• মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫ | ১৮ চৈত্র ১৪৩১ | ১৮ শাওয়াল ১৪৪৬
সুন্দরবনকেন্দ্রিক স্বার্থান্বেষী কর্মকাণ্ড বন্ধ হোক

সংগৃহীত ছবি

মুক্তমত

সুন্দরবনকেন্দ্রিক স্বার্থান্বেষী কর্মকাণ্ড বন্ধ হোক

  • প্রকাশিত ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপার লীলাভূমি বাংলাদেশ। চোখ জুড়ানো, নজরকাড়া বৈচিত্র্যময় সব সৌন্দর্য যেন সৃষ্টিকর্তার অকৃপণ আশীর্বাদের এক নমুনা। প্রাকৃতিক এই পরিবেশ যেমন বাড়ায় সৌন্দর্য তেমনি রক্ষা করে আমাদের সার্বিক প্রাকৃতিক বিপর্যের হাত থেকে। সুন্দরবন বাংলাদেশ তথা বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় ‘সুন্দরীগাছ’ থেকেই সুন্দরবনের জন্ম। ভৌগোলিক গঠন, জীববৈচিত্র্য, উদ্ভিদবৈচিত্র্য, জীবমণ্ডল এমনকি অর্থনৈতিকভাবে সুন্দরবনের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি, মনুষ্যঘটিত নানা স্বার্থান্বেষী কর্মকাণ্ডের জন্য প্রতিনিয়ত ধ্বংসের পথে যাচ্ছে সুন্দরবনের সার্বিক বৈচিত্র্য, যা রক্ষায় প্রয়োজনীয় নীতিমালা এবং সময়োপযোগী আইন প্রণয়ন করা জরুরি।

সুন্দরবনের অবস্থান গঙ্গা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীত্রয়ের অববাহিকার বদ্বীপ এলাকায়। এই অপরূপ বনভূমি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল অর্থাৎ খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দুই জেলা উত্তর চব্বিশ পরগনা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনাজুড়ে বিস্তৃত। আয়তন প্রায় ১০,০০০ বর্গকিলোমিটার। যার ৬,০০০ কিমি বাংলাদেশের সীমানায় এবং বাকি অংশ ভারতের মালিকানায়। সুন্দরবনের মোট আয়তনের ৬২ ভাগই বাংলাদেশ অবস্থিত। আসা যাক প্রাণীবৈচিত্র্যের কথায়। প্রথমত বলতে হয়, বাঘ বা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের কথা; ২০০৪ সালের হিসাবমতে, সুন্দরবনের বাঘ সংখ্যা ৫০০। মানুষের নানা বেআইনি কাজ, আত্মরক্ষা এবং অভয়ারণ্য না থাকায় বর্তমানে যার সংখ্যা মাত্র ১৬৪! সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান মৌলিক প্রকৃতির এবং যা বন্য প্রাণীর বিশাল আবাসস্থল। বন্য প্রাণীর সংখ্যা এবং এর লালন ক্ষেত্রের ওপর মানুষের সম্পদ সংগ্রহ ও বন ব্যবস্থাপনার প্রভাব অনেক। কচ্ছপ, সুন্দ্রি কাছিম, গিরগিটি, গুঁইসাপ, অজগর সুন্দরবনের প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ, মহিষ, জাভা দেশীয় গন্ডার, সাদুপানির কুমিরের মতো কিছু কিছু প্রজাতি সুন্দরবনে বিরল হয়ে উঠেছে ২১ শতকের শুরু থেকে। সুন্দরবনে মৎস্যসম্পদকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। সব মাছ মিলিয়ে হয় সাদা মাছ, বাকিরা বাগদা, গলদা, কাঁকড়া। ধারণা করা হয় সুন্দরবনে ৩০০ প্রজাতির শিরদাঁড়াওয়ালা মাছ রয়েছে। তবে এ বিষয়ে কখনো গবেষণা করা হয়নি। ফলে সংখ্যা অনুমান ব্যতীত অন্য কিছু সেভাবে বলা সম্ভব নয়। সুন্দরবনের উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের মধ্যেও রয়েছে ভিন্নতা। এখানে প্রচুর পরিমাণে সুন্দরী, গেওয়া, ঝামটি গরান এবং কেওড়া গাছ জন্মে। ১৯০৩ সালে প্রকাশিত প্রেইনের হিসাবমতে সর্বমোট ২৪৫টি শ্রেণি এবং ৩৩৪টি প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। এমনকি অন্য বনাঞ্চলের উদ্ভিদের জীবনচক্রের সাথেও রয়েছে এখানকার উদ্ভিদের পার্থক্য। পার্থক্যের ভিত্তি হিসেবে ধরা হয় বিশুদ্ধ পানি ও নিম্ন লবণাক্ততা এবং পানি নিষ্কাশন ও পলি সঞ্চয়ের প্রভাব।

