পৃথিবীতে অনেক ধর্ম বিদ্যমান রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ইসলামই হলো সঠিক ও সত্য ধর্ম। বাকি সব বাতিল। পৃথিবীতে যত নবী-রাসুল এসেছেন সবাই ইসলামের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে শয়তানের প্ররোচনায় বিভিন্ন ধর্ম ও মতের আবির্ভাব ঘটে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যে কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য দীনের অন্বেষণ করবে তার পক্ষ থেকে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত-৮৫)
অতএব, ইসলাম ছাড়া যত দীন আছে সবই বাতিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যার হাতে মোহাম্মদের প্রাণ রয়েছে তার শপথ, যদি এ উম্মতের মধ্য হতে কোনো ইহুদি ও খ্রিস্টান আমার কথা শুনে কিন্তু আমাকে যা কিছু দিয়ে পাঠানো হয়েছে তার ওপর ঈমান না এনে মারা যায়, তাহলে সে জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’
ইসলাম অর্থ আত্মসমর্পণ করা। যেহেতু মহান পরাক্রমশালী আল্লাহতায়ালার দরবারে আত্মসমর্পণ করার দ্বারা মানুষ তার প্রবৃত্তির শৃঙ্খল মুক্ত হয়ে পরস্পর সহানুভূতি ও শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে, এ জন্যই ইসলামকে শান্তির ধর্ম বলা হয়। ইসলামের নবীগণের দাওয়াতও ছিল শান্তির পয়গাম। প্রত্যেক কওম বা জনপদবাসী যখন প্রবৃত্তির তাড়নায় মানবতার শেষ চিহ্নটুকু হারিয়ে হিংস্র পশুর চরিত্রে রূপান্তর হয়েছিল, তখনই এই বর্বরতা নির্মূলের জন্য নবীগণ আগমন করতেন। তারা মানুষকে ডাকতেন আল্লাহর দিকে। আহ্বান করতেন, হে মানবজাতি! তোমরা বলো, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ আল্লাহ ছাড়া গোলামির উপযুক্ত আর কেউ নেই। তবে তোমরা এই নিকৃষ্টতা থেকে উঠে সফলতা লাভ করবে।
ছোট্ট একটি বাক্য। মানুষের প্রবৃত্তির গোলামি ছেড়ে মহান সৃষ্টিকর্তার গোলামি কর। সমাজে ভারসাম্য ফিরে আসবে। কারণ মানুষ যদি প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, তবে প্রত্যেকের প্রবৃত্তি স্বভাবতই এক রকম হবে না। ভিন্ন হবে। আর এতে শুরু হবে বিশৃঙ্খলা। অথবা প্রত্যেকেই একজনকে মানতে পারবে না, কারণ সবাই একজন মানুষের ব্যাপারে একমত হতে পারবে না। এখন যাদের ব্যাপারে একমত হবে তারা যদি আবার ইচ্ছামতো পরিচালনা করে তাহলে পরিচালক শ্রেণির মধ্যেও শুরু হবে পরস্পর দ্বন্ধ, বিদ্বেষ ও শত্রুতা এবং এক পর্যায়ে বেধে যাবে লড়াই-যুদ্ধ। এসবের একমাত্র সমাধান হলো, মানুষ তার বিষয়কে মহান সৃষ্টিকর্তার হাতে অর্পণ করবে। এখানে সবার একমত হওয়া সম্ভব। ফলে শান্তি সম্ভব হবে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চই ধর্ম একমাত্র আল্লাহতায়ালার নিকট ইসলামই।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত-১৯)
ইসলামের শেষ নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লামের আগমনের পূর্বের ইতিহাসও সুপ্রসিদ্ধ। যে সময়ে মেয়েরা ছিল অবহেলিত। লাঞ্ছনা ও বঞ্চনার পাত্র। জীবন্ত পুতে ফেলা হতো তাদের। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরস্পর লড়াই করতো। বিদ্বেষের এ লড়াই চলতো যুগ যুগ ধরে। তখন হারিয়ে গিয়েছিল মানবতা। রাসুলে আরাবির আগমনের পর নবুওয়াতি মেহনতের উৎকর্ষ সাধনে দূর হলো মানবতার হাহাকার। বন্ধ হলো সকল গর্হিত কাজ। হিংস্র চরিত্রের মানুষগুলো হয়ে গেলো ফেরশতাসুলভ আখলাকের অধিকারী। যুদ্ধের ময়দানে পানির তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছে জাতি। এমন সময় পাশ থেকে আওয়াজ আসল পানি পানি। তখন নিজে পান না করে পাঠিয়ে দিলেন পাশের ভাইয়ের জন্য। ইসলামের ছায়াতলে এসে এমনই হয়েছিল তাদের আদর্শ। এজাতীয় অনেক ঘটনা নির্ভরযোগ্য ইতিহাসগ্রন্থে আছে সংরক্ষিত।
ইসলামের বাণী : ‘যার হাত ও মুখ থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকে সেই প্রকৃত মুসলিম’। (সহিহ বুখারি) সামাজিক জীবনে অশান্তির যে কারণ রয়েছে, তা দূর করতে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে ইসলাম। ইসলামে পর্দার বিধান সমাজ থেকে উলঙ্গপনা ও ইভটিজিং দূর করার যথাপোযুক্ত ওষুধ। মাদক নিষিদ্ধকরণ অনৈতিকতা রোধে এক সফল পদক্ষেপ। ক্রোধ-হিংসা, লোভ-লালসা, অহংকার ইত্যাদি যা সমাজ দূষণে গুরুত্তপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তা দূরীকরণে ইসলামের সমাধানও খুব চমৎকার। সর্বোপরি একজন মানুষকে শুধু বাহ্যিক শাস্তির ভয়ে এসব থেকে বিরত রেখে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়; বরং ওই মহান সত্তার প্রতি বিশ্বাস যিনি সর্বদা আমাদের প্রত্যক্ষ করছেন। মনের অবস্থা সম্পর্কেও সম্যক অবগত এবং অবধারিত মৃত্যু পরবর্তী শাস্তির ভয়ই কেবল পারে ওই সব গর্হিত কাজ হতে বিরত রেখে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে।
পৃথিবীর সবাই শান্তি, সমতা ও ঐক্যের পক্ষে নয়। অনেকে তা বিঘ্নিত করতে চায় নিজের কায়েমি স্বার্থ রক্ষার জন্য। ফলে শান্তির প্রবাহকে নির্বিঘ্ন করার জন্য কখনো কখনো শক্তি প্রয়োগ দরকার হয়। ঠিক যে কারণে পুলিশ, সেনাবাহিনী ইত্যাদি যা সকল দেশে বিদ্যমান। শুধু শান্তি ও সুবিচারগুলো নিশ্চিত করার জন্যই ইসলাম শক্তি ব্যবহারের অনুমতি দেয়। যাতে শান্তি ও সুবিচার বিরোধীরা সংযত থাকতে বাধ্য হয়। অনেক অমুসলিম ঐতিহাসিকও এ বাস্তবতা স্বীকার করেছেন, ইসলাম জবরদস্তির মাধ্যমে বিস্তার লাভ করেনি। কারণ মুসলিমরা আটশত বছর স্পেন শাসন করেছে। সেখানে কখনো কাউকে ইসলাম গ্রহণের জন্য বাধ্য করা হয়নি; বরং পরবর্তীতে খ্রিস্টান ধর্মযোদ্ধারা স্টেনো এসে মুসলমানদের এমনভাবে বিতাড়ন বা ধর্মান্তর করে যে, সমগ্র স্পেনে প্রকাশ্যে আজান দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। ইসলাম প্রচার-প্রসারে কাউকে জবরদস্তি বা বাধ্য করার অনুমতি ইসলামে নেই। পবিত্র কোরআনুল কারীমে মহান আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেছেন ‘ধর্ম গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো বলপ্রয়োগ নেই।’ অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘সত্য অসত্য থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-২৫৬) আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমার রবের দিকে ডাক প্রজ্ঞা ও সদোপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে যুক্তি প্রদর্শন কর সর্বোত্তমভাবে।’ (সুরা নাহাল, আয়াত-১২৫)
রিডার্স ডাইজেস্ট ‘আলমানাক’ বর্ষসংখ্যা ১৯৮৬-এর একটি প্রবন্ধে ১৯৩৪ থেকে ১৯৮৪ এই অর্ধশত বছরে বিশ্বের প্রধান ধর্মানুসারীদের শতকরা বৃদ্ধির পরিসংখ্যান দেওয়া হয়। উক্ত পরিসংখ্যান মতে মুসলমানদের বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ২৩৫% এবং খ্রিস্টানদের মাত্র ৪৭%। এত্তোসব পরিসংখ্যান বাস্তব সত্য। ইহুদি-খ্রিস্টানচক্র ইসলামের বিরুদ্ধে মহাপরিকল্পনা মাফিক চক্রান্তের অংশ হিসেবে পুরো বিশ্বে জঙ্গিবাদ নামের ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছে। এর সাথে জুড়ে দিয়েছে ইসলামের নাম। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে তারা এব্যাপারে ব্যাপক প্রচারনা চালিয়ে যাচ্ছে। একজন বিবেকবান মানুষ মাত্রই বুঝবেন, এই শতাব্দীর শুরু থেকে অদ্যাবধি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেমন আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, ইরাক, লিবিয়া, পাকিস্তানসহ বহু জায়গায় সন্ত্রাস দমনের নামে জঙ্গিবাদি কার্যকলাপ করা হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদের বিস্তারে ইহুদি-খ্রিস্টান অপশক্তি বা তাদের দোসরদের মাধ্যমেই জঙ্গিবাদ সংঘটিত হচ্ছে। ইসলামের সাথে যার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। তাদের চক্রান্তের অংশ হিসেবে আমাদের এ প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশেও একই কার্যক্রম চলছে। প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহ, প্রতি মাস, প্রতি বছরে শতশত মানুষকে বিনা কারণে মেরে ফেলা হচ্ছে।
ইহুদি-খ্রিস্টানদের এদেশেও একশ্রেণির লোক জঙ্গিবাদের সাথে ইসলামের নাম সংযুক্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে, ইসলামী শিক্ষার মৌলিক সুতিকাগার মাদরাসাকে। যেখানে শিক্ষা দেওয়া হয় মানবতা। গড়ে তোলা হয় প্রকৃত মানুষরূপে। দেশ স্বাধীন হওয়ার থেকে এখন পর্যন্ত মাদরাসা কর্তৃক জঙ্গিবাদ ঘটনার কোন শতভাগ সত্য প্রমাণ আছে কি? মাদরাসার ছাত্ররা কয়টি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। শতকরা হিসেবে তার পরিমাণ কত! এই মাদরাসাগুলোয় শিক্ষা দেওয়া হয় শান্তিপূর্ণভাবে ইসলাম পালনের ও তা প্রচার-প্রসারের। ইসলামী শিক্ষা বা মাদরাসা শিক্ষার কোথাও জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই।
আমাদের উপমহাদেশসহ সারা পৃথিবীতে শান্তিপূর্ণভাবে ইসলামপ্রচারে সর্বাধিক ভূমিকা রেখেছে কওমি ওলামায় কেরাম বা ওলামায়ে দেওবন্দ। যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তাবলীগ জামাত। যা নয়াদিল্লী থেকে শুরু হয়ে সুদূর ইউরোপ। আটলান্টিক পেরিয়ে আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর প্রায় সকল দেশে শান্তিপূর্ণভাবে ইসলাম প্রচার করছে। এর প্রতিষ্ঠাতা কওমির সূর্য সন্তান মাওলানা ইলিয়াস (রাহ.)। যিনি সকল কওমি মাদরাসার প্রাণকেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দেরই একজন স্বনামধন্য কৃতী সন্তান। চিন্তা-চেতনায়, ধ্যান-ধারণা সকল ক্ষেত্রেই তিনি দেওবন্দি আকাবীরের প্রতিচ্ছবি ছিলেন। মানুষের বাহ্যিক সংশোধনের সাথে আত্মিক ও রুহানি আত্মশুদ্ধির জন্য সঠিক তাসাউফের সিলসিলাও অব্যাহত রেখেছেন ওলামায়ে দেওবন্দ। আল্লাহতায়ালা ওলামায়ে দেওবন্দের মাধ্যমে শান্তির ধর্ম ইসলামকে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে সর্বত্র পৌঁছান। আমিন।
মুফতি উবায়দুল হক খান
লেখক : মুহাদ্দিস ও শিক্ষাসচিব, জামিআতুস সুফফাহ আল ইসলামিয়া হামিউস সুন্নাহ, গাজীপুর