সুন্দরবনে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বনের ভেতরে ৮৮টি পুকুর খনন ও পুনঃখননের উদ্যোগ নিয়েছে বন বিভাগ। বন বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, প্রকৃতি ও মানুষের নানা আগ্রাসনে হুমকি বাড়ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে। বনের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা নদীগুলোতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে গেছে। এর ফলে একদিকে সুন্দরীসহ কম লবণসহিষ্ণু গাছের ক্ষতি হচ্ছে। অন্যদিকে প্রভাব পড়ছে বন্যপ্রাণীর ওপর। আবার পলি মাটি বেড়ে যাওয়া, নদীভাঙন ও ভারী নৌযান চলাচলের কারণে প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সুন্দরবন। নানামুখি ক্ষতি থেকে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পুকুরগুলো খনন ও পুনঃখনন করা হবে।
বন বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, পরিকল্পনা অনুযায়ী মোট ৮৮টি পুকুর খনন ও পুনঃখনন করা হবে। কিছু পুকুর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দীর্ঘদিন ধরে ভরাট হয়ে রয়েছে। পাশাপাশি জোয়ারের পানিতে প্লাবিত লবণাক্ত বনভূমির ৭০টি পুকুরে পাকা ঘাট নির্মাণ করা হবে।
কর্মকর্তারা আরো জানান, এই পুকুরগুলো খনন হয়ে গেলে বাঘ, মায়াবী হরিণসহ প্রায় ৪ শ প্রজাতির বন্য প্রাণীর সুপেয় মিঠা পানির চাহিদা পূরণ হবে। পাশাপাশি সুন্দরবনে থাকা বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বনজীবী ও পর্যটকদেরও পানির চাহিদা পূরণ হবে। জানা গেছে, সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মায়াবী হরিণসহ নানা বন্যপ্রাণীর আধিক্য রয়েছে এমন এলাকায় পুকুরগুলো খনন করা হবে। জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে পুকুর খনন ও পুনঃখননে ৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে খনন কাজ শেষ করার টার্গেট রয়েছে।
বন বিভাগের চিফ কনজারভেটর আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, এ উদ্যোগ সফল হলে সুন্দরবনের প্রায় সব প্রজাতির প্রাণীর পানির চাহিদা মিটবে। বন্যপ্রাণী থাকে এমন এলাকায় পুকুর খনন ও পুনঃখনন করা হচ্ছে এবং এ কাজ দ্রুতই শেষ করা হবে।
জানা গেছে, বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগে শরণখোলা রেঞ্জের দুবলায় দুটি ও বগীতে নতুন করে তিনটি পুকুর খনন করা হবে। এছাড়া এই রেঞ্জে ২৪টি পুকুর পুনঃখনন করা হবে। তার মধ্যে কচিখালী অভয়ারণ্যে চারটি, দুবলা এলাকায় তিনটি, শরনখোলা রেঞ্জ সদরে দুটি ও দাশেরভারানীতে দুটি পুকুর রয়েছে।
এছাড়া ডুমুরিয়া, চরখালী, তেরাবেকা, চান্দেশ্বর, শাপলা, ভোলা, শেলারচর, কোকিলমুনি ও সুপতিতে একটি করে পুকুর পুনঃখনন করা হচ্ছে।
চাঁপাই রেঞ্জে পুনঃখনন করা হচ্ছে ২৬টি পুকুর। সেগুলোর মধ্যে ধানসাগর এলাকায় তিনটি, গুলিশাখালিতে দুটি, আমুরবুনিয়া এলাকায় দুটি পুকুর পুনঃখনন করা হবে।
এছাড়া চাঁপাই, ঢাংমারী, লাউডোপ, চেংড়া, ঘাগড়ামারী, নাংলী, হরিণটানা, কলমতেজী, তাম্বুলবুনিয়া, জিউধরা, বরইতলা, কাটাখালি, শুয়ারমারা, মরাপশুর, বৈদ্যমারী, আন্ধারমাণিক, হারবাড়িয়া, নন্দবালা ও চরপুটিয়াতে একটি করে পুকুর খনন হবে।
সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার। যা দেশের সংরক্ষিত বন ভূমির ৫১ ভাগ। সুন্দরবনে সুন্দরী, গেওয়া, গরান ও পশুরসহ ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। ৩৭৫ প্রজাতির রয়েছে বন্যপ্রাণী। এদের মধ্যে রয়েছে বাঘ ও হরিণসহ ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী; কুমির, গুইসাপ, কচ্ছপ, ডলফিন, অজগর ও কিং কোবরাসহ ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী এবং ৩১৫ প্রজাতির পাখি।
সংরক্ষিত এই বনের তিনটি এলাকাকে ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ইউনেস্কো ৭৯৮তম ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইড ঘোষণা করে, যা সমগ্র সুন্দরবনের ৩০ ভাগ এলাকা। দিনে দুবার সমুদ্রের জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হওয়া লবণাক্ত স্থলভাগের পরিমাণ ৪ হাজার ১৪২ দশমিক ৬ বর্গকিলোমিটার। সুন্দরবনের সমুদ্র এলাকার পরিমাণ ১ হাজার ৬০৩ দশমিক ২ বর্গকিলোমিটার। সুন্দরবনের জলভাগে ছোটবড় সাড়ে ৪শ নদ-নদী ও খাল রয়েছে।
সুন্দরবন থেকে এরইমধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানুষের আগ্রাসনে চিরতরে হারিয়ে গেছে এক প্রজাতির বন্য মহিষ, দুই প্রজাতির হরিণ, দুই প্রজাতির গন্ডার ও এক প্রজাতির মিঠাপানির কুমির।