সময়মতো মিলছে না সঞ্চয়পত্রের মুনাফা

ফাইল ছবি

ব্যাংক

সময়মতো মিলছে না সঞ্চয়পত্রের মুনাফা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৬ মার্চ, ২০২১

সংসারে ব্যয়ের জোগান দিতে দুই লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনেন গৃহিণী সালমা বেগম। প্রতি তিন মাস অন্তর মুনাফা পান তিনি। নিয়ম অনুযায়ী মুনাফার টাকা ফেব্রুয়ারি মাসে তার ব্যাংক হিসাবে জমা হওয়ার কথা। কিন্তু মার্চের ৯ তারিখেও আসেনি সেই টাকা। খোঁজ নিতে আসেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল শাখায়।

তিনি বলেন, সঞ্চয়পত্রের মুনাফা নিয়মিত আমার অ্যাকাউন্টে চলে আসে। হঠাৎ গত মাসে নির্ধারিত সময়ে টাকা আসেনি। প্রথমে ব্যাংকে যোগাযোগ করলাম। তারা বলল, গত মাসে টাকা আসেনি। যেখান থেকে কিনেছেন সেখানে খোঁজ নেন। এখানে এসে জিজ্ঞাসা করলাম। তারা বলল, এ মাসে চলে যাবে। কেন যায়নি, কী সমস্যা, কিছুই বলল না তারা। কী করব কিছুই বুঝতেছি না।

জেনিফার নামের আরেক গ্রাহকও একই সমস্যায় পড়েছেন। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি মুনাফা পাওয়ার কথা থাকলেও তিন সপ্তাহ পরও টাকা আসেনি।

ব্যাংকে সরাসরি এসে নয়, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও সঞ্চয়পত্রের মুনাফা না পাওয়াসহ বিভিন্ন ভোগান্তির কথা জানিয়েছেন অনেক বিনিয়োগকারী। এমনই একজন অনুপ কুমার দাস। ফেসবুকে তিনি লেখেন, সোনালী ব্যাংকে এক লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনেছি। প্রতি মাসের ৫ তারিখ টাকা আসে, মেসেজও পাই। অথচ আজ ৭ তারিখ হয়ে গেলেও কোনো মেসেজ আসেনি। টাকাও যোগ হয়নি।

জানতে চাইলে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) শামসুন্নাহার বেগম জানান, অনেকেই মুনাফা পাননি। বিষয়টি আমরা জানি। যে অফিস সঞ্চয়পত্রের অটোমেশনের কাজ করেছে সেই অফিস স্থানান্তর করে অন্য জায়গায় নেওয়া হয়েছে। ফলে এখন পর্যন্ত অনেক কিছু পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি। সফটওয়্যারের কাজ চলছে। সপ্তাহখানেকের মধ্যে কাজ সম্পূর্ণ হবে। চিন্তার কোনো কারণ নেই, সব ঠিক হয়ে যাবে। যারা মুনাফার টাকা পাননি তারা চলতি মাসেই পেয়ে যাবেন।

শুধু মুনাফা পাওয়ার সমস্যা নয়, বিভিন্ন ভোগান্তিতেও পড়ছেন অনেক গ্রাহক। এমনই আরেকজন হীরা লতা সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ভবনের নিচতলায় সঞ্চয়পত্র কেনার স্লিপ নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি জানান, ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখে তিন লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনেছিলাম। চলতি মাসে অ্যাকাউন্টে মুনাফার টাকা আসবে। কিন্তু আসেনি। ব্যাংকে এসে খোঁজ নিলাম। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানালেন, আমার নাকি সঞ্চয়পত্রই কেনা হয়নি। যে চেক দিয়েছি সেখানে নাকি একটু সমস্যা আছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তাহলে কেনার স্লিপ দিলেন কেন। তারা তখন আমার স্লিপ ছিঁড়ে ফেলল। বলল, চেক ঠিক করে আনেন। চেক নিয়ে জনতা ব্যাংকে গেলাম। তারা জানাল, এটা তেমন সমস্যা নয়, বললেই হতো। এখন আজ পুনরায় সব জমা দিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনলাম, বিকেল ৪টার পর স্লিপ দেবে।

এ বিষয়ে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তার কাছে জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি। পরে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, বাজারে ব্যাংকের সুদহার ৩ থেকে ৪ শতাংশ। সেখানে সঞ্চয়পত্রে ১১ শতাংশের ওপরে। ব্যাংকের চেয়ে সঞ্চয়পত্রে তিন থেকে চারগুণ বেশি মুনাফা মিলছে। মানুষ এখন হুমড়ি খেয়ে সঞ্চয়পত্র কিনছে। বিক্রিও তিন-চারগুণ বেড়েছে। সেবাগ্রহীতার সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু জনবল বাড়েনি। তাই কর্মীরা সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। চারজনের কাজ তো একা করা সম্ভব নয়। কর্মী না বাড়ালে গ্রাহক কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হবেন, এটাই বাস্তবতা। বিষয়টা বুঝেও যদি বড় কর্তারা না বোঝার ভান করেন তাহলে কী আর করা!

ক্ষোভ প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ কর্মকর্তা আরো বলেন, সঞ্চয়পত্রের অটোমেশন প্রক্রিয়াও বেশ জটিল। এর আগে অটোমেশনের দায়িত্ব যে থার্ড পার্টিকে দেওয়া হয়েছিল তারা কাজ শেষ না করে চলে গেছে। এজন্য গত বছর চারদিন সঞ্চয়পত্র বিক্রি বন্ধ রাখতে হয়েছিল। পরে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের আইটির লোকজন দিয়ে তা সচল করেছিলাম। গত মাসেও সার্ভার ডাউন, সফটওয়্যার জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণে নির্বিঘ্নে কাজ করা সম্ভব হয়নি। যে কারণে অনেক গ্রাহকের মুনাফা না পাওয়াসহ বিভিন্ন সমস্যা হয়েছে। দিনদিন সঞ্চয়পত্রের গ্রাহক বাড়ছে। তাই গ্রাহকের সেবা নিশ্চিত করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া এবং তা বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন তিনি। এদিকে ব্যাংকে আমানতের সুদহার কম হওয়ায় সাধারণ মানুষ এখন সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে বেশি ‘নিরাপদ’ মনে করছেন। তাই বিভিন্ন শর্ত পরিপালন করেও সঞ্চয়পত্রে ঝুঁকছেন বিনিয়োগকারীরা। চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে যে পরিমাণ ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছিল, ছয় মাসেই তার চেয়ে বেশি ঋণ নেওয়া হয়েছে। এখন লক্ষ্যের চেয়ে অতিরিক্ত সঞ্চয়পত্র বিক্রি করছে সরকার্ত বলছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্য বলছে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) সাড়ে ৬৫ হাজার কোটি টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই এত বেশি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়নি। সুদ-আসল বাবদ গ্রাহকদের শোধ করা হয়েছে ৩৯ হাজার ৯১৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এ হিসাবে নিট বিক্রির পরিমাণ ২৫ হাজার ৭০২ কোটি ১৭ লাখ টাকা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads