দেশে এখন দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা কম তা বলা যাবে না। এত পত্রিকার প্রয়োজন আছে কি-না সে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। আর ঠিক এ মুহূর্তে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। কারণ কোভিড-১৯। তারপরও পৃথিবীর মানচিত্রে রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকে আছে। কেননা রাষ্ট্র সার্বভৌম। এর সার্বভৌমত্বে কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
মাত্র সাড়ে তিন দশকের ইতিহাস ধরেই বিচার করা যাক। ’৪৭ থেকে ’৭১ পর্যন্ত যে ভূখণ্ড পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল, অবিকল সেই ভূখণ্ডই আজ বাংলাদেশ নামে পরিচিত। এই ভূখণ্ডে যারা বসবাস করছে তাদের জাতি পরিচয়, ভাষা পরিচয়, ধর্ম পরিচয় কোনো কিছুই বদলায়নি, বদলেছে শুধু রাষ্ট্র পরিচয়। এখন রাষ্ট্রশাসকগণ চাইলেই কি এই জাতিপরিচয়, ভাষা-সংস্কৃতি, ধর্মপরিচয় বদলে ফেলা যাবে? সেটা কখনোই সম্ভব নয়। অথচ পাকিস্তান রাষ্ট্র ঠিক সেটাই চেয়েছিল। তার আবদার ছিল ভাষাপরিচয় ভুলতে হবে, জাতিপরিচয় ত্যাগ করতে হবে, সংস্কৃতিপরিচয় বর্জন করতে হবে, ইতিহাস ভুলতে হবে, সব ঐশ্বর্য ছেড়ে দিয়ে ভিখিরি হয়ে শুধু একটা ধর্মপরিচয় গড়ে তুলতে হবে, একটা সম্প্রদায়ের পরিচয়ে পরিচিত হতে হবে। এই অস্বাভাবিক অভিপ্রায় পূরণ করতে দেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানা আজ সুচিহ্নিত। রাষ্ট্রসত্তা অতি প্রবল আকর্ষণে ব্যক্তিকে টানে। যে রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ— সেই রাষ্ট্রের সব দাবি তার অধিবাসীদের মেটাতে হবে, জন্ম জীবন মৃত্যু তার মধ্যে, তার জন্যে প্রাণ দিতে হবে। কিন্তু তাকে কোথাও অতিক্রম না করেও বাংলাদেশের মানুষ বিশাল বাঙালি সংস্কৃতির উত্তরাধিকার দাবি করবে, তাকে আত্মস্থ করবে, তার বর্তমানকে জীবন্ত, পরস্ফুিট, চলন্ত করতে চাইবে তার অতীত দিয়ে এ তো খুবই স্বাভাবিক। কে কবে চিন্তা করতে পারে যে, একদা পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির মানুষরা কান্ট হেগেলের দাবি নিয়ে মারামারি করছে? শুধু এই বাংলাদেশে, এই শোষণের পীড়নের জালে জড়িয়ে পড়া বাংলাদেশেই আজ যুক্তি দেখাতে হয় কেন পান করব বিশুদ্ধ তৃষ্ণার বারি, কেন নিঃশ্বাস নেব মুক্ত বায়ুতে, কেন থাকতে চাইব সুস্থ সবল। আর এই ভাবনার কাজটি সাধারণ মানুষের মধ্যে ত্বড়িৎ গতিতে ছড়িয়ে দিতে পারে একমাত্র পত্রিকা। যদিও পত্রিকা বের করা এখন একটা ব্যবসারও অঙ্গ। বড় বড় দেশেও জানি একটি বা দুটি পত্রিকাই মোটামুটিভাবে কেন্দ্রে অবস্থান করে। এখন আমাদের প্রচুর মিডিয়া। আর তাই বাঙালি সংস্কৃতির উত্তরাধিকার যে এই দেশ; দেশপ্রেমের অঙ্গীকারে এই মূলমন্ত্রটি ছড়িয়ে দিতে কাজ করতে হবে আজকের কাগজগুলোকে।
লেখক: হাসান আজিজুল হক