সোহেল অটল, ভিয়েতনাম থেকে ফিরে
হ্যা লং উপকূলে প্রায় ২০০ মিটার উঁচু ‘কবিতা পাহাড়’ হাজার হাজার বছর ধরে গভীর সমুদ্রের মাঝিদের ঘরে ফেরার নিশানা হিসেবে কাজ করেছে। এই পাহাড়ের প্রতি স্থানীয়দের ভক্তি তাই অন্যরকম। পাহাড় নিয়ে লিখেছেন তারা কবিতা। পাহাড়ের নামও রেখেছেন ‘কবিতা পাহাড়’।
স্থানীয়রা বলেন ‘বাই থো নুই’। ইংরেজিতে ‘পোয়েম মাউন্টেন’। একটা পাহাড়ের নাম ‘কবিতা’ হতে পারে, ব্যাপারটা ভাবতেই যেন কেমন লাগে!
ভিয়েতনামে জনসভ্যতা গড়ে ওঠার ইতিহাস পুরনো। সঙ্গত কারণেই তাদের সংস্কৃতিও সমৃদ্ধ। হ্যা লং উপকূলে এই ২০০ মিটার উঁচু কবিতা পাহাড়ের একটা গল্প আছে।
প্রাচীনকাল থেকে উপকূলের মানুষ সমুদ্রের ওপর ভরসা করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। সমুদ্রের মৎস্যসম্পদ থেকে শুরু করে নানা প্রাকৃতিক সম্পদ মনুষ্য জীবিকার অন্যতম উৎস হয়ে আছে। বলা হয়ে থাকে, একটা সমুদ্র একাই প্রাণিজগৎ বাঁচিয়ে রাখতে পারে তার নিজস্ব সম্পদ দিয়ে। হ্যা লং তারই সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ।
হ্যা লং উপকূলের মানুষ মাছ ধরাসহ নানা কাজে গভীর সমুদ্রে গিয়ে থাকেন। প্রাচীনকালে যখন কম্পাস আবিষ্কার হয়নি, মাঝিরা গভীর সমুদ্র থেকে উপকূলে ফিরে আসত কী করে? পৃথিবীর সব উপকূলেই এমন কিছু নিশানা থাকে যা দেখে মাঝিরা ফিরে আসতে পারে। হ্যা লং উপকূলের নিশানা ছিল এই কবিতা পাহাড়। ২০০ মিটার উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় জ্বলত মশাল। তা দেখেই মাঝিরা ফিরে আসত গভীর সমুদ্র থেকে।
কবিতা পাহাড় সেই অর্থে হ্যা লং উপকূলের মানুষের ঘরে ফেরার নিশানা। তখন এ পাহাড়ের নাম ছিল ট্রুয়েন ড্যাং। ইংরেজি করলে লাইটহাউজ। পরে ১৪৬৮ সালে কিং লি থান টং-এর একটা কবিতা পাহাড়ের চূড়ায় পাথরে খোদাই করা হয়। তখন থেকে এ পাহাড়ের নাম হয়ে যায় ‘পোয়েম মাউন্টেন’।
হ্যা লং বে’র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্বঐতিহ্যের একটা এই হ্যা লং বে। সমুদ্রে এলোপাতাড়ি চীনা পাথরের পাহাড়ে ভরপুর সেই চোখ জুড়ানো দৃশ্য এক ফ্রেমে দেখার জন্য কবিতা পাহাড়ের চূড়া সর্বোৎকৃষ্ট জায়গা। ২০০ মিটার পাহাড় চড়তে সাকল্যে সময় লাগে ৩০ মিনিট। চূড়ায় ভিয়েতনামের বিপ্লবী লাল পতাকা উড়ছে পতপত করে। পাশেই পাথরে খোদাই করা কিং লি থান টং-এর কবিতা। আর চোখটা মেলে ধরলেই অপার্থিব হ্যা লং বে। এক ফ্রেমে প্রায় দুই হাজার চীনা পাথরের পাহাড়। সবুজে বেষ্টিত, সমুদ্রে ছড়ানো-ছিটানো।
কবিতা পাহাড় দেখতে ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয় থেকে প্রায় দেড়শ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে স্থলপথে। ট্রেনে যাওয়ার ব্যবস্থা নেই। তবে ভিয়েতনামের বাস সার্ভিস বেশ উন্নত। সব বাসই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। ঘণ্টা চারেকের একটা জার্নি শেষে হ্যা লং পৌঁছালে মন জুড়িয়ে যাবে। পাহাড়ি এই ছোট্ট শহরটার পরতে পরতে চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য। পাহাড়, সবুজ, সমুদ্রের সঙ্গে স্থানীয়দের আন্তরিক আচরণ- সবকিছুই মুগ্ধ করবে।
হ্যা লং পৌঁছে কবিতা পাহাড় দেখা যাবে। আর কবিতা পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে হ্যা লং বে’র যে সৌন্দর্য চোখে ধরা পড়বে তা ভ্রমণপিয়াসীদের নতুন গন্তব্যে নিয়ে যাবে।