এখনকার শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় যে পরিমাণ অংশগ্রহণ করেন বা মগ্ন থাকেন সেই তুলনায় এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিতে দেখা যায় না। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন, নেতৃত্ববোধ, মানবিকবোধ, মানসিক ও সামাজিক বিকাশ, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন ইতিবাচকতায় দক্ষ করে তুলতে সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের পছন্দের বিষয়ে অতিরিক্ত যোগ্যতা অর্জন শিক্ষার্থীদের জীবনে বয়ে আনতে পারে অনেক উপকার। শিক্ষার্থীদের জন্য এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটির গুরুত্ব, যুক্ত হওয়ার নানাবিধ কারণ জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের পছন্দের বিষয়ে অতিরিক্ত যোগ্যতা অর্জন করাই এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিস বা সহশিক্ষা কার্যক্রমের লক্ষ্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা মূল সিলেবাস কিংবা পুঁথিগত বিষয়ের বাইরে নিজেদের জ্ঞান ও দক্ষতার জায়গাগুলোয় উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে যে কাজগুলো করে থাকেন সেগুলোই এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি। যে কোন কাজ যা আপনার বিশেষ কোন গুণের প্রকাশ ঘটায় এবং সরাসরি পড়াশোনার সাথে সম্পর্কিত নয়, তাই সহশিক্ষা কার্যক্রম।
শিক্ষার্থীদের কেন জরুরি
এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি একদিকে মেধাকে শানিত করে, অন্যদিকে অর্জিত জ্ঞানকে প্রয়োগ করার সুযোগ তেরি করে দেয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পাঠ্য বইপত্রের মাঝে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলে একজন শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি নেতৃত্ববোধ, মানবিকবোধ, সমাজ-রাষ্ট্র-নিজের বাস্তব জীবন সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার সম্ভবনা অনেক বেশি রয়েছে। এছাড়া আন্ডারগ্র্যাজুয়েট লেভেলে বিদেশে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণে অন্যান্য কিছুর পাশাপাশি প্রয়োজন এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটি, যা আপনাকে স্বপ্ন পূরণে পাথেয় হতে পারে। একজন শিক্ষার্থীর এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি থেকে তার নানা দক্ষতা সম্পর্কে জানা যায়। তাই একাডেমিক রেজাল্টের পাশাপাশি এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিও সম গুরুত্বপূর্ণ। কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, সৃজনশীলতা বৃদ্ধি, মানসিক বিকাশ, অভিজ্ঞতা লাভ, সামাজিকীকরণ, চাকরির প্রার্থী হিসেবে এগিয়ে রাখা, দলগতভাবে কাজের শিক্ষা অর্জন, সামাজিক সুযোগগুলো উম্মুক্ত হওয়া, আত্মসম্মান বৃদ্ধি, নিজের আগ্রহ প্রকাশ করার সুযোগ অর্জন, একাডেমিক পারফরমেন্স উন্নত করা, সময়ের সদ্ব্যবহার, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি, বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি ইত্যাদি সুযোগ ও সুবিধা বা উপকারিতা অর্জিত হয় এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি থেকে।
সহশিক্ষা কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত
প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই বিভিন্ন ধরনের সংগঠন বা ক্লাব রয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত। যেমন: বিতর্ক, আবৃত্তি, ছবি আঁকা, নাটক, গান, কুইজ, তবলা, বাঁশি বাজানোর চর্চা, ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, ক্যারিয়ার ক্লাব, সিনেক্লাব, ম্যাথ বা ফিজিক্স অলিম্পিয়াড, স্বেচ্ছাসেবকের কাজ, বইপড়া ক্লাব, বিজ্ঞানচর্চা ক্লাব, দেয়ালিকা বের করা ইত্যাদি। সাক্ষরতা অভিযান, স্বাস্থ্য সপ্তাহ পালন, রক্তদান কর্মসূচি, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি ইত্যাদি কর্মসূচিও পরিচালনা করে থাকেন শিক্ষার্থীদের সংগঠনগুলো। স্কুল পর্যায়েই রয়েছে স্কাউট, গার্লস গাইড। এ ছাড়া বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, যারা নিয়মিত স্বেচ্ছাসেবা ছাড়াও আকস্মিক ও জরুরি প্রয়োজনে বিভিন্ন কর্মসূচি (যেমন বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস পরবর্তী সময়ের ত্রাণ ও সেবা কার্যক্রমে) অংশগ্রহণ করে। তা ছাড়া যদি আপনি পারিবারিক কোন দায়িত্ব পালন করেন সেটাও আপনার এক্সট্রা কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। মোটকথা পড়াশোনার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত নয় কিন্তু দক্ষতার প্রমাণ হিসবে কাজ করবে এমন যে কোন কিছুই এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটির অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ কিসে
একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আপনি যে কোন এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিতে অংশ নিতে পারেন। এগুলোর মধ্যে অন্যতম—উৎসব আয়োজন, খেলাধুলা, বিতার্িকক, গানবাজনা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, নাটক, সামাজিক সংগঠন। এছাড়া গল্প প্রতিযোগিতা, প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা, আবৃত্তি প্রতিযোগিতা, স্কুল ম্যাগাজিন, দেয়ালিকা প্রকাশ, ভাস্কর্য তৈরী, অ্যালবাম তৈরি, ফটোগ্রাফি ইত্যাদি। তাছাড়া আপনার ভালো লাগার যে-কোনো বিষয়ে অংশ নিতে পারেন।
শিক্ষার্থীদের মানসিক ও সামাজিক বিকাশে সহায়তা করে
এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি বা পাঠক্রমবহির্ভূত কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের মানসিক ও সামাজিক বিকাশে সহায়তা করে। তাদের ভেতরে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটায় এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। একজন শিক্ষার্থী যখন তার আগ্রহ ও পছন্দের কাজের সাথে যুক্ত থাকে, সেখান থেকে প্রচুর আনন্দ ও মানসিক শক্তি আসে, যা তাকে তার জীবনের অন্যান্য মানসিক চাপগুলোর সাথে মোকাবিলা করতে সহায়তা করে। তা ছাড়া এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা একে অপরের সাথে এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সাথে সংযুক্ত থাকে, ফলে যখন একজন শিক্ষার্থী কোনো বিপদ বা মানসিক সংকটের মধ্য দিয়ে যায়, সহজেই অন্যদের কাছে সহযোগিতা চাইতে পারে। মানসিকভাবে সুস্থ ও স্বাস্থবান থাকার জন্য এই ধরনের সামাজিক সহযোগিতা বা পারস্পরিক সহযোগিতা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তবে এসব পাঠক্রম বহির্ভূত কার্যক্রম যখন বিকাশমূলক না হয়ে অতিরিক্ত প্রতিযোগিতামূলক হয় তখন তা খুব বেশি সহযোগিতা করে না বরং মানসিক চাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেইসাথে টাইম ম্যানেজমেন্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ। এইসব কার্যক্রমের অতিরিক্ত চাপ যদি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা, বিশ্রাম বা পারিবারিক বন্ধন ও দায়িত্বের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তা একজন শিক্ষার্থীর মানসিক চাপ বাড়িয়ে দিতে পারে। অর্থাৎ আমাদের মানসিক প্রশান্তি এই সবকিছুর ভারসাম্যের ওপরও নির্ভর করে।
রাউফুন নাহার
শিক্ষক, এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সাম্প্রদায়িক সমপ্রীতি ও সহনশীলতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে
বিশ্ববিদ্যালয় কেবল তত্ত্বীয় জ্ঞানচর্চার জায়গা নয়। প্রতিটি শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা, মননশীলতা ও মনুষ্যত্ব বিকাশে কাজ করাও বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব। বিশ্বের নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে, যুক্তি দিয়ে কথা বলতে, দৃঢ় কিন্তু শোভন উপায়ে নিজের মতামত প্রকাশ করতে, নেতৃত্ব দিয়ে কোনো প্রোগ্রাম সফল করতে শেখাও জীবনের জন্য জরুরি। আর এসব বিষয়ে শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে তুলতে সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রমের কোনো বিকল্প নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পরিচালনা করে এমন বেশ কিছু সংগঠন ও ক্লাব রয়েছে। খুব ভালো কাজ করা সংগঠনের একটি হলো বাঁধন। বাঁধনের কর্মী শিক্ষার্থীরা সব রোগীর জন্য রক্ত সংগ্রহ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের প্রোগ্রামে রেঞ্জার শিক্ষার্থীরাও কাজ করে দায়িত্বের সাথে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তঃহল ও আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় প্রতি বছর। বিভাগ ও ইনস্টিটিউটগুলোও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও খেলাধুলার আয়োজন করে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীর সংখ্যা ও চাহিদার তুলনায় সহশিক্ষাক্রমিক কার্যযক্রমের পরিমাণ কম। সব আয়োজন নিয়মিতও নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা অংশ নিতে পারে এমন আয়োজনও নগন্য। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহনশীলতা বাড়াতেও সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। শিক্ষার পরিপূর্ণতার জন্য, সহনশীল, পরমতসহিষ্ণু, ধর্মনিরেপক্ষ ও উদার মানসিকতার জন্য সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রমের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
রায়হান আরা জামান
শিক্ষা-গবেষক ও শিক্ষক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়