সুন্দরবন রক্ষা করতে হবে

সংগৃহীত ছবি

মুক্তমত

সুন্দরবন রক্ষা করতে হবে

  • প্রকাশিত ১১ মে, ২০২১

ইয়াছিন ইসলাম

মায়ের আঁচলকে বলা হয় পরম মমতার স্থান। যেখানে সন্তানরা থাকে নির্ভয়ে আর তাদের থাকে না কোনো বিপদ-আপদের ভয়। কারণ শত বিপদ এলেও মায়ের স্নেহের আঁচল ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। তদ্রূপ বাংলাদেশকে নিজের সন্তানের মতো আগলে রেখেছে সুন্দরবন। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাংলাদেশকে রক্ষায় সব সময়ের জন্য বুক চিতিয়ে লড়াই করে সুন্দরবন। প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, রোয়ানু, বুলবুল, ফণির মতো দুর্যোগ মোকাবিলায় ঢাল হিসেবে কাজ করেছে সুন্দরবন। সর্বশেষ  ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কবল থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করে সুন্দরবন। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ঘণ্টায় গতিবেগ ৭০ কিলোমিটারের মতো কমিয়ে দিয়েছিল এবং জলোচ্ছ্বাস প্রায় ৩-৪ ফুট কমিয়ে দিয়েছিল। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ১৯৬০ সালের পরে সংগঠিত ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে আম্পান সবচেয়ে দীর্ঘ সময় এবং বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে তাণ্ডব চালিয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘসময় এবং বিস্তীর্ণ এলাকা ধরে চলা এই ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতির পরিমাণ ও হতাহতের সংখ্যায় ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়, ২০০৭ সালের সিডর কিংবা ২০০৯ এর আইলার চেয়েও কম হওয়ার অন্যতম কারণ সুন্দরবন। ১৫১ কিলোমিটার গতিতে আম্পান বাংলাদেশের সাতক্ষীরায় আঘাত হানে, তবে এর আগেই সুন্দরবন ঝড়ের গতিবেগ অনেকটাই কমিয়ে দেয়। ঘূর্ণিঝড়টির সঙ্গে আসা জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ১৫ থেকে ১৮ ফুট হওয়ার আশঙ্কা করা হলেও সুন্দরবনের কারণে উপকূলে আছড়ে পড়ার সময় ১০ থেকে ১২ ফুটে নেমেআসে। ফলে উপকূলের মানুষের জীবন ও সম্পদের ক্ষতি কম হয়। সুন্দরবনের মোট আয়তনের ৬২ শতাংশই বাংলাদেশের। এই বিশাল বনাঞ্চল দেশের মানুষের অক্সিজেনের একটি ফ্যাক্টরির মতো কাজ করে। যে কারণে সুন্দরবনকে বলা হয় বাংলাদেশের ফুসফুস। তবে মানুষের অসচেতনতা এবং লোভের কারণে এই ফুসফুস এখন সংক্রমিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আগুন, গাছপালা নিধন, কাঠ ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যে হুমকির মুখে সুন্দরবন।

সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে উঠে আসে গত দুই দশকে ২৩ বার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে সুন্দরবনে। সর্বশেষ গত ৩ মে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর ফলে বনের ৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ বনভূমি পুড়ে যায়। এই অগ্নিকাণ্ডের আগে ২২ বার অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৭১ একর গাছপালা, লতাগুল্ম পুড়ে যায়। এতে আরো জানা যায়, ২০০২ সালে সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের কটকায় একবার, একই রেঞ্জের নাংলী ও মান্দারবাড়িয়ায় দুবার, ২০০৫ সালে পচাকোড়ালিয়া, ঘুটাবাড়িয়ার সুতার খাল এলাকায় দুবার, ২০০৬ সালে তেড়াবেকা, আমুরবুনিয়া, খুরাবাড়িয়া, পচাকোড়ালিয়া ও ধানসাগর এলাকায় পাঁচবার, ২০০৭ সালে পচাকোড়ালিয়া, নাংলি ও ডুমুরিয়ায় তিনবার, ২০১০ সালে গুলিশাখালীতে একবার, ২০১১ সালে নাংলীতে দুবার, ২০১৪ সালে গুলিশাখালীতে একবার, ২০১৬ সালে নাংলী, পচাকোড়ালিয়া ও তুলাতলায় তিনবার, ২০১৭ সালে মাদরাসারছিলায় একবার এবং সবশেষ চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি ধানসাগর এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

২০০২ সাল থেকে শুরু হয়ে ২০২১ সাল পর্যন্ত সংঘটিত এসব অগ্নিকাণ্ডে যে ৭১ একর ৬৬ শতাংশ বনভূমি পুড়ে যায় তা আর্থিক মূল্য প্রায় ১৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। আগুনের ফলে বন ধ্বংসের পাশাপাশি নষ্ট হয় জীববৈচিত্র্য। আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে মারা পরে অনেক বন্যপ্রাণী।

আগুন লাগার কারণে অনুসন্ধানে দেখা যায় অধিকাংশ আগুন বনে মানুষের অসচেতনতার কারণেই লেগে থাকে। বিশেষ করে বনের মধ্যে ধূমপান করে সিগারেটের আগুন ভালোভাবে না নিভিয়ে ফেলা রাখায় শুকনো পাতার দ্বারা আগুনের সূত্রপাত ঘটে। এভাবে ধীরে ধীরে মানুষের নানান অসাবধানতা এবং অকৃতজ্ঞের মতো স্বেচ্ছাচারিতার কারণে সুন্দরবন হারাচ্ছে তার সৌন্দর্য। হুমকির মুখে পড়েছে আমাদের পরিবেশ। সেই সাথে সমুদ্রসৃষ্ট দুর্যোগগুলো থেকে রক্ষায় যে প্রাকৃতিক ঢাল রয়েছে তা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়েছে। আর তাই বন সংশ্লিষ্টতার সঙ্গে জড়িত সকলকে অধিক সচেতন হতে হবে।

সুন্দরবন আমাদের রক্ষাকবচ। সকল বিপদে, দুর্যোগে বুক চিতিয়ে আমাদের জন্য লড়াই করে। তাই তার সুরক্ষায় আমাদেরও রাখতে হবে সচেষ্ট ভূমিকা। এজন্য বন রক্ষায় বন ব্যবহারকারীদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। বন সংলগ্ন মরে যাওয়া নদনদীগুলো খনন করতে হবে। বনে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নজরদারি বাড়ানোর জন্য বনে চারিদিকে বেড়া এবং পাশে ওয়াচ টাওয়ার স্থাপন করতে হবে। সর্বোপরি সরকার থেকে যথাযথ নজরদারি বাড়াতে হবে এবং বন রক্ষায় কার্যকর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।

মনে রাখতে হবে সুন্দরবন আমাদের সর্ব বিপদের বন্ধু। আমাদের মায়ের আঁচলের ন্যায় আগলে রাখে তাই আমাদেরও উচিত মমতাময়ীর আঁচলকেও আগলে রাখা। সকল অনাচার দুষ্কর্ম থেকে সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হবে আমাদের। আর কিছু না হোক আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে হলেও আমাদের সচেতন হতে হবে।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads