জাপানের গল্প দিয়ে শুরু করি। জাপান পৃথিবীর দ্রুত শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত। জাপানের সাথে বাংলাদেশের তুলনা করলে দেখা যাবে গত ষাট বছর আগে জাপানও অতি দরিদ্র অর্থনৈতিক অবস্থানে ছিল। জাপানে রাস্তাঘাটে ভিখারি ছিল। মানুষ গাছের নিচে বসে চুল, দাড়ি কাটাত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর জাপান দারিদ্র্যসীমার নিচে স্থান পায়। সেই দারিদ্র্য অবস্থা থেকে প্রত্যয়ী জাপানিরা পৃথিবীর অতি উন্নত অর্থনৈতিক সীমারেখায় পৌঁছেছে। জাপানিরা পৃথিবীর অনেক মানুষের কাছ থেকে ‘অতি পরিশ্রমী’ হিসেবে বিদ্রুপও শুনেছে। কিন্তু দরিদ্র অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য নিজেদের সর্বশক্তি দিয়ে পরিশ্রম করে গেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত জাপানের ১০০ মিলিয়ন মানুষ ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়। একদিকে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা অপরদিকে ধ্বংসস্তূপের অর্থনীতি পুনর্গঠন এবং আধুনিকীকরণ ছিলো জাপানিদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এই বিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে কে পারতো মাত্র চার দশকে বিধ্বস্ত জাতিটি একটি আধুনিক সমৃদ্ধ জাপান গড়ে তুলবে! চার দশক পর জাপানের উত্থান নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মূল্যায়ন হলো— ‘প্রতিকূলতাই জাপানিদের জন্য আশীর্বাদ। সে প্রতিকূলতাগুলো কী কী- ১. একটি নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধ এলাকায় বিপুল জনগণের বসবাস ছিলো জাপানিদের জন্য প্রথম আশীর্বাদ। বাঁচার তাগিদে প্রচণ্ড রকমের কর্মপ্রেরণা এবং প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিলো তাদের মধ্যে। ২. কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকাটা ছিলো জাপানিদের জন্য দ্বিতীয় আশীর্বাদ। ফলে জাপানিরা সারা পৃথিবীর অঢেল সম্পদ আহরণে সচেষ্ট হয়েছিলো। ৩. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সব শিল্পকারখানা ধ্বংস হয়ে যাওয়াটা ছিলো জাপানিদের জন্য তৃতীয় আশীর্বাদ। পরে নতুন এবং অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে তারা শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।
বাংলাদেশি মানুষ বড়ই কাজের
আমরা কী ভাবছি? বাংলাদেশে জনসংখ্যার অধিক্য যেমন আছে, তেমনি আছে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যও। বাংলাদেশ এখন এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম জিডিপি অর্জনকারী দেশ। আমাদের উচিত কথা কম বলে কাজ বেশি করা। বিদ্যমান সমস্যা মোকাবিলা করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। সম্পদের সম্ভাবনায় সমৃদ্ধি সম্ভব। এই দেশজ চেতনায় সবাইকে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। এদেশে কিচ্ছু হবে না, আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না, সরকার এই করে দেয় না, সেই করে দেয় না-এসব হীন মানসিকতা আগে বদলাতে হবে। বদলাতে হলে চাই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। আমিও পারব। আমার যা আছে তা নিয়েই এগোব। সরকারের পক্ষে সবকিছু করে দেয়া সম্ভব নয়। নিজেদেরও কিছু করার আছে। একা সম্ভব না হলে সমবেত প্রচেষ্টায় সম্ভব হবে। চেষ্টা তো করতে হবে। উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে।
খুলনার একটি গ্রামের কথা জানি। গ্রামের নামই হয়েছে পাপর গ্রাম। পাপর তৈরি করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে দক্ষিণডিহি গ্রামের হাজার খানেক নারী-পুরুষ। দক্ষিণডিহি গ্রামের হরিতলা, তমালতলা ও তবতিপুর এলাকায় প্রতিটি পরিবারেই তৈরি হচ্ছে পাপর। এক সময় শখের বশে কোনো কোনো বাড়িতে পাপর তৈরি হতো। ক্রমান্বয়ে তা সম্প্রসারিত হয়েছে গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারে। এখন পাপর তৈরি হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে। পাপর অত্যন্ত মুখরোচক খাবার হওয়ায় উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে তা বিক্রিও হয়ে যায়। ডালের মিহি গুঁড়োর সঙ্গে চালের গুঁড়ো মিশিয়ে তৈরি করা হয় পাপর। পাপর তৈরির টাকা দিয়ে সংসার চলে অনেক পরিবারের। মহিলাদের উপযোগী কাজ হওয়ার ফলে পরিবারে অতিরিক্ত বা বিকল্প আয়ের সুযোগ ঘটালো পাপর পেশায়। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি শুধুই পুরুষ নন, মহিলারাও তাদের সমান সহযোগী। দ্বিবিধ সহযোগ এক হয়ে দ্রুত উন্নয়ন ঘটাতে পারছে সংসারের। ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করছে। সংসার চলছে ভালো। সামান্য সঞ্চয়ও করতে পারছেন তারা। এই দরিদ্র দেশে যেখানে লাখ লাখ লোক বেকার। কর্মসংস্থানের অভাব প্রকট। সেখানে স্বকর্মসংস্থান বা স্বউদ্যোগের এই দৃষ্টান্তগুলো নিঃসন্দেহেই আমাদের মনে আশা জাগায়। শুধু চাকরির পেছনে ছুটে শক্তি ক্ষয়, আর্থিক ক্ষতি আর সময় নস্ট করার বদলে অনেক শিক্ষিত তরুণ-তরুণীও যে স্বপ্রণোদিত হয়ে ছোটখাটো কাজ-কর্ম শুরু করেছে তাও একটা শুভ লক্ষণ। এদের কারোরই বড়ো কোনো পুঁজি নেই। অর্থবল বা আনুষঙ্গিক সাপোর্টও তেমন নেই। তবু নিতান্ত নিজেদের বিদ্যা, বুদ্ধি, সততা ও সাহসের ওপর ভর করে এরা নিজেরাই নিজেদের কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিচ্ছে। এই দারিদ্র্য ও বেকারের দেশে এরচেয়ে ভালো কাজ আর কী হয়। কাজেই, মানুষ বসে নেই। যে যার মতো করে তার অবস্থা উন্নয়নের চেষ্টা করছে। কতো রকমের কাজকর্ম হচ্ছে। কতো রকমের প্রয়াস আর উদ্যোগ। কারণ বাংলাদেশি মানুষ বড়ই কাজের। কাজের সুযোগ পেলেই হলো। উপার্জনের পথ পেলেই হলো। নির্দ্বিধায় কাজ করে আমাদের দেশের মানুষ। সরকারের প্রেরণা পেলে, সহায়তা পেলে, বেসরকারি উদ্যোক্তাদের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে উন্নয়ন রেনেসাঁর সৃষ্টি হবে এই বাংলাদেশে।
এবার শুনুন চায়নার উন্নয়নের কথা। চীন যে একটি অমিত সম্ভাবনার দেশ তা অনুধাবন করা গিয়েছিলো সত্তরের দশকে। তখন থেকেই চায়নারা রাষ্ট্রের কৃষি, শিল্প, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এবং প্রতিরক্ষা এই চারটি বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে। এটাই চায়না শিল্প বিপ্লবের অন্যতম ভিত্তি। বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর পাঁচ ভাগের একভাগ জনসংখ্যা বাস করে চীনে। আশির দশক থেকে চীনে ছোট ছোট ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেয়া হয়। ফলে বাজার অর্থনীতির দ্রুত প্রসার ঘটে। চীন তার বাজার উন্মুক্ত করে দেয় বিদেশি পুঁজি ও টেকনোলজির জন্য। বিদেশি বিনিয়োগের জন্য বিশেষ কিছু শিল্প এলাকা তৈরি করে। এর ফলে লাখ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, যা চীনকে একটি কৃষিনির্ভর রাষ্ট্র থেকে শিল্পনির্ভর রাষ্ট্রে পরিণত করে। সমাজ ও অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় ৩টি বিষয়কে প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে চায়না নেতৃত্ব- ১. দুর্নীতি, ২. শহর ও গ্রামাঞ্চলের মানুষের সম্পদের ব্যবধান, এবং ৩. পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা। কম দাম, গ্রহণযোগ্য মান, প্যাকিং ও পণ্যের বৈচিত্র্যে চীন এখন একচেটিয়া ব্যবসায়িক প্রাধান্য বিস্তার করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে চীন বিশ্বের ৩০ শতাংশ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করবে। বিশ্বের পণ্যবাজারে চীনের বিস্তৃতি এখন ‘ফুটওয়্যার থেকে আন্ডারওয়্যার এবং হার্ডওয়্যার থেকে সফটওয়্যার পর্যন্ত’। তাই বিপুল বেগে বিকাশমান অর্থনীতির বিশালতায় চীনকে প্রায়ই দৈত্যের সাথে তুলনা করা হয়।
আমরা জানি, দারিদ্র্য দূর করার উপায় হলো ভালো জিনিস সস্তায় উৎপাদন করে বিক্রি করা। চায়নারা সেটা করে দেখাতে পেরেছে। অথচ আমরা কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরাকে শিল্প এলাকা হিসেবে গড়ে তুলতে পারছি না। জিঞ্জিরা দুই নম্বর বা নকল জিনিস তৈরির এলাকা হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। প্রশ্ন হলো, যারা নিজেদের চেষ্টায় নকল পণ্য তৈরি করতে পারছে তাদেরকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে কেন উন্নতমানের দেশীয় পণ্য তৈরির কাজে লাগানো যাচ্ছে না? ধোলাইখালের অশিক্ষিত শ্রমিকরা যদি মেশিনারিজ পার্টস তৈরি করতে পারে তাহলে তাদেরকে কেন প্রশিক্ষিত করে ধোলাইখালকে শিল্প এলাকায় পরিণত করা যাচ্ছে না? সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এ সবকিছুই সম্ভব। সরকার প্রণোদনা দিলে বেসরকারি উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসবেন এই শিল্পে। দেশের অনেক ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শিল্প পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ধ্বংস হতে যাচ্ছে। এসব শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ নেওয়া দরকার। তা না হলে কাজ জানা মানুষগুলোও বেকার হবে। এসব শিল্পে বংশানুক্রমে কর্মসংস্থানের ধারাবাহিকতা থাকে। সরকার না পারলে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা যেতে পারে। এভাবে ছোট ছোট শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখলে মানুষ করে খেতে পারবে। ঢাকার বাইরে বিশেষত জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শিল্প স্থাপন করলেই বিশেষ সুবিধা দেওয়া হবে—এমন আহ্বান ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করবে। ঢাকার বাইরে শিল্প গড়ে উঠলে মানুষের শহরমুখী চাপ কমবে।
সিঙ্গাপুরের কথা চিন্তা করলে দেখা যাবে অন্যরকম চিত্র। মাত্র ৫০ বছর আগেও সিঙ্গাপুর ছিলো একটি হতদরিদ্র দেশ। তখন সিঙ্গাপুরকে ‘কলোনি অব কুলিজ’ বলে উপহাস করা হতো। কালপরিক্রমায় সেই দেশটির মাথাপিছু আয় এখন প্রায় ৩০ হাজার মার্কিন ডলারের বেশি। ছোট্ট সিঙ্গাপুরে রয়েছে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বসবাস। কিন্তু গত পঞ্চাশ বছরে সিঙ্গাপুরে জাতিগত বা ধর্মীয় কোনো দাঙ্গা হয়নি। সামান্যতম উসকানিও সেখানে কঠোরভাবে দমন করা হয়। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য গুদামঘর হিসেবে পরিচিত ছোট্ট সীমানার সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ নিজের লেখা বইতে বলেছেন- মালয়েশিয়া যখন সিঙ্গাপুরকে পৃথক করে দিলো, তখন মনে হলো— ‘ইট বিকাম এ হার্ট উইদাউট বডি’। কিন্তু সেই অনিশ্চিত সিঙ্গাপুর দরিদ্র অবস্থান থেকে কত্তো উপরে উঠে এসেছে তা রীতিমতো অভাবনীয়। দুনিয়ায় ‘সিটি স্টেট’ বলতে এখন সিঙ্গাপুরকেই বোঝায়। সিঙ্গাপুরের এমন ঈর্ষণীয় সাফল্যের মূলে রয়েছে ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে দুনিয়াজুড়ে ব্যাপক পরিচিতি। প্রতিবছর এখানে কয়েকশ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য হয়। এই সাফল্যের নেপথ্যে আরো একটি কারণ—১. সিঙ্গাপুরের জনগণ কথার চেয়ে কাজে বেশি বিশ্বাসী। ২. তারা মালিক-শ্রমিক বিরোধ বাধতে দেয় না। আগেই ঝামেলা মিটিয়ে ফেলে। ৩. সিঙ্গাপুরের লোকসংখ্যার তুলনায় শিল্প-কারখানার সংখ্যাও খুব বেশি নেই। বলা যায় সিঙ্গাপুরের সমৃদ্ধির নেপথ্য মূলত বন্দরকে কেন্দ্র করেই।
আমাদের দেশে অনেক সম্ভাবনা বিদ্যমান। কার্যকর করার অভাবে সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার শিল্পবান্ধব উদ্যোগ গ্রহণ করলে, দেশের শিল্প উদ্যোক্তাদের নিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়ে আলোচনা করলে লাখো-কোটি বেকারের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, কর্মসংস্থান ব্যাংক, অন্যান্য ব্যাংকগুলো এবং জনশক্তি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সমন্বয়ে উপযোগী প্রশিক্ষণের ভিত্তিতে লোনা সহায়তা দিয়ে মধ্যম সারির শিক্ষিতদের আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতে পারে। প্রশিক্ষণ দিয়ে লোন সহায়তা দিয়ে জনশক্তি রপ্তানি বাড়ানো যেতে পারে। সমবায়ের মাধ্যমে সামাজিক পুঁজি ভিত্তিক স্থানীয়ভাবে ছোট-বড় প্রকল্প গড়ে তোলা যেতে পারে।
মালয়েশিয়ার দিকে তাকালে কী দেখব। ১৯৫৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত মালয়েশিয়া ছিল দারিদ্র্যপীড়িত বৃক্ষমানব দেশ। মাহাথির মোহাম্মদ মন্ত্রীদের কাছে ব্যবসায়ী সমাজের সহজ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করলেন। ১৯৭৮ সালে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে তিনি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেশের প্রত্যেকের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির ব্যাপারে মনোযোগী হন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো— ১. আইনশৃঙ্খলার অস্বাভাবিকতায় কেউ যেন ভীতসন্ত্রস্ত্র না হয়। ২. বিনিয়োগকারী যেন আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় না পড়েন। ৩. কর্মীদের উচ্ছৃঙ্খলতা ও দুর্নীতির কালো থাবা যেন উৎপাদন ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি না করে। বলা যায়, এই বলিষ্ঠ পদক্ষেপ মালয়েশিয়াকে বাণিজ্যবান্ধব রাষ্ট্রে পরিণত করে। ফলে দেখা গেছে, শুধু টিন ও রাবার রপ্তানিকারক দেশ মালয়েশিয়া মাত্র দুই দশকে ইলেকট্রনিক, ইস্পাত, যন্ত্রপাতি এমনকি মোটরগাড়ি রপ্তানিকারক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। সরকারি মালিকানাধীন সংস্থাগুলোর বেসরকারিকরণ, বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের মাধ্যমে মালয়েশিয়াকে দ্রুত শিল্পায়নে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ বা দাতা সংস্থার পরামর্শ এড়িয়ে দেশের জন্য যা মঙ্গলকর তা-ই করেছেন মাহাথির। তারই ফলে মালয়েশিয়া মাত্র দুই দশকে অনগ্রসরতার পাতাল থেকে সগর্বে আরোহণ করেছে অগ্রগতির শীর্ষ চূড়ায়।
স্বাধীনতার সূচনালগ্নে মালয়েশিয়া যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল, বাংলাদেশ সৌভাগ্যবশত তেমন জটিল সমস্যার সম্মুখীন হয়নি। কারণ এ দেশের শতকরা ৯৮ জন বাংলায় কথা বলে। সম-সাংস্কৃতিক বন্ধনে আবদ্ধ প্রায় সবাই। আঞ্চলিক ভিন্নতাও কোনো জটিলতা সৃষ্টি করেনি আমাদের মাঝে। বিশেষ কিছু ঘটনাবলি ছাড়া ধর্মভিত্তিক অসহিষ্ণুতা সৃষ্টি করেনি জনসমষ্টির মধ্যে তেমন অনতিক্রম্য কোনো দূরত্ব। অতীতে একসাথে নির্যাতিত হওয়ার বেদনা, মুক্তিযুদ্ধে সমানভাবে ত্যাগ স্বীকার এবং বিজয়ের আনন্দে সমান অংশীদার হওয়ার গৌরবের স্মৃতিও জাতীয় পর্যায়ে সৃষ্টি করেছিল একধরনের নিবিড় আত্মীয়তা। বাংলাদেশ একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্তার দেশ। মুক্তিযুদ্ধের আগুনে ঝলসে সেই ঐক্যতা আরো দৃঢ় ও গভীর হয়। ১৯৫৭ সালে মালয়েশিয়া যে অবস্থায় ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশ তার চেয়ে ভালো অবস্থায় থেকে যাত্রা শুরু করে। সত্তরের দশকের দিকে বিদেশীদের সহায়তায় এ দেশের উদ্যোক্তারা গার্মেন্ট শিল্পের বিকাশ ঘটাতে শুরু করেছিল। সেই শিল্প থেকে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। এ শিল্পের বিকাশের ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে ৩০ লাখ শ্রমিকসহ অন্তত দুই কোটি লোকের।
বাংলাদেশের মাটির নিচে লুকিয়ে আছে সম্পদের বিশাল ভান্ডার। শুধু এই খনিজসম্পদ দিয়েই বাংলাদেশ হতে পারে সমৃদ্ধিশালী একটি দেশ। তেল, গ্যাস, কয়লা, চুনাপাথর, তামা, লোহা, গন্ধক, নুড়িপাথর, শক্ত পাথর, বালি এসব অফুরন্ত সম্পদকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারতে হবে। পর্যটন শিল্পে রয়েছে বাংলাদেশের অফুরন্ত সম্ভাবনা। আমাদের আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার। আছে বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন। প্রাকৃতিক মনোরম দৃশ্য, স্থাপনা, ঐতিহ্যজড়িত পর্যটন স্পট রয়েছে দেশজুড়ে। জনশক্তি রপ্তানি আরেক সম্ভাবনাময় খাত। বাংলাদেশের প্রবাসী রেমিট্যান্স দ্রুত বাড়ছে। আউটসোর্সিংসহ প্রযুক্তিভিত্তিক আয়রোজগারে দেখা দিয়েছে বিরাট সম্ভাবনা। সফটওয়্যার ও এনিমেশন শিল্পে সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে। আবার কৃষি অর্থনীতি হচ্ছে বাংলাদেশের মেরুদণ্ড। সম্প্রসারিত হচ্ছে কৃষিপণ্যের বাজার। সবচেয়ে বড় সম্ভাবনার খাতটি হচ্ছে বাংলাদেশের তরুণসমাজ। এদেরকে কাজে লাগালেই পাল্টে যাবে দৃশ্যপট। তরুণ-যুবশক্তিই উন্নত বাংলাদেশে পিলার অব সাকসেস। কারণ তরুণরা কর্মপ্রাণ হলেই সমৃদ্ধি সম্ভব। আরেকটা আশার দিক হচ্ছে তরুণরা কেবল চাকরি নির্ভর না হয়ে নিজেরা উদ্যোক্তা হয়ে উঠছে। যার মাধ্যমে একদিকে নতুন নতুন শিল্পের সৃষ্টি হচ্ছে, অপরদিকে প্রচুর জনশক্তির কর্মসংস্থান হচ্ছে। তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার এই প্রবণাতে সামাজিক পুঁজিতে পরিণত করতে পারলেই উন্নত বাংলাদেশের চালিকাশক্তি হবে তারাই। ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা থাকলে এক্ষেত্রে আরো উন্নতি সাধন সম্ভব। বর্তমানে বিশ্বে মূল্যবান সম্পদ হলো মানবসম্পদ। এই বিশাল সম্ভাবনাময় সম্পদটি বাংলাদেশের হাতের মুঠোয়। ১৬ কোটি মানুষের বত্রিশ কোটি হাতকে দক্ষ কর্মীর হাত হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে সহজেই বাংলাদেশ সমৃদ্ধ ও স্বনির্ভর হয়ে উঠবে। প্রয়োজন শুধু যোগ্য নেতৃত্বের। জনবহুল বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হলে এর সুফল পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার রয়েছে চারটি স্তর- বিত্তহীন, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত। নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীনদের কাজের ক্ষেত্র রকমারি। উচ্চবিত্তদের জন্য রয়েছে অবারিত সুযোগ। মধ্যবর্তী অবস্থানে মধ্যবিত্ত শ্রেণি আছে উভয় সংকটে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির সমস্যা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ভাঙতে হবে মধ্যবিত্তের সীমাবদ্ধতার শেকল। কেননা মধ্যবিত্তশ্রেণী সমাজের মূল্যবোধের ধারাকে ধারণ এবং লালনের মাধ্যমে একে প্রবাহিত করে প্রজন্মান্তরে। সমাজে নতুন মূল্যবোধও জাগরিত হয় মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকেই।
আমাদের দেশেও শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে। অনেক দেশীয় কোম্পানি ক্রমেই গ্রুপ অব কোম্পানিতে পরিণত হচ্ছে। কোম্পানি কারও নিজের সম্পদ নয়। কোম্পানি দেশ ও জনগণের সম্পদ। দেশ ও সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখার উদ্দেশ্য নিয়েই কোম্পানি বিকশিত হয়। একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে শুধু মালিক বা উদ্যোক্তারা লাভবান হন না। লাভবান হয় দেশের মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্র। গার্মেন্ট শিল্পের কথাই ধরা যাক। একটি মধ্যমানের গার্মেন্টে প্রায় ১ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়। এই গার্মেন্টের পোশাক দেশীয় চাহিদা মেটায় এবং বিদেশে রপ্তানি হয়। সরকার রাজস্ব পায়। এখন গার্মেন্টটির শ্রমিকদের কম বেতন দেওয়া হয় বা কোনো অনিয়ম ঘটছে এমন কোনো কারণে গার্মেন্টটি বন্ধ করাটা সমীচীন নয়। আমার মনে হয় দোষ খোঁজার আগে এর অবদান বিবেচনা করা উচিত। আমাদের দেশের ইতিবাচক শিল্প-উদ্যোক্তাদের নিয়ে ১০ বছরের একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারলে পাল্টে যাবে দেশের চেহারা। এজন্য প্রয়োজন—
1. মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি ইতিবাচক সরকার গঠন। ২. দেশের জনগণ এবং দেশের সম্পদকে কাজে লাগানো। ৩. দেশের অপচয়, দুর্নীতি, খেলাপি ঋণ, কালো টাকার লাগাম টেনে ধরা, কালো টাকাকে ভালো কাজে বিনিয়োগ করার সৃষ্টি করা- যেমন উন্নত আধুনিক হাসপাতাল, আধুনিক গণপরিবহন, পর্যটন, জেলা পর্যায়ে শিল্প কারখানা। ৪. শিল্প-কলকারখানা গড়ে তুলতে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের সর্বোচ্চ সহায়তা দেয়া। ৫. কৃষকদের আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির সুবিধা ও তাদের ন্যায্য মূল্য দিয়ে উৎপাদন বাড়ানো। ৬. তরুণ সমাজকে উপযোগী কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা। ৭. তরুণ, দেশপ্রেমী এবং ইতিবাচক মনোভাবাপন্ন নেতৃত্ব সৃষ্টি করা। ৮. রাজনৈতিক অস্থিরতা-অবিশ্বাস-অনাস্থাকে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নিয়ে আসা। ৯. সেক্টরভিত্তিক পেশাজীবী ফোরাম গঠন করে উন্নয়নে নতুন নতুন পদক্ষেপ নেয়া। ১০. দেশের কল্যাণে শিক্ষক, চিকিৎসক, পুলিশ, লেখক-সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ পেশা হিসেবে সুবিধা প্রদান করা।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক
writetomukul36@gmail.com