মুক্তমত

সামরিক শক্তি অর্জনে প্রয়োজন টেকসই অর্থনীতি

  • প্রকাশিত ২৮ জুন, ২০২১

সৈকত সরকার

বর্তমান বিশ্বে একটি দেশকে মূল্যায়ন করা হয় তার অর্থনীতি এবং সামরিক সক্ষমতা দিয়ে। কারণ বর্তমানে অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তিতে এগিয়ে থাকা দেশগুলোই বিশ্বের নেতৃত্ব দিচ্ছে। এছাড়া সামরিক শক্তি অনেকাংশেই নির্ভর করে অর্থনীতি অবস্থার ওপরে। স্বাভাবিকভাবেই অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হলে সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়, অত্যাধুনিক সামরিক অস্ত্র ক্রয় করা যায়। একটু লক্ষ করলে দেখা যায়, বিশ্বের পরাশক্তি দেশগুলোর প্রায় প্রত্যেকটি দেশই অর্থনৈতিকভাবে প্রথম স্থানে রয়েছে।

অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী প্রথম সারির ১০টি দেশের জিডিপি যথাক্রমে—যুক্তরাষ্ট্র (২০.২১ ট্রিলিয়ন), চীন (১৪.৮৬ ট্রিলিয়ন), জাপান (৪.৯১ ট্রিলিয়ন), জার্মানি (৩.৭৮ ট্রিলিয়ন), যুক্তরাজ্য (২.৬৪ ট্রিলিয়ন),  ভারত (২.৫৯ ট্রিলিয়ন),  ফ্রান্স (২.৫৫ ট্রিলিয়ন), ইতালি (১.৮৫), কানাডা (১.৬০) এবং দক্ষিণ কোরিয়া (১.৫৯ ট্রিলিয়ন)। (তথ্যসূত্র গ্লোবাল পিইও সার্ভিস )

উপর্যুক্ত এই দেশগুলোই বিশ্বের পরাশক্তির জায়গা দখল করে আছে। গ্লোবাল ফাইয়ার পাওয়ার যারা আন্তর্জাতিক দেশগুলোর সামরিক শক্তি নির্ণয় করে থাকে এবং এদের ২০২১ সালের জরিপ অনুযায়ী সামরিক শক্তিতে এগিয়ে থাকা প্রথম ১০টি দেশ হচ্ছে—যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, পাকিস্তান। উল্লেখ্য, গ্লোবাল ফাইয়ার পাওয়ারের সমীক্ষা অনুযায়ী ২০২১ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ০.৭৪৭৩ স্কোর নিয়ে ৪৫তম, যা কি না ২০১৪ সালে ৫৫তম ছিল। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, বাংলাদেশ সামরিক দিক থেকে ব্যাপক এগিয়েছে। বাংলাদেশ এখন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন অত্যাধুনিক অস্ত্র ক্রয় করছে। বাংলাদেশ যেসব দেশ থেকে সামরিক অস্ত্র সরঞ্জাম ক্রয় করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—চীন, ইতালি, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সার্বিয়া, ইউক্রেন, যুক্তরাষ্ট ও জার্মানি।

বাংলাদেশের প্রধান তিন বাহিনীর মধ্যে বিমানবাহিনীর অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। শুরুতে তিনটি বিমান, নয় জন পাইলট ও সাতচল্লিশ জন বিমানসেনা নিয়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর যাত্রা হয় ১৯৭১ সালে। তবে সময়ের পরিক্রমায় তার পরিবর্তন হয়েছে খুব দ্রুত। বর্তমানে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ১৭ হাজার ৩৯০ জন বিমানবাহিনীর সেনা রয়েছেন। বাংলাদেশ সরকার বিমান বাহিনীকে বিশ্বমানের করার জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে মিগ-২৯ মডলের  ৮টি, চীনের কাছ থেকে এফ-৭ মডলের ৩১টি জঙ্গিবিমান ক্রয় করেছে। এছাড়া ১২টি সামরিক পরিবহন বিমান রয়েছে, যেগুলো  যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেন থেকে ক্রয় করা হয়েছে। এছাড়া নাইটভিশন গগলস প্রযুক্তির সংযোজন করার মাধ্যমে বিমানবাহিনীকে আরো শক্তিশালী ও দৃঢ় করা হয়েছে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অফিসার ও বিমানসেনা মিলিয়ে ৬০০-এর অধিক জনবল, ১২টি হেলিকপ্টার ও ১টি পরিবহন বিমান বর্তমানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে মোতায়েন রয়েছে, যা বাংলাদেশকে এক অনন্য সম্মান এনে দিয়েছে। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ডিসেম্বরে এক অনুষ্ঠানে বলেন, আমাদের সরকার বিমান বাহিনীতে যুক্ত করেছে এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান, এমআই-১৭১ এসএইচ হেলিকপ্টার, অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র, এসএএম এফএম ৯০। যুদ্ধবিমানসহ সব ধরনের বিমান ও অন্যান্য যন্ত্রপাতির সুষ্ঠু, নিরাপদ ও সাশ্রয়ী রক্ষণাবেক্ষণ এবং ওভারহোলিংয়ের জন্য নির্মিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু অ্যারোনটক্যািল সেন্টার এবং পূর্ণাঙ্গ ঘাঁটি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে বঙ্গবন্ধু ও কক্সবাজার বিমান ঘাঁটি। অন্যদিকে নৌবাহিনীর দিকে নজর দিলেও দেখা যাচ্ছে গত চার বছরে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষে সমুদ্রসীমা রায় এবং  চীনের কাছ থেকে সাবমেরিন বিএনএস নবযাত্রা ও বিএনএস জয়যাত্রা ক্রয় ইত্যাদি সংযোজন নৌবাহিনীকে আরো শক্তিশালী করে তুলেছে।

তবে প্রতিরক্ষা বিভাগের ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হলেও বহির্বিশ্বের প্রেক্ষাপটে  তা এখনো অনেক  ক্ষুদ্র।  যদিও বাংলাদেশ কখনই যুদ্ধংদেহী মনোভাব পোষণ করেনি এবং সকল ক্ষেত্রেই শান্তি ও নিরপেক্ষতার নীতি বজায় রেখেছে। তারপরও আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে এবং জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন আরো অধিক উন্নতমানের সামরিক বাহিনী। এক্ষেত্রে অস্ত্র ক্রয় করার ক্ষেত্রে যেসব বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হয় তা হচ্ছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। কারণ অস্ত্র এবং সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করতে প্রয়োজন প্রচুর অর্থ এবং কূটনৈতিক সহায়তা। এক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ভূমিকা থাকে ব্যাপক, যা আমরা সামপ্রতিক সময়ে লক্ষ করেছি। তবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বাধাবিপত্তি কমে এসেছে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) প্রকাশিত এক রিপোর্ট ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবিল ২০১৯’-এর তথ্য অনুসারে, ২০৩২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের বড় ২৫টি অর্থনীতির দেশের মধ্যে একটি হবে। তখন বাংলাদেশ হবে ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। বর্তমানে অবস্থান ৪১তম। ২০৩৩ সালে আমাদের পেছনে থাকবে মালয়েশিয়া, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশ। আগামী ১৫ বছর দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি গড়ে ৭ শতাংশ থাকবে। এদিক থেকে চিন্তা করলে দেখা যাচ্ছে, সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করার মতো বাংলাদেশের যথেষ্ট সামর্থ্য রয়েছে এবং তা ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছেও। গত ৩ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাংলাদেশের ৫০তম জাতীয় বাজেট ঘোষণা করেন। সেখানে সশস্ত্র বাহিনী ও প্রতিরক্ষা বিষয়ক দপ্তর ও সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতে ৩৭ হাজার ৬৯১ কোটি টাকার পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে, যা গত বছরে তুলনায় ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। বিগত বছরের সামরিক বাজেট লক্ষ করলে দেখব এ বছরের সামরিক বাজেট সবচেয়ে বেশি।

এভাবে প্রত্যেক বছরই সামরিক বাজেট ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে এই বৃদ্ধি ধরে রাখার এবং দ্রুত অগ্রগতির জন্য অর্থনৈতিক উন্নতি অব্যাহত থাকতে হবে। কারণ আধুনিক অস্ত্র সরঞ্জাম ক্রয়, সৈন্যদের উন্নত প্রশিক্ষণ, সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি এবং অন্যান্য সামরিক কাযক্রম সম্পাদনে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। পর্যাপ্ত অর্থ না থাকলে সামরিক বাজেট বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে আরো শক্তিশালী হতে হবে এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য দেশের তরুণসমাজকে কাজে লাগাতে হবে। তরুণ প্রজন্মের চাকরি নির্ভরতা কমাতে হবে এবং আত্মকর্মসংস্থান গড়ে তুলতে সহায়তা করতে হবে। যার ফলে দেশে অধিক কর্মসংস্থান গড়ে উঠবে এবং দেশীয় পণ্য বিদেশে রপ্তানির করে বৈদেশিক আয় বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। এছাড়া সামরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য সমরাস্ত্রে উন্নত দেশগুলোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করতে হবে। তবে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য কেবল উন্নত অস্ত্রই যথেষ্ট নয়, তা পরিচালনা করার জন্য লাগবে দক্ষ সৈনিক। আর সেজন্য সৈন্যদের উচ্চ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশে সেনা প্রশিক্ষণাগার বৃদ্ধি করতে হবে। এভাবে অর্থনীতির সাথে সামরিক শক্তির সামঞ্জস্যতা এবং উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে পারলেই বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বে মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারবে। সামরিক অস্ত্রের জন্য আমাদের শুধু অন্য দেশের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকলেই চলবে না। আমাদের দেশেও নিজস্ব প্রযুক্তির অত্যাধুনিক সামরিক অস্ত্র তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের তরুণ প্রজন্মের মেধাকে কাজে লাগানোর জন্য দেশে উন্নতমানের অস্ত্র গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিতে হবে এবং শিক্ষা ও গবেষণা খাতে সরকারকে আরও বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে।

বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশের জনগণ সবসময় নীতিগতভাবে সব ধরনের অমানবিকতা ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বিরুদ্ধে এবং শান্তি ও মানবিকতার পক্ষে। বাংলাদেশ তার নিজস্ব সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করবে কেবল ভূখ্লের অখন্ডতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরীহ জনগণের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য। স্বাভাবিকভাবেই একটি ছোট ভূখ্লের এবং অর্থনৈতিকভাবে উর্বর দেশ হওয়াতে বাংলাদেশের উপর বহির্বিশ্বের বিভিন্ন চাপ এবং হুমকি আসতেই পারে। এই জন্য নিজের আত্মরক্ষা এবং আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে ও টিকে থাকার জন্য সামরিক সক্ষমতার প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশ শুধু সেই লক্ষ্যেই কাজ করবে। সব বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বের পথে এগিয়ে যাক, এমনটাই কাম্য।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads