), যদি দেখেন তিনি সংগঠনের সভাপতি হিসেবে পদাধিকার বলে সভাপতিত্ব করছেন, তার বয়সও আপনার চেয়ে কম কিংবা সমবয়সী হলে এমন অবস্থায় শুধু সম্মানিত সভাপতি বললেই চলবে। কারণ অনুষ্ঠান চলাকালীন তিনিই সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি। সভাপতি মানে সভার মধ্যমণি। তারপর আপনি যদি অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি হয়ে থাকেন, তাহলে প্রধান অতিথিকেও সম্মান দেখিয়ে কথা বলতে হবে। বিশেষ অতিথি কয়েকজন থাকলে সেক্ষেত্রে বিশেষ অতিথিবৃন্দ বললেই চলবে। দর্শকদের দিকে তাকিয়ে বলতে হবে- সম্মানিত দর্শকমণ্ডলী, সবাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। কোনো কোনো অনুষ্ঠানে শুধু একজন সভাপতি থাকেন। সেখানে কোনো অতিথি থাকেন না। সে বিষয়টিও লক্ষ রাখতে হবে। অনুষ্ঠানের আয়োজকদের প্রশংসা করতে ভুলবেন না। তাদের কর্মকাণ্ড আপনার পছন্দ না হলে বক্তা হিসেবে সেখানে যাবেন না। আপনাকে যে বিষয়ের ওপর বক্তৃতা দেওয়ার জন্য নির্বাচন করা হয়েছে, সে বিষয় সম্পর্কে আগে থেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে যাবেন। কতক্ষণ বক্তৃতা দিতে হবে, অনুষ্ঠানটি কোথায় হবে, বক্তা হিসেবে কারা কারা থাকবেন, আলোচনার বিষয় পর্বভাগ করা আছে কি-না, মাইক থাকবে কি-না, এসব তথ্য আগে থেকে আয়োজকদের কাছ থেকে জেনে নেবেন।
একই কথা বার বার বলা দুর্বল বক্তার লক্ষণ। শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির অনুষ্ঠানে শুদ্ধ উচ্চারণসহ প্রাঞ্জল ভাষায় বিনম্রভাবে শুরু করবেন। সবসময় শ্রোতার মনোভাব বোঝার চেষ্টা করবেন। কোনো বাহুল্য প্রসঙ্গ তুলে ধরবেন না। শ্রোতা অমনোযোগী হয়ে পড়লে তখন বিভিন্ন ভঙ্গির মাধ্যমে হাস্য-রস সৃষ্টি করার চেষ্টা করবেন। যদি দেখেন কোনো কারণে শ্রোতা একে একে চলে যাচ্ছে, তখন বক্তব্য সংক্ষেপ করে বিদায় নেবেন। পরিশেষে একটি কথাই বলতে চাই, যে পর্যন্ত মঞ্চে না উঠবেন সে পর্যন্ত আপনার জড়তা দূর হবে না। আপনার জ্ঞান-বুদ্ধি ও পাণ্ডিত্য বিকশিত হবে না। একটি কথা মনে রাখতে হবে, ট্রেনিং নিলে সবকিছুতেই সফলতা অর্জন করা যায়। আমাদের ট্রেনিং নেই বলেই নাপিতের মতো চুল কাটতে পারছি না, টেইলার মাস্টারের মতো জামা-কাপড় তৈরি করতে পারছি না। এক্ষেত্রে বলতে হচ্ছে, উল্লিখিত কাজে ট্রেনিং নিলে আমি পারব, আমার ছেলে পারবে, এমনকি আমার বংশধরেরা পারবে। সুতরাং ট্রেনিং না নিয়ে কোনো মঞ্চে উঠে বক্তৃতা দিতে ব্যর্থ হলে দর্শক-শ্রোতা হো হো করে হেসে উঠবে। তখন আপনার মনের অবস্থা কেমন হবে? ভিন্ন ভিন্ন অনুষ্ঠানে ভিন্ন আলোচনার বিষয় থাকে। এ প্রসঙ্গে একটি যুক্তি দাঁড় করাতে চাই। যেমন আমরা একেকদিন একেক রকমের পোশাক পরে থাকি। গতকাল পরেছিলাম পাঞ্জাবি, আজ পরছি শার্ট, আগামীকাল পরব ফুলহাতা গেঞ্জি। ব্যক্তি কিন্তু আমি একজনই। সুতরাং মঞ্চে উঠতে পারলে ভিন্ন ভিন্ন অনুষ্ঠানে ভিন্ন বিষয়ের ওপর বক্তৃতা দেওয়া কঠিন কাজ নয়।
১৯১২ সালে প্রখ্যাত লেখক ডেল কার্নেগি আমেরিকায় এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান চালু করেছিলেন। দ্বিতীয়বার আমি ৩০ এপ্রিল ১৯৯৯ সালে ঢাকার শাহবাগে বক্তৃতা প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করি। বিশেষ কারণবশত মাঝে কয়েক বছর বন্ধ ছিল। তারপর শিক্ষার্থীদের আগ্রহ দেখে ১৪ অক্টোবর ২০১৬ সালে পুনরায় চালু করতে বাধ্য হই। আমার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি হচ্ছে— ১০, কবি জসীম উদ্দীন রোড (কবি জসীম উদ্দীনের বাড়ি), উত্তর কমলাপুর, ঢাকা। প্রতি শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে ১টা এবং শনিবার বিকাল ৩টা থেকে ৬টা পর্যন্ত ক্লাস চলে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, বক্তৃতা প্রশিক্ষণ কোর্স