সর্বত্র প্রতারণার জাল

প্রতীকী ছবি

অপরাধ

সর্বত্র প্রতারণার জাল

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ৩ অক্টোবর, ২০২০

চারদিকে ফাঁদ পেতেছে প্রতারণার চক্র। বিয়ের বিজ্ঞাপন, বিদেশি লটারি, কোম্পানিতে লোভনীয় বিনিয়োগ, জমি ক্রয়, চাকরি দেওয়ার পাশাপাশি সুন্দরী নারী দিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পেতে আছে এই চক্রটি।  এই চক্রের নানা প্রতারণার ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছে সাধারণ মানুষ। অপরদিকে প্রতারণার জালে ফেলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা।

সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী বেশ কয়েকজন এ ধরনের প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছে। এই প্রতারকরা বিভিন্নভাবে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বিশেষ করে নাসিম রিয়েল এস্টেটের মালিক প্লট দেওয়ার নামে হাতিয়ে নিয়েছেন ৩০০ কোটি টাকা। এয়ার কার্গোতে চাকরি দেওয়ার নামে লালু হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় শত কোটি টাকা। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে এক নারী বিশিষ্ট কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্রায় ১০/১৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও লটারি জেতানোর কথা বলে বাংলাদেশিসহ নাইজেরিয়ানদের এক প্রতারক চক্র প্রায় ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। সম্প্রতি তাদের গ্রেপ্তারের পর বিষয়টি ফাঁস হয়। এছাড়া আরো বড় বড় প্রতারকচক্র ঘাপটি মেরে আছে।  এসব প্রতারকদের ফাঁদে পড়ে একদিকে যেমন মানুষ সর্বস্ব হারাচ্ছে অপরদিকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি। 

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতারকদের কাজই হলো ঠকানো। কিন্তু আপনাকে সচেতন হতে হবে। সবকিছু জেনেশুনে আপনাকে এগুতে হবে। কোনো প্রকার সন্দেহ হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্মরণাপন্ন হতে হবে।

কর্মকর্তাদের বক্তব্য, কিছু সুবিধা নিতে যাওয়ার কারণে মূলত লোকজন প্রতারণার মধ্যে পড়ে যায়। এজন্য নিজেকে আরো সচেতন হতে হবে।  তবে এ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আরো কঠোর অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে বলেও তারা জানান।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্লট দেওয়ার নামে শত কোটি লুটে নেওয়া ভয়ংকর প্রতারক ইমাম হোসেন নাসিম ওরফে নাসিমকে গ্রেফতার করে র্যাব। স্বল্পমূল্যে প্লট দেওয়ার নাম করে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া নাসিম ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। অর্ধশতাধিক মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি হলেও নিজেকে সুড়ঙ্গের একরুমে আত্মগোপনে রেখেছিল এই মহাপ্রতারক।  অবশেষে র্যাব গত বুধবার অভিযান চালিয়ে রাজধানীর মিরপুর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় তার স্ত্রী হালিমা আক্তার সালমাকেও আটক করা হয়।

গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয় একটি ৭.৬৫ মি.মি. বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগজিন, তিন রাউন্ড গুলি, নগদ জাল এক লাখ ৩৫ হাজার টাকা, ১৪শ পিস ইয়াবা, দুই বোতল বিদেশি মদ, চারটি ওয়াকিটকি সেট, ছয়টি পাসপোর্ট, ৩৭টি ব্যাংক চেক এবং ৩২টি সিম কার্ড।

র্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল বলেন, ‘প্রতারক নাসিমের বাপ-দাদার বাড়ি ভোলায়। দেশ স্বাধীনের আগে তার বাবা বেলায়েত হোসেন গ্রাম্য ডাক্তার ছিলেন। তাকে নিয়ে তার বাবা রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় চলে আসেন। পরবর্তী সময়ে মিরপুর এলাকায় সে পড়ালেখা করে। সে নিজেকে গ্রাজুয়েট দাবি করে। ‌১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৮২ বা ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তিতাসের তৃতীয় শ্রেণির ঠিকাদার হিসেবে কাজ করে। এরপর ২০০২ সালে নাসিম রিয়েল এস্টেট নামে একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি গড়ে তোলে। সাভারের কাউন্দিয়া এলাকায় সাইনবোর্ড দিয়ে কিছু খাসজমি, দখল করা জমি এবং পানিভরা জমি দেখিয়ে স্বল্পমূল্যে জমি পাওয়া যাচ্ছে বলে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়।’

তিনি বলেন, প্লটপ্রতি পাঁচ লাখ টাকা করে নিয়েছে। এরকম প্রায় পাঁচ হাজার চুক্তির কথা আমরা জানতে পেরেছি। রেজিস্ট্রেশন করে দেওয়ার কথা বলে সাড়ে ১২ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা করে এক একজন ভুক্তভোগীর কাছ থেকে নিয়েছে। সব মিলিয়ে এভাবে ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার কথা জানতে পেরেছি।’

জানা যায়, চাকরি দেওয়ার নাম করে প্রতারণার ফাঁদ পেতে প্রায় ৩ কোটি আত্মসাৎ করে অবশেষে সিআইডির হাতে ধরা পড়ে প্রতারক আমিনুর ইসলাম লালু। বিমানবন্দরের এয়ার কার্গোসহ বিভিন্ন পদে চাকরি দেওয়ার নাম করে ভয়ংকর প্রতারণার ফাঁদ পেতে বসেন এই লালু। বিশেষ করে ভুয়া আউটসোর্সিং কোম্পানি খুলে লোকজনের নিকট থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেন।

পত্রিকায় ‘পাত্র চাই’ বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পেতে প্রায় ৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সাদিয়া নামের এক নারী ও তার সহযোগীরা। তবে অবশেষে পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা সিআইডির জালে ধরা পড়েছে এই নারী। সেই সাথে স্বীকারও করেছেন তার এই প্রতারণার ফাঁদের বিষয়টি।

সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রেজাউল হায়দার জানান, ‘কানাডার সিটিজেন ডিভোর্সি ও সন্তানহীন নারীর জন্য পাত্র চাই’-এজাতীয় দৈনিকে এমন বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণা করে ৩০ কোটিরও বেশি টাকা হাতিয়ে নেয় সাদিয়া জান্নাত ওরফে জান্নাতুল ফেরদৌস (৩৮)। শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি পাস হলেও প্রতারক জান্নাতের কথাবার্তা ও স্মার্টনেস দেখে কানাডা প্রবাসী ভেবেই সবাই ভুল করত। তার ফাঁদে পড়ে কোটি টাকা খোয়া গেছে অনেকের। গত ১১ বছর ধরে সাদিয়া জান্নাত ওরফে জান্নাতুল ফেরদৌস পত্রিকায় এমন বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে এসব টাকা হাতিয়ে নেয়।

এদিকে রাজধানীতে বসে আন্তর্জাতিক প্রতারণা চক্র গড়ে তুলেছেন অবৈধভাবে বসবাসরত বিদেশিরা। বিশেষ করে আফ্রিকা মহাদেশের নাইজেরিয়া, উগান্ডা, ঘানার অধিবাসীরা স্বল্পসময়ের ভিসা নিয়ে এদেশে এসে বছরের পর বছর অবৈধভাবে বসবাস করে গড়ে তুলছেন অপরাধচক্র।

বিশেষ করে এই চক্রেরা সদস্যরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে উচ্চবিত্তের লোকজনকে টার্গেট করে প্রতারণার ফাঁদ পাতে। আর এই পাতা ফাঁদের মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। সম্প্রতি র্যাব ও সিআইডির হাতে ধরা পড়েছে এ প্রতারকচক্রের কয়েকজন সদস্য। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য পেয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। এ প্রতারক চক্রের অন্য সদস্যদের গ্রেফতারে কাজ করছেন তারা।

গত এক বছরে বিভিন্ন অপরাধে শতাধিক বিদেশি নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছেন আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী। এছাড়া বর্তমানে ৫ শতাধিক বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশের বিভিন্ন কারাগারে রয়েছে। যাদের মধ্যে আফ্রিকানদের সংখ্যাই সাড়ে ৪শরও বেশি বলে একটি সূত্রে জানা গেছে।

অন্যদিকে সুন্দরী নারী দিয়ে তৈরি করা ফাঁদে ফেলা হয় লোকজনকে। সেই ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব হারাতে হয় ভুক্তভোগীদের। নারীরা নিজেদের বড় ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেয়। আবার কখনো ব্যবসায়ী-শিল্পপতির মেয়ে-ভাগ্নি দাবি করে। চলাফেরাও করে দামি গাড়িতে। পোশাকে, চলনে আভিজাত্যের ছাপও থাকে। তাদের টার্গেট বিত্তশালীরা।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা প্রথমে সখ্য গড়ে তোলে। মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করে উত্তেজক কথা বলে। বসে আনার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করে। লোভ দেখানো হয় একান্ত আপন করে পাবার। আয়োজন করা হয় ঘরোয়া পার্টির। আমন্ত্রণ জানানো হয় টার্গেট করা ব্যক্তিদের। সেখানে ইয়াবা, মদের আসর বসানো হয়। টার্গেট করা ব্যক্তিকে নেশার জালে ফেলে তারা তাদের প্রকৃত পরিচয় দেয়।

মূলত তারা প্রতারকচক্র। একজন নয় একাধিক নারী-পুরুষ এসব প্রতারকচক্রে কাজ করে। নেশায় মত্ত থাকা পুরুষদের বিবস্ত্র করে ছবি তোলে। এমনকি চক্রের নারী সদস্যরাও বিবস্ত্র হয়। বিছানায় নিয়ে আপত্তিকর অবস্থায় ভিডিও ধারণ করে। অনেক সময় গোপন ক্যামেরায় দৃশ্য ধারণ করা হয়। ধারণ করা এসব ভিডিও, ছবি দেখিয়ে পরে ভুক্তভোগীর সঙ্গে করা হয় নানা প্রতারণা। এসব দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে এরকম  অনেকেই গ্রেফতার হয়েছেন।

র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক আশিক বিল্লাহ বলেন, প্রতারকদের কাজই হলো ফাঁদ পাতা। তবে আমরা যদি সচেতন হই তাহলে এটা তারা করতে পারবেনা। কোনো কিছু খোয়ানোর আগে তারা যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্মরণাপন্ন হয় তাহলে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। তবে এ বিষয়ে আমাদের সচেতনতা জরুরি। 

সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রেজাউল হায়দার জানান, বিভিন্ন মানুষ প্রতারিত হয়। অনেক সময় সরল বিশ্বাসে তারা লেনদেনে যায়। পরে যখন তারা বুঝতে পারে তারা প্রতারণার শিকার হয়েছেন তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিকট আসে। কিন্তু জরুরি হলো সচেতনতা।

তিনি বলেন, আমরা এ ধরনের প্রতারকদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছি।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণপদ রায় বলেন,  ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কোনো ধরনের প্রতারণা বুঝতে পারলেই থানায় জানাতে হবে। সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে পুলিশ তৎপর রয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads