ড. আবু জাফর সিদ্দিকী
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের হিসাবে, দেশে নিবন্ধিত যানবাহন আছে প্রায় ৪৪ লাখ। পরিবহন খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব যান চালনার সঙ্গে যুক্ত আছেন প্রায় ৭০ লাখ শ্রমিক। দেশের সড়ক খাতে সঠিক বেতন কাঠামো কার্যকর না থাকায় প্রায় ৯৮ শতাংশ পরিবহন শ্রমিক দৈনিক মজুরি বা ট্রিপভিত্তিক চাকরি করে থাকেন। অর্থাৎ দিনে এনে দিনে খায় অবস্থা। করোনা মহামারীতে অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে ঢাকা ছাড়লেও রাজধানীর গণপরিবহন সংকট কাটেনি। এখনো গন্তব্যে পৌঁছাতে নাভিশ্বাস উঠছে কর্মজীবী রাজধানীবাসীর। পথেই নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান কর্মঘণ্টা। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন কর্মজীবী নারী ও বৃদ্ধরা। এদিকে বাস সংকট থাকলেও সড়কে বিশৃঙ্খলার কারণে তৈরি হচ্ছে দীর্ঘ যানজট, যা দীর্ঘায়িত করছে ভোগান্তি। অসংখ্য কর্মজীবী নারীকে সংসার সামলানোর পরও বাসে জায়গা পেতে অতিরিক্ত এক-দুই ঘণ্টা সময় হাতে নিয়ে বের হতে হয় বাসা থেকে। করোনা মহামারীতে স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে অনেকে বাধ্য হয়ে ভিড় ঠেলে বাসে যাতায়াত করছেন।
রাজধানীতে গণপরিবহন নৈরাজ্যে যানজট ও গণপরিবহন সংকটের সমস্যা দীর্ঘদিনের। করোনার মধ্যে অনেক মানুষ ঢাকা ছাড়লেও সমস্যা দূর হয়নি। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ পাসের পর ফিটনেস না থাকা অনেক বেসরকারি গাড়ি রাস্তা থেকে উঠে গেছে। বর্তমানে নতুন রুট পারমিটও বন্ধ রয়েছে। বাস মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতি বলছে, অফিস টাইমে ভিড়ের সমস্যা আগেই ছিল। এ ছাড়া ঢাকায় গাড়ি চালানো তেমন লাভজনক না হওয়ায় কিছু কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। ২২টি কোম্পানির আওতায় শিগগিরই নতুন গাড়ি রাস্তায় নামছে। তখন গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরবে। এতে রাজধানীর মধ্যে আন্তঃজেলা বাসের চাপ কমবে। পরিবহন সংকটে দৈনিক ক্ষতি হচ্ছে বহু টাকা। আমাদের আশা, কর্তৃপক্ষ অচিরেই এ সংকট সমাধান করবে।
যানবাহনের চালক ও মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা যেন দিন দিন সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সিএনজি চালিত অটোরিকশা, ট্যাক্সিক্যাবের দৌরাত্ম্যের কোনো শেষ নেই। অটোরিকশাচালকরা যাত্রীদের জিম্মি করে প্রতিদিন হাতিয়ে নিচ্ছে অতিরিক্ত প্রায় ১ কোটি টাকা। মিটারে নয়, মনগড়া চলাচলেই তারা অভ্যস্ত। এগুলো দেখার যেন কেউ নেই।
জরুরি মুহূর্তে অটোরিকশা ও ট্যাক্সিক্যাব যাত্রীদের দিকে ফিরেও তাকায় না। তাকালেও ভাড়া চেয়ে বসে দ্বিগুণ-তিনগুণ। মিটারের কোনো বালাই নেই। মৌখিক চুক্তি মোতাবেক চালকরা অস্বাভাবিক হারে ভাড়া আদায় করছে। অন্যদিকে বাস কাউন্টারে নিয়মিত চলছে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায়ের নানান ফন্দি। সরকারিভাবে ভাড়া নির্ধারণ করা হলেও পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা তা মানছে না।
বর্তমানে রাজধানীতে লোকাল বাসের পাশাপাশি চলছে বিভিন্ন ধরনের ‘কাউন্টার সার্ভিস’। আর এই সার্ভিসের নামে একই রুটে একই দূরত্বে আদায় করা হচ্ছে একেক রকমের ভাড়া। অন্যদিকে সিটিং সার্ভিস লেখা থাকলেও বেশিরভাগ সার্ভিসে দাঁড় করিয়েই যাত্রী নেওয়া হয়। বাড়তি ভাড়া আদায়, একেক রকম ভাড়া আদায় এবং দাঁড় করিয়ে যাত্রী নেওয়ার বিষয়ে কেউ প্রতিবাদ করলে তার জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না পরিবহন কর্তৃপক্ষ। দু-একটি রুটে বিআরটিসি বাস সার্ভিস চালু হলেও সেবার মান নিয়ে অভিযোগ রয়েছে।
সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, কোনো বাস সার্ভিসই সরকার নির্ধারিত হারে ভাড়া আদায় করে না। নানা অজুহাতে মালিক-শ্রমিকরা সরকারের আইনকে অমান্য করে বেশি ভাড়া আদায় করে থাকে। এছাড়া গণপরিবহনের তীব্র সংকট নাগরিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এ অবস্থায় নাগরিক দুর্ভোগ কমাতে সিএনজি অটোরিকশা, টেক্সিক্যাব যাতে মিটারে চলে সে ব্যবস্থা করতে হবে এবং যাত্রীদের প্রয়োজন অনুযায়ী যেন গন্তব্যে যায় সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।
তদুপরি বাস, মিনিবাসগুলো যেন ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য চালাতে না পারে সেটিও দেখতে হবে জরুরিভাবে। গণপরিবহনের সংকট দূর করতেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক এবং তা খুব দ্রুত। এ ব্যবস্থাগুলো নিশ্চিত হলেই কেবল যাত্রীরা জিম্মি দশা থেকে মুক্তি পাবেন।
লেখক : গবেষক ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, চাইল্ড কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, উত্তরা, ঢাকা