সিলেটে ভূমিকম্প নিয়ে উৎকণ্ঠা

ছবি: বাংলাদেশের খবর

প্রাকৃতিক দুর্যোগ

সিলেটে ভূমিকম্প নিয়ে উৎকণ্ঠা

  • প্রকাশিত ৩১ মে, ২০২১

মুহাম্মদ আমজাদ হোসাইন/ইমরান আহমদ, সিলেট

সিলেট নগরে শনিবার চার ঘণ্টার মধ্যে পরপর ৬ দফা ও গতকাল রোববার ভোর ৪টা ৩৫ মিনিটে আরেকদফা ভূমিকম্প হয়। এসব কম্পন আসলেই কী প্রাকৃতিক ভূমিকম্প ছিল, নাকি ছিল কৃত্রিম কম্পন? শনিবার বারবার ভূমিকম্পের পর রাত থেকে এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে চলতে থাকে নানা আলোচনা। এই কম্পনকে প্রাকৃতিক ভূকম্পন মানতে নারাজ অনেকে। ফেসবুকে অনেকেই লিখছেন গ্যাস উত্তোলন কাজে নিয়োজিত শেভরন তাদের জরিপ কাজের জন্য ভূগর্ভে মাইন বিস্ফোরণ ঘটানোর ফলে বারবার এরকম কম্পনের সৃষ্টি হয়েছে। তবে গতকাল রোববার সকালে সিসিক মেয়র জানিয়েছেন শেভরন কোনো মাইন বিস্ফোরণ ঘটায়নি। নগরীর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে আমরা যোগাযোগ করেছি, তাদের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে বলা হয়েছে মাইন বিস্ফোরণ কাজ অনেকে আগেই শেষ হয়েছে।

এদিকে, আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে শনিবার ও রোববার তাদের রিখটার স্কেলে মোট ৫টি ভূমিকম্প রেকর্ড হয়েছে। এর মধ্যে শনিবার ৪টি ও গতকাল রোববার ১টি। সবটিরই উৎপত্তিস্থল সিলেটের আশপাশে। ঢাকা থেকে উত্তর-পূর্বে এর অবস্থান।

এদিকে, নগরের বাসিন্দারা বলছেন শনিবার ও রোববার ভোর পর্যন্ত মোট ৭ বার কেঁপে উঠে নগরী। যে কম্পন শুধু সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকার ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল। এ কারণেই দুদিনে ৭ বার হওয়া কম্পন নগরবাসীসহ সাধারণ মানুষের মাঝে নানা জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিয়েছে, বাড়াচ্ছে উৎকণ্ঠাও। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানান মন্তব্য প্রকাশ পাচ্ছে।

সিলেটের সিনিয়র সাংবাদিক কবির আহমদ সুহেল নিজের স্ট্যাটাসে লিখেন- ভূমিকম্প, মাইন বিস্ফোরণ আর ট্রাকের চাক্কা ব্লাস্ট! সিলেটধরা কেঁপেছে কয়েকবার। কিন্তু এটা ভূমিকম্প না মাইন বিস্ফোরণ! কোনো অনুসন্ধান নেই। তথ্য নেই। দায়িত্বশীল বক্তব্য নেই। লাইভে ভাসছে দেশ। বারবার কেঁপে উঠছে সিলেট। তাও আবার নগরীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই হলো হাল। ভূমিকম্পের আতংক। ভূমিকম্প আল্লাহর গজব। আরো আসছে বড় ভূমিকম্প। এসব তথ্য প্রচারে বেসামাল মিডিয়া।

নগরীতে বারবার কম্পন বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট প্রেস ক্লাব সভাপতি ইকবাল সিদ্দিকী ‘বাংলাদেশের খবর’-কে বলেন, আমরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ নয়, এজন্য বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে শনিবারের ভূমিকম্পের পর থেকে নানানজন নানা মন্তব্য করছেন, তা ঠিক নয়। আবহাওয়া অফিস বিষয়টি কখনো ধামাচাপা দিতে পারবে না। কারণ তাদের রিখটার স্কেলে যেটি সংরক্ষণ হবে সেটি ঢাকা অফিসেও হবে। এমনকি ভারত ও আমেরিকায় সংরক্ষণ হবে। এজন্য সংশ্লিষ্টরা যেটা বলবেন সেটাই মানতে হবে।

কম্পন সিলেট নগরীতে সীমাবদ্ধ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সিলেট শহর আগে থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এজন্য কম্পনটি এখানেই হয়েছে। একই টাইমে অন্যান্য দেশেও হতে পারে, যেটি আমরা জানি না।

শেভরনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টা নিয়ে অনেকে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি বর্তমানে সিলেটের কোথাও শেভরন খনন কাজ করছে না। এ কাজ তারা অনেক আগেই শেষ করেছে। এখন তারা শুধু তেল-গ্যাস সংগ্রহ করছে। এজন্য সকলের উদ্দেশে বলতে চাই- কোন কিছু নিয়ে মন্তব্য করার আগে বিষয়টি সম্পর্কে ভাল করে জানতে হবে। অহেতুক বিভ্রান্তি ছড়ানো থেকে বিরত থাকারও আহবান জানান সিনিয়র সাংবাদিক ইকবাল সিদ্দিকী। 

সিলেট নগরীর বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ছালেহ আহমদ বলেন- শনিবারের কম্পগুলো আমি বুঝতে পেরেছি; কিন্তু রোববার বুঝিনি। তবে আমার ৫৫ বছরে একদিনে এতবার ভূমিকম্প দেখিনি বা শুনিনি। সবচেয়ে বড় আশ্বচয্য বিষয় হচ্ছে- আগে ভূমিকম্প হলে আশপাশের উপজেলার মানুষ কিছুটা হলেও টের পেতেন।

কোম্পানীগঞ্জ প্রেস ক্লাব সভাপতি শাব্বির আহমদ বলেন- আমাদের উপজেলা সিলেট নগরের একেবারে পাশে অবস্থান। এখানে আমরা কেউই ভূমিকম্পের লক্ষণ বুঝিনি। এটি শুধু সিলেট নগরে সীমাবদ্ধ ছিল। এতে ধারণা করা হচ্ছে ভূ-প্রাকৃতিক কোন কাজের জন্য এরকম কম্পন সৃষ্টি হয়েছে। এতে জনমনে সন্দেহ সৃষ্টি হচ্ছে। 

গোলাপগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও সাংবাদিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি অজামিল চন্দ্র নাথ জানান, গোলাপগঞ্জে আমরা এরকম কম্পনের কোন খবর পাইনি বা অনুভব করিনি। তবে সিলেট শহরে বারবার কম্পনের খবর পেয়ে চিন্তিত আমরা সকলেই।

দক্ষিণ সুরমা প্রেসক্লাব সেক্রেটারি আশরাফুল ইসলাম ইমরান বলেন, আমরা সিলেট নগরীর লাগোয়া। এখানকার কোন মানুষ কম্পনের টের পাননি। তবে নগরীতে বারবার কম্পন হওয়ায় স্থানীয় মানুষের মধ্যেও আতঙ্ক বিরাজ করছে।

এ ব্যাপারে শেভরনের কমিউনিকেশন কর্মকর্তা শেখ জাহিদুর রহমান জানান, সিলেটে শেভরনের কোনো জরিপ কাজ চলমান নেই। শেভরন কোন মাইন বিস্ফোরণও ঘটায়নি। ভূকম্পনের সাথে শেভরণের কোন সম্পৃক্ততা নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে ভূমিকম্প নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। শেভরনকে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে নগরভবনে ডাকা হয়েছে, এই বিষয়টিও অস্বীকার করেছেন তিনি।

সিলেট আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবীদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী জানান, সাধারণত বড় কোনো ভূমিকম্পের আগে বা পরে এমন দফায় দফায় মৃদু কম্পন হতে পারে। তবে আশার কথা সিলেটের ভেতরে কোনো ফাটল নেই। যদিও মিয়ানমার ও ডাউকী এলাকায় ফাটল রয়েছে। একই দিন সাতবার ভূমিকম্প হয়েছে এমন খবর প্রচার হওয়া সম্পর্কে আবহাওয়াবিদ বলেন, ‘রিখটার স্কেলে ২ মাত্রার নিচে ভূমিকম্প হলে আমরা তা হিসাবে নেই না।

সিলেট সিটি করপোরেশন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী জানান, নগরীতে ভূমিকম্প হওয়ার পর থেকে নানানজন নানা মন্তব্য করছেন। শেভরনের বিস্ফোরণ নিয়েও অনেকে মন্তব্য করছেন, আমরা তাদের সাথে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হয়েছি, তারা এ ধরনের কোন কাজ করেনি। যারা না যেনে নানাভাবে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।

এদিকে, দফায় দফায় ভূমিকম্পের পর বিশেষজ্ঞরা জনসাধারণকে সতর্ক ও সচেতন থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। এই অবস্থায় ভূমিকম্প নিয়ে এরকম অপপ্রচার জনসচেতনতা সৃষ্টিতে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে বলেও মনে করছেন সচেতন মহল।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও পরিবেশ কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম বলেন, ‘ছোট ছোট ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের বার্তা বহন করে। তাই আগামী কয়েকদিন সিলেটের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই কয়েকদিন সবাইকে সতর্ক থাকা উচিত। এর মধ্যে বড় ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads