মো.সায়েদ আফ্রিদী
মৌলিক অধিকারের অন্যতম হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। দেশের দিনদিন উন্নতি হচ্ছে। সরকারি সেবার পাশাপাশি বেসরকারি সেবা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেসরকারি চিকিৎসা নিঃসন্দেহে অনেক বড় একটা সাপোর্ট আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগের জন্য। তবে প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য কিছু বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত। সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা অনুসরণ না করে যেখানে-সেখানে প্রাইভেট হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার প্রতিষ্ঠার পূর্বে এর লাইসেন্স নেওয়া অতীব জরুরি।
কেননা করোনাকালীন সময়ে আমরা লক্ষ করেছি বেশ কয়েকটি প্রাইভেট হাসপাতাল সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। করোনার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের টেস্ট নিয়ে চলেছে বাণিজ্য। যেটা শুধু আমাদের মৃত্যুঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে তা নয়, বরং দেশকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে, আর্থিক অপচয় হয়েছে এবং মানুষের ভোগান্তির স্বীকার হতে হয়েছে। আবার যেহেতু প্রবাসীদের বিদেশযাত্রায় এসব হাসপাতালে করোনার পরীক্ষা করানো হয়েছে, সেক্ষেত্রেও বিদেশের মাটিতে আমাদের মানসম্মান, যশ, খ্যাতি সব ধূলিসাৎ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল।
এসব তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আমাদের চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন তোলা খুবই স্বাভাবিক এবং যৌক্তিক। গত বছরে করোনার টেস্ট নিয়ে দুর্নীতির পর থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বেশ তোড়জোড় লক্ষ করা গেছে। প্রাইভেট হাসপাতাল এবং ক্লিনিকসমূহ নবায়ন ও লাইসেন্সের মাধ্যমে চালানোর কর্মপদ্ধতি বলে দেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালের ২৩ আগস্টের মধ্যে বেসরকারি হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়ন না করলে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হবে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সরকারের এমন কঠোর মনোভাবে হাসপাতাল নিবন্ধন ও লাইসেন্স নবায়ন পেতে আবেদনের হিড়িক পড়েছিল তখন। এক মাসেই আড়াই হাজারের মতো আবেদন পড়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। খুব সহজে অনুমেয় কীভাবে নামে-বেনামে তৈরি হয়েছে হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং কীভাবে অবৈধ উপায়ে দিনকে দিন প্রতিষ্ঠানগুলো চলেছিল? যেহেতু দীর্ঘদিন প্রতিষ্ঠানগুলোর নবায়ন এবং লাইসেন্স ছিল না, সেহেতু ওইসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যে-কোনো অমানবিক কাজ সংঘটিত হওয়া অস্বাভাবিক ছিল না। ঘটেছেও তাই। তার থেকেও বড় অপরাধ সরকারকে কোনো প্রকার ট্যাক্স দেওয়া থেকে বিরত ছিল এসব প্রতিষ্ঠান, যেটা আইনগতভাবে অপরাধ। তবে জনগণেরও প্রশ্ন, প্রশাসনের নাকের ডগায় এমন কার্যক্রম চলে কীভাবে?
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে মোট ১৭ হাজার ২৪৪টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৫ হাজার ৪৩৬টি, চট্টগ্রামে ৩ হাজার ৩৭৫, রাজশাহীতে ২ হাজার ৩৮০, খুলনায় ২ হাজার ১৫০, রংপুরে ১ হাজার ২৩৬, বরিশালে ৯৫৭, ময়মনসিংহে ৮৭০ ও সিলেটে ৮৩৯টি। তবে এসব চিকিৎসাসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানের দুই-তৃতীয়াংশ লাইসেন্সবিহীনভাবে পরিচালিত হয়েছে ২০২০ সালের ২৩ আগস্ট পর্যন্ত।
কথা হচ্ছে এখন কি লাইসেন্স হয়েছে? নিঃসন্দেহে এখনো হাজার হাজার অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠান চলছে। যাদের নেই কোনো নবায়ন, নেই কোনো লাইসেন্স। এই যে এভাবে অবাধে প্রতিষ্ঠানগুলো চলার প্রদান কারণ আমাদের সিস্টেমে গলদ। কোনো সমস্যা হলে নিয়মকানুন সবার চোখের সামনে আসে। পরবর্তীতে আবার আরাল হয়ে যায়। আর কোন কর্মপরিকল্পনা চোখে পড়ে না। প্রশাসনেরও তেমন কোনো তদারকি দেখা যায় না। এভাবেই সুযোগ পেয়ে দিনকে দিন আনাচে-কানাচে তৈরি হচ্ছে অগণিত প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক। বিভিন্ন যায়গায় এমন অবাধে ডায়াগনস্টিক সেন্টার তৈরি হওয়ায় মানুষও ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। ভুয়া ডাক্তারের ছড়াছড়ি, পরীক্ষার রিপোর্টে থাকে অনিয়ম ও ভুল। একেক জাায়গায় পরীক্ষা করলে একেক রিপোর্টসহ বিভিন্ন জটিলতায় ভুগতে হয় ভুক্তভোগী মানুষদের।
এসব প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর বহুল আলোচিত আয়ের উৎস অতিরিক্ত টেস্ট দেওয়া। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে টেস্ট দেওয়া নিয়ে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমেও খবর হয়েছে। টেস্টের টাকার ওপর ডাক্তারের কমিশন থাকে বলেও অভিযোগ আছে। জেলা পর্যায়ের অধিকাংশ প্রাইভেট হাসপাতালে পরীক্ষানিরীক্ষা করার মতো পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি থাকে না। কোনরকম যন্ত্রপাতি দিয়ে অপারেশন করা হয় বলেও অনেক অভিযোগ আছে। যথাযথ যন্ত্রপাতি না থাকায় অধিকাংশ অপারেশন সঠিকভাবে সম্পন্নও হয় না। ফলস্বরূপ অপারেশন পুনরায় করতে হয়।
প্রাইভেট হাসপাতালে যেহেতু বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ডাক্তার এসে খুব স্বল্প সময় থাকে, সেহেতু তারাও তাড়াহুড়ো করে চিকিৎসা করে। যেমন টিউমার অপারেশন করতে হলে সর্বপ্রথম বায়াপসি করে দেখতে হয়, এটা কোন অবস্থায় আছে। কেননা টিউমার থেকে ক্যানসার ছড়ানোর একটা সুযোগ থাকে। কিন্তু বায়াপসি রিপোর্ট পেতে দেরি হয় বিধায় অনেক প্রতিষ্ঠানের ডাক্তার বায়োপসির ঝামেলায় না গিয়ে অপারেশন করে ফেলে। পরবর্তীতে রিপোর্ট আসে এখানে ক্যান্সার সেল থেকে গেছে। ততক্ষণে রোগীর কৃত্রিম ঝামেলায় পড়তে হয়। কিন্তু সময়ের অভাবে ডাক্তার এবং কর্তৃপক্ষ এসব করতে ন্যূনতমভাবে না। তাদের চিন্তাভাবনা রোগীর চিকিৎসা যেমনই হোক, তাদের বেতন থাকলেই হলো। এছাড়া ঢাকার অধিকাংশ ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো মধবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তদের জন্য দুঃসাধ্য। কেননা এখানে এক রাতের সিট ভাড়াই হাজার হাজার টাকা। পরীক্ষা-নিরীক্ষা মিলে লাখ লাখ টাকার প্রয়োজন।
সুতরাং এসব বিষয়ে সরকারিভাবে বেশ কিছু বিধিবদ্ধ নিয়মকানুন থাকা জরুরি। হাসপাতালের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনা করে প্রতিটা বিষয়ের সরকারিভাবে একটা বিধিবদ্ধ নিয়মকানুন থাকা আবশ্যক। না হয় কর্তৃপক্ষ তাদের মতো করে বিল বেতন নিয়ে নেয় বা নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। সাথে রয়েছে টেস্ট। কোন পরীক্ষার মূল্য কত হবে, তা সরকারিভাবে নির্ধারণ করে দেওয়ার সময় এসেছে এবং উচিতও বটে। কেননা বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো এমনও রেকর্ড আছে সামান্য প্লাস্টার করতে বা খুলতে ২০-৩০ হাজার টাকার রিসিট ঝুলিয়ে দেয়। যেটা স্বাস্থ্যখাতের জন্য হতাশাজনক। নিঃসন্দেহে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান তথা হাসপাতাল আমাদের দরকার। তবে নিয়ন্ত্রণে রাখা আরো বেশি জরুরি।
এভাবে রেজিস্ট্রেশন না থাকলে কর্তৃপক্ষ যে-কোনো ডাক্তার এনে চিকিৎসা করাতে পারবে। সাধারণ মানুষের ডাক্তারের ব্যাকগ্রাউন্ড জেনে চিকিৎসা করার সুযোগ থাকে না। যেখানে হরহামেশা সংবাদ হচ্ছে ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু। সর্বোপরি প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিকের মাধ্যমে এদেশের মানুষ তাদের মৌলিক অধিকারের পূর্ণতা পাবে, সেই কামনা করছি।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