এ বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর। কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা এই কবিতার লাইন আমাদের মনে করিয়ে দেয় পৃথিবীর মঙ্গলময় সৃষ্টিতে নারীর রয়েছে সমান অবদান। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা কিন্তু অতীত কাল থেকেই অবহেলিত। অথচ আমরা নারীর ওপর সহিংসতার আগে ভুলেই যাই, এরকমই কোনো নারীর দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করা তীব্র যন্ত্রণা হাসিমুখে সহ্য করার কারণেই আজ আমরা এই পৃথিবীতে। পৃথিবীতে আজ আমার যে অধিকার বলে চিৎকার করি সে অধিকার আদায়ের শুরুটা পৃথিবীর আলো দেখিয়ে একজন নারীই করেছে। দিন বদলের সাথে সাথে নারীদের আত্মপ্রকাশের সুযোগ তৈরি করে নিতে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। নারীর কাজ যে শুধু সন্তান জন্মদান নয়, তা বোঝাতেই কেটে গেছে অনেক বছর। নারীদের কাজের ক্ষেত্র বেড়েছে। ঘরের কোণ থেকে বের হয়ে আজ মহাশূন্য পর্যন্ত তারা পদচিহ্ন রাখছে সফলতার সাথে। তবে কাজের ক্ষেত্র বাড়লেও কমেনি নারীর ওপর সহিংসতার হার। বরং দিন দিন সহিংসতার নতুন নতুন ঘৃণ্য রূপ সমাজকে প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। যে সহিংসতা থেকে বাদ পড়ছে না তিন থেকে ত্রিশ বা তদূর্ধ্ব বয়সী নারীরা। তাদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, কুপিয়ে রাস্তায় ফেলে রাখা হচ্ছে, বাসে ট্রামে গণধর্ষণ শেষে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এতসব করেও নারীরা আমাদের উন্নয়নের অগ্রযাত্রার সমান অংশীদার। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অর্ধেক শক্তি। নারীশক্তি বাদ দিয়ে দেশের অগ্রযাত্রা অসম্ভব।
কিছু মানুষের বর্বরতায় কলুষিত হচ্ছে সমাজ জাতি দেশ। ধর্ষণ নামক এক নোংরা মানসিকতায় সমাজের কিছু মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে। তারা ধর্ষণ করে চলেছে প্রতিনিয়ত। সেখানে কোনো মায়া নেই, মানবিকতা নেই, কোনো সংকীর্ণতাবোধ নেই। তিন বছর থেকে শুরু করে সববয়সী নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এটা এমনভাবে বেড়ে চলেছে যে প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই ধর্ষণের খবর মিলছে। এটা তো গেল পত্রিকায় যা আসছে তার কথা। তার বাইরেও তো নারীদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে। যেগুলো অনেক সময় লোক চক্ষুর অন্তরালেই থেকে যাচ্ছে। সেসব যোগ করলে অনেকটা ভয়ংকর শোনায়। প্রতিদিন প্রতিমাস এমনকি প্রতিবছর এ সংখ্যা বেড়ে চলেছে। ধিক্কার উঠছে তাদের ঘিরে । তাদের কর্ণকুহরে আমাদের ঘৃণার বাণী পৌঁছানো যাচ্ছে না। তাদের মনে ঘৃণ্য দরজায় শুধু অন্ধকার। নিরাপদ করতে চেয়েও পারছি না। বাসযোগ্য করতে গিয়ে বার বার এসব বোধহীন, রুচিহীন মানুষেরা মুখোশ খুলে বেরিয়ে আসছে। জানি না আর কত দূর সে পথ যেখানে কেবল সভ্য সমাজের সভ্য মানুষেরাই থাকবে। কঠোর আইন রয়েছে, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা জোরদার হয়েছে তবু যেন এই ধরনের বিকৃত মানুষদের হাত থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না নারীদের। বারবার বিবেকের দংশনে দগ্ধ হতে হচ্ছে আমাদের। তবে আমরাও হেরে যাব না। একদিন না একদিন এ পৃথিবী নারী পুরুষ সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বাসযোগ্য করে যাব। আমরা ততদিন প্রতিবাদ করে যাব যতদিন পৃথিবীর কোনো না কোনো প্রান্তে নারীর ওপর নির্যাতন বন্ধ না হয়। নারীর ওপর নির্যাতন করার আগে ভাবতে হবে নারীর প্রতি আমার দায়িত্ব নির্যাতন নয় বরং অধিকার নিশ্চিত করা। পেশিশক্তির যুগে নারীর ওপর পেশিশক্তি দেখানোর ভেতর কোনো বীরত্ব নেই। বীরত্ব তো কেবল ভালোবাসায়। তাই নারীর প্রতি আর সহিংসতা নয়। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সমরে অংশ নেওয়ার উদাহরণ থেকেই দেশের কাজে তাদের সর্বোচ্চ অবদানের প্রমাণ পাওয়া যায়। আমাদের স্বাধীনতার পেছনে রয়েছে লাখ লাখ নারীর সম্ভ্রম।
মূলত দয়া নয়, অধিকারের দৃষ্টিতে দেখার অভ্যাস করতে হবে নারীদের। সেই অভ্যাসটা পরিবার থেকেই তৈরি করতে হবে। পরিবারেই যদি মেয়েদের নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয় বা কোনো পুরুষ সদস্যের সাথে তুলনায় খাটো করা হয়, তাহলে সমাজেও তার প্রভাব পড়ে। বাসে, অফিসে, রাস্তায় সবসময় যদি নারী নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং তাদের নিরাপত্তা পেতে আলাদা কোনো সাহায্য প্রয়োজন হবে ততদিন পার্থক্য সুস্পষ্ট থেকে যাবে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করতে হলে সমাজের একবারে প্রান্তিক শ্রেণি থেকে তার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বাল্যবিয়ে নামক ব্যাধি গ্রামে গঞ্চে ছড়িয়ে আছে। জেএসসি পরীক্ষার সময় দেখা যায় পত্রিকায় অনুপস্থিত মেয়েদের বেশিরভাগই বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এমনকি পিইসি পরীক্ষায় অনুপস্থিত অনেকে মেয়ের ক্ষেত্রেই ভাগ্যের এই নির্মম পরিহাসটি ঘটে। যেখানে একজন ছেলে সন্তানের পরিবার থেকে লক্ষ ঠিক করে দেওয়া হয় লেখাপড়া করে চাকরি করা। সেখানে মেয়ের ক্ষেত্রে ঠিক বিপরীত। স্বামী সন্তান নিয়ে যত তাড়াতাড়ি ঘরকন্নার কাজে লেগে পড়া যায় ততই মঙ্গল! এটাই বিপরীত চিত্র। এবং আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিত্য ঘটনা। কিন্তু উন্নয়ন করতে হলে এসব অবশ্যই প্রতিরোধ করতে হবে। আবার বিয়ের পর যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হওয়ার চিত্রও প্রায়ই দেখা যায়। যদিও এসব অপরাধ প্রতিরোধে আইন আছে এবং অনেকের ক্ষেত্রে শাস্তির ঘটনাও ঘটছে কিন্তু সমস্যা কমছে না। আমরা চাই সমাজে প্রতিটি ক্ষেত্রই নারীদের চলাচল এবং বসবাসের জন্য হবে নির্বিঘ্ন। যার নিশ্চিত পরিবেশ আমাদেরই তৈরি করতে হবে।