নানা আঙ্গিকের জীববৈচিত্র্য, উদ্ভিদবৈচিত্র্য, ভৌগোলিক গঠনসহ সংশ্লিষ্ট নানাবিধও কারণেই সুন্দরবনের অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিতে যেমন, ঠিক তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতেও সুন্দরবনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এটি দেশের বনজ সম্পদের একক বৃহত্তম উৎস। এই বন কাঠের ওপর নির্ভরশীল শিল্পে কাঁচামাল জোগান দেয়। এছাড়া কাঠ, জ্বালানি ও মণ্ডের মতো প্রথাগত বনজসম্পদের পাশাপাশি এ বন থেকে নিয়মিত ব্যাপকভাবে আহরণ করা হয় ঘর ছাওয়ার পাতা, মধু, মৌচাকের মোম, মাছ, কাঁকড়া এবং শামুক-ঝিনুক। বৃক্ষপূর্ণ সুন্দরবনের এই ভূমি একই সাথে প্রয়োজনীয় আবাসস্থল, পুষ্টি উৎপাদক, পানি বিশুদ্ধকারক, পলি সঞ্চয়কারী, ঝড় প্রতিরোধক, উপকূল স্থিতিকারী, শক্তি সম্পদের আধার এবং পর্যটনকেন্দ্র।

এই বন প্রচুর প্রতিরোধমূলক ও উৎপাদনমূলক ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৫১ শতাংশজুড়ে সুন্দরবনের, বন থেকে আসা মোট আয়ে অবদান প্রায় ৪১ শতাংশ এবং কাঠ ও জ্বালানি উৎপাদনে অবদান প্রায় ৪৫ শতাংশ (বিশ্ব খাদ্য সংস্থা, ১৯৯৫)। অনেক শিল্প (নিউজপ্রিন্ট, দিয়াশলাই, হার্ডবোর্ড, নৌকা, আসবাবপত্র) সুন্দরবন থেকে আহরিত কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল। এছাড়া প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রতিরোধে সুন্দরবন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অদ্বিতীয় ভূমিকা পালন করে। আক্ষরিক ভাষায় সুন্দরবনকে তাই ‘ন্যাচারাল প্রোটেকটর গিফটেড বাই গড’ হিসেবে অভিহিত করাই শ্রেয়। সিডর, আইলা, আম্ফান, নার্গিসের মতো ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের সময় নিজ বুকে আঘাত নিয়ে আমাদের ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে সুন্দরবন।

সুন্দরবনের যে অসীম সম্পদ রয়েছে তা নানা গোষ্ঠী অবৈধভাবে ব্যবহার করতে সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। এমনকি মধু বা গোলপাতা সংগ্রহকারী কিংবা জেলেদের অপহরণের মাধ্যম তারা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বিভিন্ন বনদস্যুরা। দীর্ঘদিন তাদের কাছে অসহায় ছিল সুন্দরবন অন্যান্য সবাই। তবে ইদানীংকালে অনেকাংশে এসব বনদস্যুকে আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার দৃশ্যপট দেখা যাচ্ছে। ২০১৬ সালে মাস্টার বাহিনী নামে সুন্দরবনের সবচাইতে বড় বনদস্যু বাহিনী বাংলাদেশের মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। সেখান থেকেই শুরু। তখন তারা তাদের আগ্নেয়াস্ত্র জমা দেয় এবং পুনর্বাসনে রাজি হয়। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা তাদের পুনর্বাসনের সুযোগ করে দিচ্ছে। এসব দৃশ্যপটের যত বেশি পুনরাবৃত্তি ঘটানো যায় ততই মঙ্গল।

সুন্দরবন গবেষণার বড় একটি ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে। যদিও সুন্দরবনকেন্দ্রিক বড় কোনো গবেষণাধর্মী কাজ চোখে পড়ে না। তবে এ ব্যাপারে সচেতনতা খুবই জরুরি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিশেষত বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।

সুন্দরবন বাংলাদেশ নয় বরং পৃথিবীর সম্পদ।

সুন্দরবনকে সুরক্ষা দেওয়া বা ক্ষতিকারক কাজ না করাই সুন্দরবন তথা পৃথিবীর জন্য মঙ্গল। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিস্থিতিতে সুন্দরবন ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের ঐতিহ্য মনে করে দেশপ্রেমের অংশ হিসেবে যা রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সকলের। সুন্দরবন ৬ ডিসেম্বর ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে, যা আমাদের বিশ্বের বুকে দেশের মর্যাদাকে সুসংহত করেছে। দায়িত্ববোধের জায়গা কমার বদলে উল্টো তাই বেড়েছে। ১৪ ফেব্রুয়ারিকেন্দ্রিক কোনো দিবস হিসেবে নয় বরং প্রতিদিনই সুন্দরবন সম্পর্কে রাষ্ট্রের দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন। ভালো থাকুক সুন্দরবন, ভালো থাকুন সুন্দর এই ভুবন।

লেখক :অনন্য প্রতীক রাউত

শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads