মতামত

সময় থাকতে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার

  • শাহ আহমদ রেজা
  • প্রকাশিত ১৭ অক্টোবর, ২০১৮

রাজনীতি ও ইতিহাস রেখে হঠাৎ অর্থনীতি নিয়ে লিখতে গেলে পাঠকরা অবাক হতে পারেন। শুধু তা-ই নয়, শুরুটাও করা হবে এক ব্যাঙের গল্প দিয়ে। গল্পটি এ রকম : একটি ব্যাঙকে পানিভর্তি হাঁড়িতে রেখে জ্বলন্ত চুলায় বসানো হয়েছে। আগুনের তাপ অনুভব করলেও ব্যাঙটি প্রথম সুযোগেই লাফ দেয়নি। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও হাঁড়ি থেকে বেরিয়ে আসেনি। তেমন চেষ্টাই করেনি। ওদিকে তাপ ক্রমাগত বেড়েছে। ব্যাঙ লাফিয়ে বাইরে আসার চেষ্টা করার পরিবর্তে বেড়ে চলা তাপ সহ্য করেছে। নিজের সহ্য ক্ষমতা বাড়িয়েছে। এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর পানি এত বেশি উত্তপ্ত হয়ে পড়ল যে, ব্যাঙের পক্ষে আর সহ্য করা সম্ভব হলো না। ব্যাঙ এবার লাফ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু পারল না। ফলে জীবন্ত একটি ব্যাঙ ‘সিদ্ধ’ হয়ে গেল! তার মৃত্যুও ঘটল।

গল্পের সারমর্ম বোঝাতে গিয়ে বলা হয়েছে, কোনো নির্দিষ্ট মাত্রা বা পরিমাণ পর্যন্ত তাপ সহ্য করার ক্ষমতা ছিল ওই ব্যাঙটির। কিন্তু ব্যাঙ ভেবেছিল, সে হয়তো আরো বেশি তাপ সহ্য করতে পারবে। এই ভুল ধারণার শিকার হয়ে লাফিয়ে বাইরে আসার মতো শক্তি থাকতে থাকতে লাফ দেওয়ার পরিবর্তে সে শুধু ক্রমাগত বেড়ে চলা তাপই সহ্য করতে গেছে। ওদিকে আরো বেশি তাপ সহ্য করতে গিয়ে নিজের সব শক্তি খুইয়ে ফেলেছিল ব্যাঙটি। সে কারণে যখন সে লাফ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তখন আর তার কোনো শক্তিই অবশিষ্ট থাকেনি। মারা তো গেছেই, মরেছেও একেবারে ‘সিদ্ধ’ হয়ে!

ব্যাঙের গল্পটি যিনি শুনিয়েছেন তিনি এ থেকে শিক্ষা নেওয়ার জন্য পরামর্শও দিয়েছেন। এই পরামর্শ বাংলাদেশের বর্তমান সরকার এবং জনগণের উদ্দেশে। হঠাৎ শুনলে বেসুরো, এমনকি অপ্রাসঙ্গিকও মনে হতে পারে। কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই জানা যাবে, ব্যাঙ সম্পর্কিত গল্পের আড়ালে সরকারকে তো বটেই, এককালে ‘সংগ্রামী’ হিসেবে পরিচিত এদেশের জনগণকেও সময় ও শক্তি থাকতেই ঘুরে দাঁড়াতে বলা হয়েছে। কথাটা যে একেবারে অযৌক্তিক নয় সে বিষয়ে ধারণা পাওয়ার জন্য বর্তমান বাংলাদেশের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যেতে পারে। অসংখ্য তথ্য, উদাহরণ ও ঘটনার কথা বলা যেতে পারে। প্রথমে অর্থনীতির কতিপয় দিক প্রসঙ্গে সেরে নেওয়া যাক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে একাধিক জাতীয় দৈনিকে সম্প্রতি প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছে, দেশে কোটিপতিদের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এই সংখ্যা বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। কারণ, মাত্র এক বছরের ব্যবধানে কোটিপতিদের সংখ্যা বেড়েছে ৪ হাজার ৫১২ জন। বর্তমানে তাদের সংখ্যা ৭০ হাজার ৪৬৩। এসব কোটিপতির সবাই আবার বিভিন্ন ব্যাংকের আমানতকারী।

চলতি বছর ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত তথ্য-পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ব্যাংকে এক কোটি টাকা আমানত রয়েছে ৫৪ হাজার ৯৭০ জনের। ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত এই সংখ্যা ছিল ৫২ হাজার ৮৭। যার অর্থ, মাত্র এক বছরের মধ্যে এক কোটি টাকার বেশি আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে ২ হাজার ৮৮৩ জন। একই সময়ে ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানতকারীর সংখ্যা ৭৮৪ থেকে বেড়ে হয়েছে ৯৪১ জন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে আরো দেখা গেছে, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের কোটিপতি আমানতকারী ছিলেন ৬২ হাজার ৩৮ জন। কিন্তু গত দেড় বছরে তাদের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৭০ হাজার ৪৬৩ জন। এই সময়ে ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৯২ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে কোটিপতিরাই জমা রেখেছেন ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি। অর্থাৎ বিভিন্ন ব্যাংকে যে পরিমাণ আমানত রয়েছে তার প্রায় অর্ধেকই ৭০ হাজার ৪৬৩ কোটিপতির!

এভাবে কোটিপতিদের সংখ্যা লাফিয়ে বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও সাবেক ব্যাংকারসহ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, স্বাভাবিক অবস্থায় এমনটি হওয়া সম্ভব নয়। অনুসন্ধানে বরং দেখা যাবে, নব্য কোটিপতি যারা হয়েছেন তাদের প্রায় সবাই দুর্নীতি এবং অসৎ পন্থার আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ঋণখেলাপিদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। কোটিপতিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঋণখেলাপিদের সংখ্যাও বেড়েছে। কিছুদিন আগে গত ১২ সেপ্টেম্বর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন, চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত ঋণখেলাপিদের কাছে আটকা পড়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা।

বলার অপেক্ষা রাখে না, কোটিপতিদের সংখ্যা ও তাদের দখলে থাকা অর্থের পরিমাণের পাশাপাশি খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার তথ্য-পরিসংখ্যানগুলো অত্যন্ত ভীতিকর। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে আসলে দেশের অর্থনীতির নেতিবাচকতাই সামনে এসেছে। শিল্প-কারখানা স্থাপনসহ জাতীয় পুঁজির বিকাশ যেখানে সমৃদ্ধির প্রধান পূর্বশর্ত, সেখানে একদিকে বিপুল পরিমাণ অর্থ কোটিপতিদের অ্যাকাউন্টে অলস পড়ে আছে, অন্যদিকে বেড়ে চলেছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ।

এটা জাতীয় অর্থনীতির মন্দ ও আশঙ্কাজনক একটি দিক। দ্বিতীয় প্রধান প্রসঙ্গ হিসেবে সম্প্রতি আলোচিত হচ্ছে টাকা পাচার। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের রিপোর্টে জানা গেছে, দেশের ভেতরে বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির অবস্থায় থাকলেও একদিকে ব্যাংকঋণ যেমন বাড়ছে তেমনি বেড়ে চলেছে আমদানি ব্যয়ও। বিষয়টিকে অস্বাভাবিক শুধু নয়, রহস্যজনক হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন অর্থনীতিবিদসহ তথ্যাভিজ্ঞরা। তারা মনে করেন, অন্তরালের কারণ আসলে টাকা পাচার। নির্বাচনের বছর বলে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। পাচারও হচ্ছে বিভিন্ন পন্থায়। এসবের মধ্যে বড় একটি পন্থা হলো আমদানি ব্যয় মেটানোর অজুহাত। শিল্প কারখানায় উৎপাদন ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের উপলক্ষ বা কারণ দেখিয়ে যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী আমদানির জন্য যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নেওয়া হচ্ছে বাস্তবে দেশে আনা হচ্ছে তার চেয়ে অনেক কম মূল্যের পণ্যসামগ্রী। অনেক ক্ষেত্রে আবার আমদানির জন্য ঋণপত্র বা এলসি খুললেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোনো পণ্যই আমদানি করা হচ্ছে না। এলসির সমুদয় অর্থই তারা পাচার করে দিচ্ছেন। এরই পাশাপাশি আমদানির জন্য বেশি মূল্য দেখানো বা ওভার ইনভয়েসিং করা এবং রফতানির ক্ষেত্রে প্রকৃত আয়ের চাইতে কম আয় দেখানো বা আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমেও পাচার হয়ে যাচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ।

রেমিট্যান্স আয়ের ক্ষেত্রেও চলছে বিশেষ কিছু চক্রের দৌরাত্ম্য। এসব চক্রের লোকজন প্রবাসীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় রেমিট্যান্সের অর্থ সংগ্রহ করে সে অর্থ বিদেশেই রেখে দিচ্ছে। অন্যদিকে দেশে তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে প্রবাসীদের স্বজনরা ওই পরিমাণ অর্থ পেয়ে যাচ্ছে। স্বজনরা প্রত্যাশিত পরিমাণ অর্থ পাচ্ছে বলে পাচারের বিষয়টি সরকারি সংস্থাগুলোর পক্ষে জানা সম্ভব হচ্ছে না। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, প্রবাসীরা যে পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠান তার প্রায় ৪০ শতাংশ অর্থই দেশে আসতে পারে না। ফলে দেশ বঞ্চিত হয় বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন থেকে।

অন্য কিছু বিচিত্র পন্থায়ও বিপুল অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সব জানা সত্ত্বেও কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এর ফলেও পাচারকারী চক্রগুলো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। অন্যদিকে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের সঙ্গে আমদানি ব্যয়ের ব্যবধান বেড়ে চলেছে অবিশ্বাস্য পরিমাণে। একটি রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের আমদানি ব্যয় ছিল ৫৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর বিপরীতে রফতানি আয় হয়েছিল ৩৬ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার। এর সঙ্গে রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে আসা ১৪ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার যোগ করার পরও আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ব্যবধান ছিল ২ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলারের। এই পরিসংখ্যানে প্রমাণিত হয়েছে, যে হারে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে তার চাইতে অনেক বেশি পরিমাণে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারসহ তথ্যাভিজ্ঞরা জানিয়েছেন, গত ১০ বছরেও নাকি এ ধরনের পাচারের ঘটনা কখনো ঘটেনি।

এমন অবস্থার কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নির্বাচনের বছর বলেই বিশেষ করে কালো টাকার মালিক ও ঋণখেলাপিদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। ক্ষমতার সম্ভাব্য পরিবর্তনের বিষয়ে তারা অনিশ্চয়তায় রয়েছেন আর সে কারণে দেশের ভেতরে টাকা রাখা নিরাপদ মনে করতে পারছেন না। একই কারণে একদিকে তারা নতুন বিনিয়োগ থেকে হাত গুটিয়ে রেখেছেন, অন্যদিকে অর্থ পাচার করছেন বিপুল পরিমাণে। সে জন্যই রফতানি আয় ও আমদানি ব্যয়ের মধ্যে ব্যবধান বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। বাড়ছে দেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণও। এদিকে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার ফলে পণ্যের মূল্যও বাড়ছে।

নির্বাচনের বছর ধরনের যত যুক্তিই দেখানো হোক না কেন, বিশেষজ্ঞরা কিন্তু বিষয়টিকে গ্রহণযোগ্য মনে করেন না। কারণ, গত বছরই ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) তার এক রিপোর্টে জানিয়েছিল, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর পাচার হয়ে যাচ্ছে গড়ে ৪৪ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা এবং ‘নির্বাচনের বছর’ ২০১৪ সালে পাচার হয়েছিল ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। এত বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার ফলে দেশের ভেতরে কোনো বিনিয়োগ হয়নি এবং শিল্প-বাণিজ্যসহ অর্থনীতির প্রতিটি খাতে সঙ্কট ক্রমাগত আরো ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।

সমগ্র এ প্রেক্ষাপটে অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনার পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের কবল থেকে রক্ষা করতে হলে সরকারকে ব্যাঙের ওই গল্প থেকে শিক্ষা নিয়ে দ্রুত উদ্যোগী হয়ে উঠতে হবে। এজন্য এমন আয়োজন নিশ্চিত করা দরকার, যাতে শিল্প স্থাপন বা ব্যবসা-বাণিজ্যের নামে অসৎ লোকজন ব্যাংকঋণ না পেতে পারে এবং যাতে প্রকৃত শিল্প মালিক ও ব্যবসায়ীরা ঋণের অভাবে বাধাগ্রস্ত না হন। তেমন অবস্থায় খেলাপি ঋণের পরিমাণও কমে আসবে। কোটিপতিদের ব্যাপারেও এ কথা বুুঝতে হবে যে, দুর্নীতি ও অবৈধ কারবার ছাড়া কোনো গোষ্ঠীর পক্ষেই এত বিপুল পরিমাণ অর্থ আমানত রাখা বা মজুত করা সম্ভব নয়। সম্ভব আসলে হয়ওনি। এজন্যই শিল্প কারখানা স্থাপনসহ জাতীয় অর্থনীতির সমৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ করতে নব্য কোটিপতিদের বাধ্য করা দরকার। একই সঙ্গে অর্থ পাচারও প্রতিহত করতে হবে। তেমন অবস্থায় একদিকে দেশে নতুন নতুন শিল্প কারখানা স্থাপিত হবে, অন্যদিকে বহু মানুষের জন্য চাকরির সুযোগও সৃষ্টি হবে। এমন আয়োজন নিশ্চিত করা দরকার, যাতে লক্ষ হাজার কোটি টাকা মুষ্টিমেয় মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অলস না পড়ে থাকে এবং স্থবিরতা কাটিয়ে জাতীয় অর্থনীতি যাতে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারে। 

 

লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads